অমৌসুমেও পাওয়া যাবে আম, বাগান বাড়ছে

ঢাকার ফলের দোকানগুলো এখন পাকা আমে ঠাসা। বিপরীতে রাজধানীর আসাদ গেটের হর্টিকালচার সেন্টারে কয়েকটি আমগাছে সবে মুকুল এসেছে। একই দৃশ্য চুয়াডাঙ্গার বাঁকা গ্রামের চাষি আবুল কাশেমের আমবাগানেও।

আসাদ গেট আর চুয়াডাঙ্গার যেসব আমগাছে মাত্র মুকুল ধরেছে, সেসব আমের গাছ থাইল্যান্ডের কাটিমন জাতের। এ জাতের গাছ থেকে বছরে তিনবার আম পাওয়া যায়।

দেশে এখন অন্তত সাতটি জাতের আম চাষ হচ্ছে, যেগুলোকে অসময়ের আম বলা হয়। কাটিমন ছাড়া বাকি জাতগুলো হলো বারি–১১, কিং অব চাকাপাত, কিউজাই, বানানা ম্যাঙ্গো, তাইওয়ান গ্রিন, মিয়াজাকি অর্থাৎ সূর্যডিম। এসব আমের যেমন বাহারি নাম, দেখতেও তেমন নজরকাড়া। বারি–১১ ও কাটিমন আমের জাত আবার বারোমাসি।

ছবি: সংগৃহীত

মানুষ নিজেদের উদ্যোগে এসব আমের জাতের বাগান করছে। আবার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরও (ডিএই) জাতগুলো ছড়িয়ে দিতে উদ্যোগ নিয়েছে। লক্ষ্য একটাই, শুধু মৌসুমের কয়েক মাসের বাইরে অন্য সময়ও যাতে আম পাওয়া যায়। দেশে সাধারণত মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত চার মাসকে আমের মৌসুম হিসেবে গণ্য করা হয়।

উদ্যানতত্ত্ববিদ, ডিএইর কর্মকর্তা ও আমের বাগানমালিকেরা বলছেন, অসময়ের জাতের আমবাগান বাড়লে বছরজুড়েই দেশে উৎপাদিত আম পাওয়া যাবে।

আসাদ গেটের হর্টিকালচার সেন্টারটির নাম ফলবীথি। জুন মাসের প্রথম দিকে সেখানে এই প্রতিবেদক গিয়েছিলেন। পুরো উদ্যানে নানা ফল, সবজি, ফুলের চারা ও নানা জাতের গাছ।

কাটিমন আমের কয়েকটি গাছ দেখিয়ে সেখানকার উদ্যানতত্ত্ববিদ সিলমিন জাহান বলছিলেন, ‘থাইল্যান্ডের এ জাতটি বারোমাসি আম হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।’

সাত জাতের আমের পরিচিতিমূলক ইনফো

অসময়ের জাত এখন মাঠে

অসময়ের আম এখন পৌঁছে গেছে কৃষকের কাছে। এমন একজন চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার বাঁকা গ্রামের আবুল কাশেম। আট বছর ধরে তিনি কাটিমন আমের চাষ করছেন।

চুয়াডাঙ্গা শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে কাশেমের আমবাগানে ৪ জুন যান প্রথম আলোর জেলা প্রতিনিধি। তাঁকে কাশেম জানান, তাঁর বাগানে ২২ বিঘা জমিতে কাটিমন আমের গাছ রয়েছে। বছরে তিনবার ফলন হবে। সব মিলিয়ে অন্তত ১০০ টন আম আশা করছেন তিনি।

আবুল কাশেমের বাগানটি বড়। সেখানে রয়েছে নানা জাতের আমের গাছ। এর মধ্যে কাটিমনের কোনো গাছের আম পেকেছে, কোনোটিতে মুকুল এসেছে। এসব গাছের আম পাকতে নভেম্বর মাস এসে যাবে। কাশেম বলেন, তাঁর এক বন্ধু ২০০৮ সালে থাইল্যান্ড থেকে কাটিমনের কলম নিয়ে এসেছিলেন। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে বাগান বড় হয়।

চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন এলাকায় অসময়ের জাতের আমগাছ লাগানো হচ্ছে। বিশেষ করে যেসব এলাকার জমি একটু উঁচু। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তালহা জুবায়ের মাশরুর বলছেন, এখন অনেক কৃষক এবং সাধারণ মানুষ এসে এসব জাতের সন্ধান চান। চাষের নিয়ম জানতে চান।

বিদেশি ও দেশি বারোমাসি জাতের আমবাগান করে সাফল্য পেয়েছেন নাটোরের বাগাতিপাড়ার গোলাম মওলা। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে ২০০৪ সালে কৃষক হন। শুরুতে ঔষধি গাছের বাগান করতেন। পরে তিনি নাটোরের একটি কলেজে কৃষিবিজ্ঞানের শিক্ষক হয়েছেন। কিন্তু চাষাবাদ বন্ধ করেননি। এখন ফল চাষে ঝুঁকেছেন। আমবাগান করেছেন বেশি।

বিদেশি আমের চাষি হিসেবে গোলাম মাওলার বেশ নামডাক আছে। কৃষি দপ্তরের দেওয়া ঠিকানা ধরে তাঁর বাগানে গেলে তাঁকে সেখানেই পাওয়া যায়। কিং অব চাকাপাত, পালমার, বারি-১১, তাইওয়ান গ্রিন, কিংসটোন প্রাইড, থাই বারোমাসি—কড় গুনে হিসাব করে তিনি বলেছিলেন, দেশি-বিদেশি মিলিয়ে তাঁর বাগানে অন্তত ৩০ প্রজাতির আম আছে।

লাভ ভালো বারোমাসিতে

চুয়াডাঙ্গার আবুল কাশেমের বাগানের যেসব গাছে কাটিমন আম পেকেছে, সেগুলো ৫৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু বাজার থেকে হিমসাগর, ল্যাংড়া, আম্রপালি ও ফজলি বিদায় নেওয়ার পর কাটিমন প্রতি কেজি সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায় বিক্রি হবে।
আবুল কাশেম বলছিলেন, এ বছর ফেব্রুয়ারিতে কাটিমনের ভালো ফলন হয়েছিল। দর পেয়েছিলেন সাড়ে ৩০০ টাকা কেজি।

ছবি: সংগৃহীত

তবে বারোমাসি আমের জাত বাছাই, জমি তৈরি আর ওষুধের ব্যাপারে বিশেষ যত্ন দরকার হয়। বিশেষ করে বিদেশি জাতের বেলায়। শখেও যদি দু-চারটা গাছ লাগাতে চান, বরং নিচের ভিডিওটা দেখে নিন।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক জামাল উদ্দিন বলছেন, কলমের চারা না হলে ভালো ফল দেবে না। হুটহাট চারা না কেনা ভালো। দেশি একাধিক বারোমাসি জাত একবার ফল দিলে পরের বছর দেয় না। বিদেশি বারোমাসি জাতগুলো তেমন কি না, সে গবেষণা এখনই করা দরকার।

শীত-গ্রীষ্মে আমের পুষ্টি

দেশে দেশি-বিদেশি বারোমাসি আমের বাগান হচ্ছে সাত-আট বছর হলো। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন’ নামে একটি প্রকল্প আছে। এ প্রকল্পের লক্ষ্য আমসহ বিভিন্ন ফলের নতুন নতুন জাতের সম্প্রসারণ।

প্রকল্পের পরিচালক মেহেদি মাসুদ বললেন, ‘বছরের যে সময়টায় আম হয় না, সেই সময় আম উৎপাদন করাই এর মূল্য লক্ষ্য। আর আমরা দেখেছি, এটা সম্ভব।’

মৌসুমি নতুন জাতের আবাদও অবশ্য খুব সফল হচ্ছে। যেমন ভারতীয় আম্রপালি আম। বাংলাদেশে এসেছিল ১৯৯৫ সালে। এখন আমের মৌসুমে এককভাবে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে এ জাতের আম, মোট উৎপাদনের ৩০ শতাংশ।

অসময়ের আমের মধ্যে এখন দুটি জাতের বাগান বেশি হচ্ছে। থাই কাটিমন ও বারি-১১। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, এ বছর সাড়ে চার হাজার একর জমিতে বারি-১১ হয়েছে। আর কাটিমন হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার একর জমিতে। পাঁচ বছর আগে দেশে ১ হাজার ৫০০ একরের কিছু কম জমিতে মিয়াজাকি, কাটিমন, বারি-১১সহ সাত জাতের অসময়ের আমবাগান ছিল।

মেহেদি মাসুদ বললেন, ফলের উৎপাদন রাতারাতি বাড়ানো যায় না। এ জাতগুলো আরও ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। এক দশকের মধ্যে এর কোনোটি হয়তো আম্রপালির মতো জনপ্রিয়তা পাবে।
আম উৎপাদন, ভোগ, লক্ষ্যমাত্রা: ইনফো

পাহাড়েও বিদেশি আম

খাগড়াছড়ি শহর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরের আলুটিলা এলাকা। এখানে প্রায় আট একর জমিতে মংসিপ্রু মারমার ফলের বাগান।

আজ থেকে আট বছর আগে ঢাকায় খামারবাড়িতে কৃষিমেলায় এসে সূর্যডিম ও কিউজাই জাতের আমের চারা কেনেন তিনি। একেকটি কিউজাই জাতের আমচারা কিনেছিলেন ১ হাজার ২৫০ টাকায় আর মিয়াজাকি ৭৫০ টাকায়।

কিউজাই থাইল্যান্ডের আমের জাত। অসময়ের এ আমের এবারও চাষ করেছেন। একটি প্রতিষ্ঠান থেকে আমের আগাম অর্ডার পেয়েছেন। কিউজাই বেচবেন প্রত কেজি ৫০০ টাকা এবং সূর্যডিম বেচবেন ৩০০ টাকায়, পাইকারি দরে। সূর্যডিম জাপানের জাত। রং সিঁদুরে লাল। একেকটি আমের ওজন আধা কেজিও হয়।

মিয়াজাকি অ্যাগ্রিকালচারাল ইকোনমিক ফেডারেশনের ওয়েবসাইটে জাপানের সূর্যডিম বা মিয়াজাকিকে বিশ্বের সবচেয়ে দামি আম বলা হয়েছে। জাপানে ২০১৯ সালে এক জোড়া মিয়াজাকির দাম উঠেছিল প্রায় পাঁচ হাজার ডলার, অর্থাৎ চার লাখ টাকার বেশি।

জাপানে গ্রিনহাউস করে বিশেষ ব্যবস্থায় উৎপাদনের জন্যই সূর্যডিমের এত দাম।

বাংলাদেশে সে খরচের বালাই নেই, তাই দামও কমেছে। এ মৌসুমে খাগড়াছড়ির মহালছড়ির আমের চাষি হ্লাশিং মং চৌধুরী এক কেজির দর হাঁকছেন এক হাজার টাকা। ৪ জুন প্রথম আলোর খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি উপজেলার কাঁপামোড়া এলাকায় তাঁর আমের বাগানে যান। বাগানটি ৪০ একর জমিতে, হ্লাশিং মংয়ের হিসাবে গাছ আছে ৬০ প্রজাতির।

তখন হ্লাশিং মং সূর্যডিম আম পাড়তে শুরু করেছেন। তিনি বলেন, এটি সাধারণত মৌসুমের শেষ দিকে হয়। তবে এবার একটু আগে ফল এসেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে মূলত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম বা ইন্দোনেশিয়ার জাতগুলো ভালো ফল দিচ্ছে। খাগড়াছড়ির কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মর্ত্তুজ আলীর মতে, ওই অঞ্চলের সঙ্গে এখানকার মাটির বৈশিষ্ট্য মেলে। তাই জাতগুলো হয়তো এখানে দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে।