‘ইচ্ছেমতো’ নিয়ন্ত্রণের জন্য যত কৌশল

শিক্ষকদের ‘জোরপূর্বক’ এমপিও প্রত্যাহারে সই নেওয়ার অভিযোগ। শিল্প প্রতিমন্ত্রীর মেয়ে ও অধ্যক্ষের নেতৃত্বে ট্রাস্টের অধীনে নেওয়ার উদ্যোগ।

  • মাউশি প্রতি মাসেই এমপিও বাবদ টাকা দিলেও তা পাচ্ছেন না শিক্ষকেরা।

  • তদন্তে নেমেছে সরকারি দুই সংস্থা।

একসময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা কমিটির সভাপতি ছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও বর্তমান শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার। তবে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী সংসদ সদস্যদের পরিচালনা কমিটিতে সরাসরি সভাপতি হওয়ার সুযোগটি রুদ্ধ হওয়ার পর তিনি আর সেই দায়িত্বে নেই। পরে তাঁর পরিবর্তে পরিচালনায় নেতৃত্বে আসেন তাঁর মেয়ে রাশেদা আখতার। আর অধ্যক্ষের দায়িত্বে আছেন ফরহাদ হোসেন।

অভিযোগ উঠেছে, পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত একাধিক ব্যক্তি এবং সরকারি তদন্তে ‘অবৈধ হওয়া’ বর্তমান অধ্যক্ষ মিলে রাজধানীর অন্যতম বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মনিপুর উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ ‘ইচ্ছেমতো’ নিয়ন্ত্রণের পাঁয়তারা চালাচ্ছেন। এ জন্য এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের ‘জোরপূর্বক’ এমপিও (বেতন বাবদ মাসিক সরকারি অনুদান) প্রত্যাহারে সই নেওয়া হয়েছে।

এরপর আবার প্রতিষ্ঠানটিকে একটি ট্রাস্টের অধীনে পরিচালনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য রাশেদা আখতারকে চেয়ারম্যান এবং অধ্যক্ষকে সদস্যসচিব করে ৯ সদস্যের ‘মনিপুর উচ্চমাধ্যমিক ও কলেজ ট্রাস্টি’ বোর্ডের বিষয়ে সরকারের রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মস থেকে রেজিস্ট্রারও করা হয়েছে। তবে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড এর অনুমোদন দেয়নি।

প্রতিষ্ঠানটির অনিয়ম নিয়ে এ মুহূর্তে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড এবং পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ) তদন্ত করছে। এর আগে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) এক তদন্তে প্রমাণিত হয়েছিল, অধ্যক্ষ হিসেবে ফরহাদ হোসেনের নিয়োগ বৈধ নয়। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডও গত বছরের সেপ্টেম্বরে এক চিঠিতে পরিচালনা কমিটিকে জানায়, ফরহাদ হোসেন অধ্যক্ষ হিসেবে বোর্ডে আবেদন করা বিধিসম্মত হয়নি।

এ বিষয়ে পরিচালনার নেতৃত্বে থাকা রাশেদা আখতারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসেবে তিনি গত বছরের নভেম্বরে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডকে এক পত্রে জানান, মনিপুর উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ ২০১৬ সালের জুনে এমপিও প্রত্যাহার করে। এ জন্য এই তারিখের পর থেকে এমপিওর টাকাও গ্রহণ করা হয় না।

এতে আরও বলা হয়, নন এমপিও প্রতিষ্ঠান হওয়ায় জনবলকাঠামো এবং এমপিও নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হওয়ায় ৬০ বছর বয়স হওয়ার পরও পরিচালনা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ফরহাদ হোসেনের (অধ্যক্ষ) চাকরির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।

কয়েকজন শিক্ষক অভিযোগ করে প্রথম আলোকে বলছেন, মূলত প্রতিষ্ঠানটি কয়েকজন ব্যক্তির হাতে জিম্মি হয়ে পড়ছে। প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ ২০১৬ সালে এমপিও প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিলেও সরকার তা গ্রহণ করেনি। সরকারের খাতায় প্রতিষ্ঠানটি এখনো এমপিওভুক্ত। এ জন্য এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন বাবদ প্রতি মাসে বিপুল পরিমাণ টাকা দিচ্ছে সরকার।

মাউশি গত এপ্রিল মাসেও এমপিওভুক্ত ৭১ জন শিক্ষক-কর্মচারীর জন্য বেতন বাবদ ১৪ লাখ ৩৯ হাজারের বেশি টাকা দিয়েছে। এর বাইরে ‘বৈশাখী উৎসব ভাতা’ বাবদ দেওয়া হয়েছে আরও প্রায় তিন লাখ টাকা। কিন্তু এই টাকা পান না শিক্ষক-কর্মচারীরা। কারণ, এমপিওর টাকা যাতে শিক্ষক-কর্মচারীরা তুলতে না পারেন, সে জন্য বেতন বিলে সই করছে না প্রতিষ্ঠানের বর্তমান কর্তৃপক্ষ।

এমপিওর টাকা যায় কোথায়

১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় মনিপুর উচ্চবিদ্যালয়। এখন উচ্চমাধ্যমিকও চালু হয়েছে। মূল ক্যাম্পাসসহ চারটি শাখায় এর কার্যক্রম চলে। শিক্ষার্থী প্রায় ৩৭ হাজার। শিক্ষক আছেন আট শ র বেশি। আর কর্মচারী আছেন পৌনে দুই শর মতো। প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত হয় ১৯৮৩ সালে। তবে সব শিক্ষক–কর্মচারী এমপিওভুক্ত নন।

কলেজের একাধিক শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের টাকা আয় হয়। কিন্তু এমপিওভুক্ত থাকলে সেখানে সরকারের সরাসরি তদারকির সুযোগ থাকে। এ জন্য পরিচালনা কমিটির প্রভাবশালী একাধিক ব্যক্তি ও অধ্যক্ষ মিলে প্রতিষ্ঠানটিকে পুরোপুরি সরকারের নিয়মের বাইরে নেওয়ার জন্য ২০১৬ সাল থেকে প্রক্রিয়া শুরু করেন।

কয়েকজন শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা পরিচালনা কমিটির কাছে কয়েক দফায় বেতনের বকেয়া টাকা উত্তোলনের ব্যবস্থার জন্য আবেদন করেও কোনো ফল পাননি। উপরন্তু করোনাকালে তাঁদের প্রতিষ্ঠান থেকে দেওয়া বেতন ও ভাতা কমানো হয়েছে।

মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক) মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন বলেন, প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত। এ জন্য এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনের সরকারি অংশের (মূল বেতন) টাকা তাঁরা দিচ্ছেন। কিন্তু সেই টাকা শিক্ষকেরা পাচ্ছেন না, এমন তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁদের কেউ জানায়নি। জানালে অবশ্যই এ বিষয়ে বিধি মোতাবেক পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

‘অবৈধ’ অধ্যক্ষই নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায়

অধ্যক্ষ (প্রধান শিক্ষক থেকে অধ্যক্ষ) মো. ফরহাদ হোসেনের বিরুদ্ধে ওঠা অনিয়ম তদন্ত করে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রতিবেদন জমা দেয় মাউশির একটি তদন্ত কমিটি। প্রতিবেদনে বলা হয়, সব কাগজপত্র যাচাই-বাছাই ও সরেজমিন তদন্তের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি মনে করে, ফরহাদ হোসেনের প্রধান শিক্ষক থেকে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ বিধিসম্মত নয়।

কারণ, তাঁর বয়স ৬০ বছর অতিবাহিত হয়েছে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (স্কুল–কলেজ) জনবলকাঠামো ও এমপিও নীতিমালা অনুযায়ী, বয়স ৬০ বছর হওয়ার পর কোনো প্রতিষ্ঠানপ্রধানকে কোনো অবস্থাতেই পুনর্নিয়োগ বা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া যাবে না। এ জন্য নীতিমালা মেনে নতুন অধ্যক্ষ নিয়োগের সুপারিশ করলেও তা মানেনি প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে অধ্যক্ষের সঙ্গে চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।

প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার কথা জানিয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান তপন কুমার সরকার বলেন, তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।