উত্তরাঞ্চলের শিক্ষকদের ওপর মাউশির ‘খড়্গ’

  • মোট বদলি ৪৮৩ জন শিক্ষককে। এর মধ্যে ২৬১ জনকে এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে বদলি।

  • ঢাকায় বছরের পর বছর ধরে থাকা শিক্ষকেরা বহাল তবিয়তে।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি)

এক হাতে ব্যাগ ও আরেক হাতে আবেদনপত্র নিয়ে বিষণ্ন মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক ব্যক্তি। পরিচয় দিয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। বললেন, ঠাকুরগাঁওয়ের একটি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক তিনি। তাঁকে ভোলার একটি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বদলি করা হয়েছে। তাঁর বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ে। স্ত্রী সরকারি চাকরিজীবী, তবে অসুস্থ। এ অবস্থায় তাঁকে প্রায় ৫৫০ কিলোমিটার দূরে বদলি করায় বিপাকে পড়েছেন। এ জন্য এই বদলির আদেশ সংশোধন করে কিছুটা সুবিধাজনক জায়গায় পদায়নের অনুরোধ নিয়ে এসেছেন।

শিক্ষাভবন হিসেবে পরিচিত মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশির) দোতলায় বৃহস্পতিবার দুপুরে মাধ্যমিক শাখার এক কর্মকর্তার দপ্তরের সামনে কথা হয় ওই শিক্ষকের সঙ্গে। সরকারি চাকরি করায় নামটি প্রকাশ করতে চাননি তিনি।

উত্তরাঞ্চলের ১৪৩ শিক্ষককে বান্দরবান, রাঙামাটি, ভোলা, হাতিয়া, বরগুনাসহ দূরে বদলি।

রাজশাহীর সরকারি পিএন গার্লস হাইস্কুলের এক নারী শিক্ষককে বদলি করা হয়েছে রাঙামাটির লংগদু সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে। বগুড়া সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষককে বদলি করা হয়েছে নোয়াখালীর হাতিয়া শহর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে।

শুধু এই তিন শিক্ষকই নন, উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত ১৪৩ জন শিক্ষককে বান্দরবান, রাঙামাটি, ভোলা, নোয়াখালীর হাতিয়া, বরগুনাসহ দুর্গম এলাকায় বদলি করেছে মাউশি। তাঁরা বলছেন, সরকারি চাকরিতে বদলি হতেই পারে। সাধারণত শিক্ষকদের নিজ এলাকার কাছাকাছি পদায়ন করা হয়। কিন্তু এভাবে একযোগে একই অঞ্চলের এত শিক্ষককে দূরের জেলায় বদলি করা অমানবিক। এমন বদলির প্রতিবাদে গতকাল রোববার রাজশাহী নগরের সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টে আন্দোলন করেছে শিক্ষার্থীরা।

উত্তরাঞ্চলের শিক্ষকদের ওপর এমন খড়্গ চালানো হলেও রাজধানীর সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে অসংখ্য শিক্ষক বছরের পর বছর ধরে একই বিদ্যালয়ে চাকরি করছেন। ২০১৭ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) রাজধানীর ২৪টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৫২২ জন শিক্ষককে বদলির সুপারিশ করলেও সেটি এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হয়নি। ওই সময় দুদকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ঢাকা মহানগরের সরকারি স্কুলের অনেক শিক্ষকই ক্লাসে পাঠদানে মনোযোগী নন। তাঁদের অনেকেই প্রাইভেট ও কোচিং–বাণিজ্য করে আসছেন। এর মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অনৈতিক সুবিধা দিয়ে নিজ ফায়দা হাসিল করছেন।

সাধারণত কোনো অভিযোগ থাকলে কখনো কখনো সরকারি চাকরিজীবীদের দূরবর্তী স্থানে বদলি করার উদাহরণ আছে। কিন্তু মাধ্যমিকের ওই শিক্ষকদের বদলি কোনো অভিযোগের ভিত্তিতে করা হয়নি। ফলে এমন বদলি নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে।

এর কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, সম্প্রতি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে ২ হাজার ৬৬ জন শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে আদেশ জারি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু এই নিয়োগ দিতে গিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদেরই জারি করা আগের পরিপত্রের নিয়মকানুন সঠিকভাবে মানেনি। ১৯৯৪ সালে জারি করা ওই পরিপত্রের মূলকথা ছিল, নতুন নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের প্রথমে উপজেলা বা থানা পর্যায়ে নিয়োগ দিতে হবে। এরপর জেলায় নিয়োগ দেওয়া হবে। তবে পদ শূন্য থাকা সাপেক্ষে পুরোনো ও বিভাগীয় শহরেও নিয়োগের সুযোগ আছে।

কিন্তু পরিপত্র পুরোপুরি না মেনে বিপুলসংখ্যক শিক্ষককে বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে নামীদামি স্কুলে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে অনেক বিদ্যালয়ে অনুমোদিত পদের চেয়ে জনবল বেশি হয়ে গেছে। এ কারণে নতুন শিক্ষকদের বেতন-ভাতা পেতে সমস্যা হচ্ছিল। শিক্ষা প্রশাসন এর ‘সহজ সমাধান’ হিসেবে জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের ঢালাওভাবে বদলি করেছে।

শিক্ষা প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তাই বলছেন, নতুন নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের শুরুতে স্থানীয় পর্যায়ের বিদ্যালয়গুলোতে পদায়ন করলে এই সমস্যা হতো না।

মাউশি সূত্রে জানা গেছে, নতুন শিক্ষকদের সুবিধা দেওয়ার জন্য ৮ মার্চ সারা দেশে ৪৮৩ জন শিক্ষককে বদলি করে পরিপত্র জারি করা হয়।

এর মধ্যে ২৬১ শিক্ষককে এক অঞ্চল (মাউশির অধীন মোট ৯টি অঞ্চল) থেকে আরেক অঞ্চলে বদলি করেছে মাউশি। বাকিদের একই অঞ্চলের (বেশ কয়েকটি জেলা নিয়ে একেকটি অঞ্চল) মধ্যে বদলি করা হয়েছে।

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে বদলি করা ২৬১ জনের মধ্যে উত্তরাঞ্চলের অন্তত ৩৪ জনকে বদলি করা হয়েছে পার্বত্য জেলা বান্দরবানে। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন নারী শিক্ষকও রয়েছেন, যাঁদের অনেকের অবসরের বয়স কাছাকাছি চলে এসেছে। এ ছাড়া অন্তত ২৪ জনকে ভোলায়, ১০ জনকে রাঙামাটি, ১৩ জনকে বরগুনায়, ১০ জনকে নোয়াখালীতে (কয়েকজন হাতিয়ায়) বদলি করা হয়েছে। বাকি শিক্ষকদের চাঁদপুর, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, শরীয়তপুর, পিরোজপুরসহ কয়েকটি এলাকায় বদলি করা হয়েছে।

মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক) মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, আপাতত যেসব বিদ্যালয়ে নতুন শিক্ষকদের বেতন নিয়ে সমস্যা হচ্ছিল, সেসব বিদ্যালয়ের অতিরিক্ত শিক্ষকদের বদলি করা হয়েছে। উত্তরাঞ্চলে শিক্ষকদের শূন্য পদ কম। আবার চট্টগ্রাম অঞ্চলে শিক্ষকদের শূন্য পদ বেশি। এ জন্যই এভাবে বদলি করতে হয়েছে। পরের ধাপে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে বেশি দিন থাকা এবং ওই বিদ্যালয়ের অতিরিক্ত শিক্ষকদেরও বদলির বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।

এদিকে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো থেকে শিক্ষকদের দূরদূরান্তে পাঠানো হলেও কোনো কোনো জেলার শিক্ষকদের ঢাকা বা ওই সব জেলার আশপাশে বদলি করা হয়েছে। যেমন, কিশোরগঞ্জ জেলার অন্তত ১০ জন শিক্ষক বদলি হয়েছেন ঢাকার বিভিন্ন বিদ্যালয়ে।

বান্দরবানের থানচিতে বদলি হওয়া বগুড়া জিলা স্কুলের এক নারী শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, চাকরি শেষ পর্যায়ে। এখন তাঁর জন্য এত দূরে যাওয়া অনেক কষ্টকর। তিনি বলেন, নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের শুরুতে নিজ জেলার বড় স্কুলে না দিয়ে একটু দূরের স্কুলগুলোয় পদায়ন করলে এ সমস্যা হতো না। ওই শিক্ষক বলেন, জ্যেষ্ঠ অনেক শিক্ষকই দু–এক বছরের মধ্যে অবসরে যাবেন। তখন পদ শূন্য হলে নতুনদের আবার এসব জায়গায় আনা যেত।