কারিগরি শিক্ষা মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জন্যই হওয়া উচিত: পবন কুমার সরকার

শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর কাছ থেকে দেশসেরা কারিগরি শিক্ষকের পুরস্কার নিচ্ছেন পবন কুমার সরকার। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা
ছবি : খালেদ সরকার

জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ উপলক্ষে নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত কয়েক ধাপের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়ে দেশের শ্রেষ্ঠ শ্রেণিশিক্ষকের পুরস্কার পেয়েছেন দেশের চারজন শিক্ষক। তার মধ্যে কারিগরি শিক্ষায় শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের পুরস্কার পেয়েছেন দিনাজপুরের পার্বতীপুর সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক (ইন্সট্রাক্টর) পবন কুমার সরকার। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর করা পবন কুমার ২০০৪ সালে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষকতায় যোগ দেন। শুরুতে কুষ্টিয়ার একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করলেও ২০১৩ সাল থেকে পার্বতীপুর সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষকতা করছেন। শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের পুরস্কার পাওয়ায় দারুণ খুশি পবন কুমার সরকার কারিগরি শিক্ষাসহ শিক্ষার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিবেদক মোশতাক আহমেদ।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: কারিগরি শিক্ষায় সারা দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ শ্রেণিশিক্ষকের পুরস্কার পাওয়ায় আপনাকে অভিনন্দন। কোন কোন যোগ্যতা বা কী কী কারণে আপনি সব শিক্ষকদের পেছনে ফেলে সেরা হয়েছেন বলে মনে করেন?

পবন কুমার সরকার: প্রথমে জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ উপলক্ষে সারা দেশে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আমাকে কারিগরি শিক্ষায় শ্রেষ্ঠ শ্রেণিশিক্ষক নির্বাচিত করায় ধন্যবাদ জানাই মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরকে (মাউশি)। প্রতিযোগিতার জন্য বেশ কিছু মানদণ্ড ছিল। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল শিক্ষাগত যোগ্যতা, নিয়মিত পাঠদান, ডিজিটাল আধেয় (কনটেন্ট) তৈরি, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক, প্রকাশনা, পাঠ্যপুস্তক থাকা, শুদ্ধাচার কৌশল, সৃজনশীল প্রশ্নপত্র তৈরি ও মূল্যায়ন দক্ষতা, শিক্ষকদের শিক্ষা উপকরণ ব্যবহার ইত্যাদি। এ ধরনের মানদণ্ডের ওপর মোট ১০০ নম্বর ছিল। এসব মানদণ্ডে নির্বাচক কমিটি বা যাঁরা বিচারক ছিলেন, তাঁরা হয়তো আমাকে সর্বোচ্চ নম্বর দেওয়ার জন্য উপযুক্ত মনে করেছেন। আমি ১৯৯৪ সালে প্রথম বিভাগে এসএসসি, ১৯৯৬ সালে প্রথম বিভাগে এইচএসসি পাস করি। এরপর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পশু পালন অনুষদ থেকে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতক (সম্মান) পাস করি এবং একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করি। আমার লেখা দুটি পাঠ্যপুস্তক জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড থেকে প্রকাশিত। এগুলো শিক্ষার্থীদের পাঠদান করানো হয়। এ ছাড়া জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে তিনটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। আমি সব সময় নিয়মিতভাবে পাঠদান সম্পন্ন করি। ডিজিটাল কনটেন্ট ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করে থাকি। সেই সঙ্গে হাতে-কলমে শিক্ষা দিই। ফলে শিক্ষার্থীরাও উপকৃত হচ্ছে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বলা হয় কারিগরি শিক্ষায় পড়লে কর্মসংস্থান সহজ হয়। আপনার শিক্ষার্থীদের কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার চিত্রটি কেমন?

পবন কুমার সরকার: আমাদের এখান থেকে শিক্ষার্থীরা কারিগরির এসএসসি ও এইচএসসি পাস করে বের হয়। দেখা যায় অনেকে নিজেরাই পোলট্রি ফার্ম দিচ্ছে। আবার অনেকে অন্যান্য কর্মসংস্থানে যাচ্ছে। মোটকথা যে ট্রেডে পড়াশোনা করে, সেই ট্রেড সম্পর্কিত পেশার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। অনেকে নিজেরাও ব্যবসাও করছে।

পুরস্কার গ্রহণের পর পবন কুমার সরকার
ছবি: খালেদ সরকার

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনার কথা অনুযায়ী কারিগরি শিক্ষায় কর্মসংস্থানের সুযোগ মিলছে। কিন্তু এখনো আমাদের দেশে একটি সাধারণ প্রবণতা হলো তুলনামূলক পিছিয়ে থাকা পরিবার বা পড়াশোনায় তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থীরা বেশি পরিমাণে কারিগরিতে আসে। অন্যরা আসতে চায় না কেন, তারাও কি আসতে পারে না?

পবন কুমার সরকার: আমি মনে করি এখানে সচেতনতার অভাব আছে। অথচ কারিগরি শিক্ষাটি মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জন্যই হওয়া উচিত। আমাদের এলাকায় চেষ্টা করি, প্রচার-প্রচারণা করি। আমার আশা থাকবে মেধাবী এবং সব পর্যায়ের পরিবারের শিক্ষার্থীরাই যেন কারিগরি শিক্ষায় আসে। তাহলে কারিগরি শিক্ষার যে লক্ষ্য তা বাস্তবায়ন হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারও সচেষ্ট আছে। কারিগরি শিক্ষার্থীরা ৭০ শতাংশ উপবৃত্তি পায়। আমার মনে হয়, সমাজের প্রতিটি স্তরের সচেতন মানুষ, রাজনৈতিক ব্যক্তি, শিক্ষানুরাগী যাঁরা আছেন, তাঁদেরও সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে কারিগরি শিক্ষাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য। জাপান, জার্মানি, সিঙ্গাপুর, কোরিয়ার মতো দেশ কিন্তু কারিগরি শিক্ষায় জোর দিয়ে এগিয়ে গেছে। তবে বাংলাদেশেও পরিস্থিতিটি এখন আগের চেয়ে বদলাচ্ছে। যেমন একটি পরিসংখ্যান দিয়ে বলি, কারিগরিতে আগে ভর্তির হার ছিল ১ থেকে ২ শতাংশ। এখন এই হার ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ। সরকারের লক্ষ্য হলো ২০২৫ সালের মধ্যে এই হার ২৫ শতাংশে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশে উন্নীত করা। এ জন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপও নিচ্ছে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: একটি বিষয় দেখা যায়, বর্তমানে কারিগরি বিশেষ করে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে পাস করার পর শিক্ষার্থীরা দেশে নির্ধারিতসংখ্যক জায়গায় উচ্চশিক্ষার সুযোগ পান। উচ্চশিক্ষায় তাঁদের জন্য সুযোগ অবারিত করা উচিত বলে মনে করেন কি?

পবন কুমার সরকার: কারিগরি শিক্ষায় এটি একটি সীমাবদ্ধতা। এখন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে পাস করে সব জায়গায় ভর্তির সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ (ডুয়েট) নির্ধারিত কিছু জায়গায় ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে। তবে আশার খবর হচ্ছে, আরও বিশ্ববিদ্যালয় এই সুযোগ দিচ্ছে। আশা করব, অচিরেই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সুযোগ তৈরি করবে।

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে পবন কুমার সরকার
ছবি: সংগৃহীত

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: সার্বিকভাবে বললে আমাদের দেশে কোচিং-প্রাইভেটের একটি রমরমা অবস্থা চলছে। এটি কি খুব বেশি দরকার। কারিগরি শিক্ষায় এর প্রয়োজন কতটুকু?

পবন কুমার সরকার: কারিগরি শিক্ষায় কারিগরি সম্পর্কিত বিষয়গুলোতে প্রাইভেট পড়ার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ, এসব বিষয়ে এমনিতেই হাতে-কলমে শিক্ষা দেওয়া হয়।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনি কি প্রাইভেট পড়ান?

পবন কুমার সরকার: আমি কোনো কোচিং-প্রাইভেটের সঙ্গে জড়িত না।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনি সেরা শিক্ষকের পুরস্কার পেয়েছেন। অন্য শিক্ষকদের উদ্দেশে কী বলবেন?

পবন কুমার সরকার: অন্য শিক্ষকদের উদ্দেশে শুধু বলব, কারিগরি শিক্ষার মূল লক্ষ্য হলো ‘একটা লক্ষ্য, হতে হবে দক্ষ’। এ স্লোগানকে সামনে রেখে আমাদের কাজ করতে হবে, এই লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে। জাপান, জার্মানি, সিঙ্গাপুর, কোরিয়ার মতো দেশ কিন্তু কারিগরি শিক্ষায় জোর দিয়েই এগিয়ে গেছে। আমরা আশা করব বাংলাদেশেও কারিগরি শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়ে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা হবে। তবে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত কমাতে হবে। কারিগরি শিক্ষায় ছাত্র ও শিক্ষার্থীর অনুপাত হওয়ার কথা ১২: ১। কিন্তু এটা এখন অনেক বেশি।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: কারিগরি শিক্ষা নিয়ে মানুষের উদ্দেশে কী বলবেন?

পবন কুমার সরকার: কারিগরি শিক্ষা সবার জন্য অবারিত। কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেরও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি সম্ভব, আবার দেশেরও সেবা করার সুযোগ পাওয়া যায়। তাই এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে।