প্রাণিসেবায় গবেষণার আলো

পাঠগ্রহণের পাশাপাশি গবেষণায়ও এগিয়ে আছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ছবি: সৌরভ দাস
পাঠগ্রহণের পাশাপাশি গবেষণায়ও এগিয়ে আছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ছবি: সৌরভ দাস

মূল ফটকের পাশেই প্রাণী হাসপাতাল। তার বারান্দায় শিক্ষার্থীদের জটলা। পরনে সাদা অ্যাপ্রোন। গলায় স্টেথস্কোপ। কেউ ছাগলের শরীর পরীক্ষা করছেন। কেউ ব্যস্ত সদ্য অস্ত্রোপচার হওয়া গরু নিয়ে। আবার একদল গোল হয়ে শুনছেন শিক্ষকের কথা। ২০ এপ্রিল দুপুরে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু) ক্যাম্পাসে গেলে দেখা যায় এ চিত্র। মেডিসিন অনুষদের তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষের ব্যবহারিক ক্লাস চলছিল তখন।
ক্লাস শেষে কথা হয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী এফ এম ইয়াসির হাসিব বলেন, ‘দেশের অন্যতম বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় এটি। তার অংশ প্রাণী হাসপাতাল। এখানে প্রাণীদের অস্ত্রোপচার, টিকাসহ সব ধরনের রোগের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। চট্টগ্রামের আনাচকানাচের খামারি ও চাষিদের প্রাণী চিকিৎসার এটি এখন মূল ভরসা। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, আমাদের এখানে প্রাণীদের জন্য ব্লাড ব্যাংক রয়েছে। প্রয়োজন হলে সেখান থেকে রক্ত দেওয়া হয়।’
আরেক শিক্ষার্থী সাদেকুজ্জামান বলেন, ‘প্রাণীদের চিকিৎসা বেশ জটিল। মানুষ তো সব বলতে পারে। কিন্তু প্রাণীকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে হয়। তাই আমরাও প্রাণীর প্রতি যত্নশীল।’ সাদেকুজ্জামান নরসিংদীর বেলাব উপজেলার বাসিন্দা। ভেটেরিনারি নিয়ে পড়তে এসেছেন চট্টগ্রামে।
এ তো গেল মেডিসিন অনুষদের একটি অংশের কথা। এ ছাড়া অন্য দুটি অনুষদ ফুড সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ও ফিশারিজেরও ধারাবাহিক সাফল্য রয়েছে। প্রতিটি অনুষদ গবেষণা থেকে শুরু করে নানা কার্যক্রমে এগিয়ে রয়েছে অনেকখানি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম আকর্ষণ প্রাণী ও মাছের জাদুঘর।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই প্রাণী হাসপাতাল
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই প্রাণী হাসপাতাল

শুরুর গল্প
১৯৯৬ সালে যাত্রা শুরু হয়েছিল চট্টগ্রাম সরকারি ভেটেরিনারি কলেজ হিসেবে। নগরের খুলশীতে জাকির হোসেন সড়কের পাশে সাড়ে সাত একর জায়গায় গড়ে ওঠে ক্যাম্পাস। তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের অধীনে চলত শিক্ষা কার্যক্রম। ২০০৬ সালের ৭ আগস্ট প্রতিষ্ঠানটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করা হয়। বর্তমানে এখানে তিন অনুষদের ১৮টি বিভাগে শিক্ষার্থী রয়েছেন ১ হাজার ৪১০ জন। পাঠদান করছেন ১১৭ জন শিক্ষক। রয়েছে ৮০৪ আসনের ছাত্র ও ৪২০ আসনের ছাত্রী হল।

মাছের জাদুঘরে...
প্রতিটি তাকে কাচের জারে রকমারি মাছ। তার পাশে রাসায়নিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা আস্ত মাছও রয়েছে। চেনা মাছের সঙ্গে আছে বিচিত্র সব প্রজাতি। মিঠাপানি ও সামুদ্রিক মাছের পাশাপাশি শামুক-ঝিনুক-প্রবাল ও জলজ নানা উদ্ভিদের নমুনাও রয়েছে এতে। প্রশাসনিক ভবনের নিচতলায় ফিশারিজ অনুষদের উদ্যোগে আড়াই হাজার বর্গফুটের চারটি কক্ষ নিয়ে জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এতে সংরক্ষিত আছে ৪২৫ প্রজাতির মাছ। এর মধ্যে সামুদ্রিক ২২৫ ও মিঠাপানির ২০০ প্রজাতির মাছের নমুনা রয়েছে। রয়েছে ৩০ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক-প্রবাল।
ফিশারিজ অনুষদের মেরিন বায়োরিসোর্সেস সায়েন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. আসাদুজ্জামান বলেন, সংগৃহীত প্রজাতির দিক থেকে এটি বাংলাদেশের বড় মাছের জাদুঘর। মৎস্যবিষয়ক গবেষণার জন্য এটি অন্যতম ভান্ডার।
জাদুঘরে কথা হয় দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফেরদৌস আরার সঙ্গে। তাঁর বাড়ি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ বড় পা এলাকায়। তিনি বলেন, ‘ভর্তি হওয়ার আগে ভাবতে পারিনি এত বড় জগতে আসছি। মাছের যে এত রকমফের এখন পড়তে পড়তে জানছি।’

রয়েছে মাছের জাদুঘর
রয়েছে মাছের জাদুঘর

হাতি-কুমির আর অজগর পাশাপাশি!
মাছের জাদুঘরের পাশের ইউসুফ চৌধুরী ভবনের নিচতলায় প্রায় তিন হাজার বর্গফুট জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে অ্যানাটমি জাদুঘর। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদের অ্যানাটমি ও হিস্টলজি বিভাগের উদ্যোগে এ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। জাদুঘরে প্রায় ৬০ প্রজাতির প্রাণীর কঙ্কাল রয়েছে। প্রাণিদেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অবস্থা, গঠন, বৈশিষ্ট্য ও কাজ সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে পাঠদান করার জন্য এ জাদুঘর তৈরি করা হয়েছে বলে জানান শিক্ষকেরা।
জাদুঘরে ঢুকতেই দেখা যাবে সাড়ে ১৩ ফুট লম্বা অজগর সাপের কঙ্কাল। এরপর পাশেই আছে কুমির। আবার সাপ-কুমিরের পাশেই মানুষের কঙ্কাল। এ জাদুঘরের আরেক আকর্ষণ হচ্ছে ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক থেকে সংগ্রহ করা হাতির কঙ্কাল। আছে উট, ঘোড়া, হরিণ, বানর, শূকর, কুকুর, বিড়ালসহ বিভিন্ন পশুপাখির কঙ্কাল।

গবেষণার নানা উদ্যোগ
প্রথমবারের মতো ভেড়ির কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন ও সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক আজিজুন্নেছা। এ পদ্ধতির মাধ্যমে দেশে প্রথমবারের মতো ভেড়ার জন্ম দেওয়া হয়েছে। ২০১৩ সালের জুলাই মাস থেকে বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে। গত চার বছরে কৃত্রিমভাবে ১৮০টি ভেড়ির বাচ্চা প্রসব করানো হয়েছে। অবশ্য কৃত্রিম প্রজননের কাজটি করা হয়েছে ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে। লেপা রোস্কপি আর্টিফিশিয়াল ইনসেমিনেশন (লেপআই পদ্ধতি নামে পরিচিত) পদ্ধতিতে দেশে ভেড়ির বাচ্চা প্রসব করানো হয়। গবেষকেরা মনে করছেন, এই পদ্ধতি মাঠপর্যায়ে বাণিজ্যিকভাবে প্রয়োগ করা হলে দেশে ভেড়ার উৎপাদন বাড়বে।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে গবেষণার নানা কার্যক্রম। ২০০৮ সালে ক্যাম্পাসে প্রতিষ্ঠিত হয় পোলট্রির রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার (পিআরটিসি)। গবাদিপশুর উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে এটি স্থাপন করা হয়েছে। প্রাণী চিকিৎসকদের পাশাপাশি প্রাণিসম্পদ ও খামার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের জন্য এতে স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে।
২০১৫ সাল থেকে চালু হয়েছে ওয়ান হেলথ ইনস্টিটিউট। ইনফ্লুয়েঞ্জা, সোয়াইন ফ্লু, বার্ড ফ্লু, নিপাহ ভাইরাস প্রভৃতি মোকাবিলায় সম্মিলিতভাবে কাজ করছে এই প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ইউএসটিসি), আইসিডিডিআরবি এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় সমন্বিত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে কক্সবাজার সৈকতের দরিয়ানগরে পাঁচ একর জায়গা নিয়ে চালু হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাকেন্দ্র। সেখানে নরম খোলসের কাঁকড়া চাষের একটি গবেষণা প্রকল্পে সাফল্য পাওয়া গেছে। এই ক্যাম্পাসে স্থাপিত হচ্ছে দেশের প্রথম ভেটকি মাছের পোনা উৎপাদনের হ্যাচারি।
অন্য দিকে চট্টগ্রাম শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে হাটহাজারীতে ১০ একর জায়গার ওপর কাজ চলছে খামারভিত্তিক আরেকটি ক্যাম্পাস গড়ার। এতে হাতে-কলমে শিক্ষার পাশাপাশি গবেষণার ক্ষেত্র প্রসারিত হবে বলে মনে করছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া ঢাকার পূর্বাচলেও রয়েছে একটি গবেষণাকেন্দ্র।

পড়ার ফাঁকে আড্ডা-গানে
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালিত হয় শিক্ষার্থীদের সংগঠন সৃজনীর মাধ্যমে। অবশ্য এর সমন্বয় করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক বিবেক চন্দ্র সূত্রধর। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় থাকে সংগঠনের সদস্যরা। নিয়মিত চলে অনুশীলন।
এই সংগঠনের সদস্যদের রয়েছে সাফল্যও। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমন্বিত সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদ আয়োজিত এবারের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় আধুনিক গানে ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদের তাহিয়া আহমেদ দ্বিতীয় ও একক অভিনয়ে তৃতীয় হয়েছেন ফিশারিজ অনুষদের মাহফুজ আলম।
এ ছাড়া রয়েছে সিভাসু ডিবেটিং সোসাইটি, প্রথম আলো বন্ধুসভা ও রক্তদাতাদের সংগঠন বাঁধনের শাখা।

অধ্যাপক ড. গৌতম বুদ্ধ দাশ
অধ্যাপক ড. গৌতম বুদ্ধ দাশ

শিক্ষার্থীরা বিদেশে ইন্টার্নশিপের সুযোগ পাচ্ছে
অধ্যাপক ড. গৌতম বুদ্ধ দাশ
উপাচার্য, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়
আমরা দেশে প্রথমবারের মতো ইউরোপ-আমেরিকার আদলে পিবিএল (প্রবলেম বেইজড লার্নিং) পদ্ধতি চালু করেছি। এর মাধ্যমে বর্তমান শিক্ষার্থীরা যুগের সঙ্গে নিজেদের গড়ে তুলছে। মাঠ পর্যায়ে কর্মরত সাবেক ছাত্রছাত্রীরাও নিজেদের আরও পরিণত করার সুযোগ পাচ্ছেন। গত কয়েক বছরে আন্তর্জাতিক শিক্ষা বিনিময়ের (কোলাবরেশন) ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের টাফ্টস, ওয়াশিংটন স্টেট, মালয়েশিয়ার তেরেঙ্গানু, থাইল্যান্ডের কনখিন এবং ভারতের তামিলনাড়ু ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমইউ) সই হয়েছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শতভাগ শিক্ষার্থী এখন বিদেশে ইন্টার্নশিপের সুযোগ পাচ্ছেন।