বাংলাদেশ সৃষ্টির কৃতিত্বের সিংহভাগের অংশীদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: শতবর্ষের আলোচনায় বক্তারা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষপূর্তি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর আয়োজনের তৃতীয় দিনে আলোচনা পর্ব শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করছেন এক শিল্পী
ছবি: দীপু মালাকার

বাংলাদেশ সৃষ্টির কৃতিত্বের সিংহভাগের অংশীদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এককভাবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান ৫০ ভাগের বেশি।
আজ শুক্রবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষপূর্তি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর আয়োজনের তৃতীয় দিনের আলোচনায় অংশ নিয়ে বক্তারা এসব কথা বলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা তুলে ধরেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে এই আলোচনা সভা হয়।

আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখনো বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বেও নানা সীমাবদ্ধতার কারণে এই বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে জাতির স্বপ্ন পূরণে কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থ হচ্ছে। তাই এখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বরাদ্দসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে দরকার রাষ্ট্রের আন্তরিক মনোযোগ।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত না হলে বোধ হয় পাকিস্তানের সৃষ্টি হতো না। বাঙালিরাই পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিল। ১৯৪৬ সালে যে ভোট হয়েছিল, সেই ভোটের মাধ্যমে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিল। আজকের পাকিস্তান ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান চায়নি, তারা অবিভক্ত ভারতের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল আমাদের ভোটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় না হলে রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠিত হতো না। ভাষা আন্দোলন-পরবর্তী অন্য আন্দোলনগুলোতেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এককভাবে নেতৃত্ব দেয়। কাজেই বাংলাদেশ সৃষ্টির যে আলোকবর্তিকা প্রজ্বলিত হয়েছিল, সেই কৃতিত্বের সিংহভাগের অংশীদার এই বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশের ইতিহাস লিখতে হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এককভাবে ৫০ ভাগের বেশি অবদানের কথা উল্লেখ করতে হবে। তবে কোনো কোনো সময় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্যায়ের পক্ষ কর্তৃপক্ষ হিসেবে ছিল। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কখনোই অন্যায়ের পক্ষে ছিলেন না।

জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতে গবেষণা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ে, একে যাতে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করা যায়—প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে সব সময় অত্যন্ত সচেতন। জীবনযাত্রা ও চাহিদার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে শিক্ষার পরিবেশ পরিবর্তিত হচ্ছে। ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে শিক্ষার ধরনে পরিবর্তন আসছে।

ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘আমাদের লেখাপড়া অবশ্যই জীবনঘনিষ্ঠ ও জীবনমুখী হতে হবে। পাশাপাশি বাস্তবতার নিরীখে কর্মমুখী শিক্ষাকে নিয়ে আসতে হবে। এ জন্য প্রতিনিয়ত গবেষণার প্রয়োজন। গবেষণার মধ্য দিয়ে আগামী দিনেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার শিক্ষার্থীদের দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলবে।’

আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সাংসদ রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষের গৌরবের আমিও একজন অংশীদার। বহু সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার শতবর্ষের অস্তিত্বের মধ্য দিয়ে সংগ্রামের ইতিহাস রচনা করে গেছে। এই অঞ্চলের পশ্চাৎপদ মুসলিম জনগোষ্ঠীকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার লক্ষ্য নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সে কারণেই মুসলিম জাতীয়তাবাদী চিন্তার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রাগ্রসর ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু সেই চিন্তার মধ্যেও এই বিশ্ববিদ্যালয় সাম্প্রদায়িকতায় ভেসে যায়নি। এটি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।’
৫৯ বছর আগে পড়াশোনা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়েছিলেন পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ। শতবর্ষের আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি দেশে শিক্ষা নিয়ে বারবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর সমালোচনা করেন।

খলীকুজ্জামান বলেন, ‘সব পর্যায়ে শিক্ষার মান নিয়ে নানা প্রশ্ন শোনা যায়। বাংলাদেশে শিক্ষা নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে। এটি করতে গিয়ে আমরা কখনো প্রায় পথ হারিয়ে ফেলছি বা সেদিকে যাচ্ছি। প্রতিনিয়তই দেখছি, একটা সিদ্ধান্ত হয় এবং পরে সেটাকে আবার পরিবর্তন করা হয়। ২০১০ সালে প্রণীত শিক্ষানীতি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হয়নি। আবার নাকি নতুন করে শিক্ষানীতি করা হবে! দু-চার বছর পরপর এমন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হলে শিক্ষার্থীদের কী হবে? পরিবর্তন হতেই পারে, কিন্তু মৌলিক বিষয়গুলো অপরিবর্তিত রাখতে হবে। একটি মৌলিক বিষয় শিক্ষার মান, আরেকটি মূল্যবোধ।’

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা
ছবি: প্রথম আলো

আলোচনায় অংশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. রহমত উল্লাহ বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা-সংকটের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বেও অনেক ধরনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাতির স্বপ্ন পুরোপুরি পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। উচ্চশিক্ষা শেষে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতার মতো পেশার চেয়ে আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনের জন্য বেশি প্রস্তুতি নেন।

আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অনারারি অধ্যাপক আতিউর রহমান। তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখনো বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এই আমি হয়তো আমি হতাম না, যদি না আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে পারতাম। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আমাদের ঋণের শেষ নেই। সবাই মিলেই প্রাণের এই বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা আরও উজ্জ্বল করব—এই অঙ্গীকার করার সময় এসেছে।’

আলোচনা সভায় অন্যদের মধ্যে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আনোয়ার হোসেন বক্তব্য দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান ও সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) এ এস এম মাকসুদ কামাল অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। আলোচনা পর্ব শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।