আমার পরিচয়
মূলভাব: হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সমৃদ্ধ বাঙালি জাতিসত্তার কথা বলেছেন সৈয়দ শামসুল হক এ কবিতায়।
অন্যান্য যে ভাব প্রকাশ পেয়েছে:
১. সমৃদ্ধ বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গর্বিত উত্তরাধিকারী
২. বাঙালির বিপ্লবী-বিদ্রোহী সত্তা
৩. বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনা
৪. বাঙালির অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়িক ঐতিহ্য
৫. বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য
৬. বাঙালির ধর্মীয় ঐতিহ্য
সমৃদ্ধ বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গর্বিত উত্তরাধিকারী
আলোচ্য ‘আমার পরিচয়’ কবিতায় কবি দেখিয়েছেন, বাঙালি জাতির রয়েছে হাজার বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য। সুপ্রাচীন সাহিত্যিক নিদর্শন সে ঐতিহ্যের অন্যতম একটি দিক। আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে এ দেশের সাধারণ মানুষের প্রাণময় জীবনচিত্র নিয়ে লিখিত হয়েছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন চর্যাপদ। পাল যুগে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা প্রতীকী ভাষায় এ সাহিত্য রচনা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় মধ্যযুগেও আমরা সমৃদ্ধ সাহিত্যের নিদর্শনের সন্ধান পাই। পূর্ব বাংলার অত্যধিক জনপ্রিয় লোকগাথা ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’, ‘কমলার দীঘি’ ও ‘মহুয়ার পালা’ প্রসঙ্গ এনে কবি দেখিয়েছেন, আমাদের সাহিত্যের ঐতিহ্যের ধারা অব্যাহত রয়েছে। সেই অক্ষুণ্ন ধারা যে আজ আরও সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হয়েছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় কবির ‘গীতাঞ্জলি’ ও ‘অগ্নিবীণা’ শব্দ দুটি চয়ন করা থেকে। অর্থাৎ বাংলার দুই শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের প্রসঙ্গ এনে কবি দেখিয়েছেন, বাংলার সাহিত্যধারা অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল ও সমৃদ্ধ।
বাঙালির বিপ্লবী-বিদ্রোহী সত্তা
বাঙালি জাতি আজন্ম বিপ্লবী, বিদ্রোহী। এখানকার প্রকৃতি, পরিবেশ, আবহাওয়া, জলবায়ু এমনই যে জন্মের পর থেকেই প্রতিটি বাঙালির রক্তধারার মধ্যে বিপ্লবী সত্তা মিশিয়ে দেয়। তাই তো সভ্যতার সেই ঊষালগ্নেই আমরা দেখি সামান্য জেলে সম্প্রদায়ের লোকজন পরম পরাক্রমশালী রাজা মহীপালের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ইতিহাসে যা আজও ‘কৈবর্ত বিদ্রোহ’ নামে খ্যাত। এরপর স্বাধীন জমিদার ঈশা খাঁর নেতৃত্বে অন্য জমিদারেরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে মোগল সম্রাট আকবরের অধীনতা মেনে নিতে অস্বীকার করেন এবং তাঁর শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। বাঙালির এই বিপ্লবী সত্তার পরম প্রকাশ ঘটেছে ইংরেজ শাসনামলে। হাজি শরীয়তুল্লাহ, তিতুমীর, ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন বাংলার প্রমুখ সাহসী সন্তান নিজেদের জীবন বাজি রেখে ইংরেজদের শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে প্রাণপণে লড়াই করেছেন। সেখানেই ক্ষান্ত হয়নি এ ধারা। ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়ে ভাষার মর্যাদা রক্ষা এবং ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে আমাদের উপহার দিয়েছে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।
বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনা/ধর্মীয় ঐতিহ্য
আবহমানকাল ধরে সব ধর্মের, সব বর্ণের, সব শ্রেণির মানুষের জন্মস্থান এ বঙ্গভূমি। জাতি-ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে এক বাঙালি চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এখানকার মানুষ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখেছে সুদীর্ঘকাল ধরে। কবি আলোচ্য কবিতায় তাই বিভিন্ন ধর্মের তীর্থস্থানগুলোর কথা উল্লেখ করে প্রমাণ করেছেন, এখানকার মানুষ কতটা অসাম্প্রদায়িক। তিনি দেখিয়েছেন, এ বাংলায় রয়েছে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের পুণ্যস্থান পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার। তা ছাড়া এখানে আছে হিন্দু সম্প্রদায়ের পুণ্যস্থান বা তীর্থস্থান জোড়বাংলার মন্দির বেদি। আরও আছে মুসলমানদের পবিত্র স্থান বরেন্দ্রভূমির সোনামসজিদ। এসব প্রসঙ্গের অবতারণার মধ্য দিয়ে কবি বাঙালি অসাম্প্রদায়িক চেতনা তুলে ধরেছেন। এই অসাম্প্রদায়িক চেতনার পরম রূপটি প্রকাশ পায় কবি যখন বলেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’
অর্থাৎ যুগ-যুগান্তরের সীমানা পেরিয়ে বাঙালি জাতি-ধর্ম-বর্ণের সংকীর্ণ সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে উঠে মানুষকে ‘মানুষ’ হিসেবে মূল্যায়ন করে এক সম্প্রীতির পরিবেশ তৈরি করেছেন।
বাঙালি জাতির হাজার বছরের পথচলার এটাই মূলমন্ত্র।
বাঙালির অর্থনৈতিক বা ব্যবসায়িক ঐতিহ্য
ব্যবসা-বাণিজ্যের ইতিহাস বাঙালির সুদীর্ঘকালের। প্রাচীনকালে যখন নদীপথই ছিল যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম, সে সময়ও বাঙালি সওদাগরি কারবার করত। অর্থাৎ নৌকার বহরে পণ্যসামগ্রী নিয়ে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় বিক্রি করত। প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী পেয়ে ওই এলাকার মানুষগুলোর মধ্যে খুশির বন্যা বয়ে যেত। চাঁদ সওদাগর বাংলার ইতিহাসে এমনি এক বিখ্যাত ব্যবসায়ী।
বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য
বাঙালি যে কতটা সংস্কৃতিমনা তার পরিচয় পাওয়া যায় পাল যুগের চিত্রকলা থেকে। আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে বাঙালি তার সৌন্দর্যবোধের উৎকর্ষের স্বাক্ষর রেখেছে। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা দেখতে পাই কিংবদন্তিতুল্য দুই চিত্রশিল্পী শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। জগৎ ও জীবনের ছবি এঁকে যাঁরা মানুষের সৌন্দর্য তৃষ্ণা মিটিয়েছেন, অর্থাৎ মানুষের মনে দোলা দিয়েছেন।
একইভাবে বাঙালির আরেক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হলো সংগীতপ্রিয়তা। হাটে-মাঠে-ঘাটে সব জায়গায় মানুষ তার মনের আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করে সুরে ও ছন্দে। যে সুর ও ছন্দ বাংলার মাটি ও মানুষের কথা বলে। অর্থাৎ বাংলার অপরূপ প্রকৃতি এবং বাংলার মানুষের সাদামাটা জীবনের গল্পই উঠে আসে গানে গানে।