সৃজনশীল প্রশ্নোত্তর
প্রিয় শিক্ষার্থী, আজ রসায়ন থেকে সৃজনশীল পদ্ধতির একটি নমুনা প্রশ্নোত্তর আলোচনা করব। এ ধরনের অন্য প্রশ্নোত্তরের জন্য বিষয়বস্তুটি ভালোভাবে পড়বে।
# শ্রেণিকক্ষে সহপাঠীদের মধ্যে বিতর্ক অনুষ্ঠানে লাল দল বলল, ‘পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে কতকগুলো বৃত্তাকার স্থির কক্ষপথে ইলেকট্রনগুলো ঘূর্ণায়মান থাকে।’ কিন্তু সবুজ দলের মতে, ‘সৌরজগতের সূর্যকে কেন্দ্র করে গ্রহগুলোর মতো ধনাত্মক চার্জযুক্ত নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ইলেকট্রন ঘুরতে থাকে।’
ক. ফিটকিরির সংকেতটি লেখো। ১
খ. তেঁতুল দিয়ে পিতলের তৈরি সামগ্রী পরিষ্কারকরণের রসায়ন ব্যাখ্যা করো। ২
গ. উদ্দীপকের লাল দলটির প্রস্তাবনা কোন বিজ্ঞানীর মতামতকে প্রতিফলন করে? কারণসহ ব্যাখ্যা করো।৩
ঘ. পরমাণুর গঠন ব্যাখ্যায় উদ্দীপকের দলদ্বয়ের মতামতের বিশ্লেষণ করো। ৪
উত্তর-ক.
K2SO4.Al2(SO4)3.24H2O
উত্তর-খ.
তামার বা কপারের বর্ণ গোলাপি বা তামাটে। কিছুদিন রেখে দিলে কপারের বর্ণ বাদামি হয়ে যায়। কারণ, এর ওপরে কপার অক্সাইডের আবরণ তৈরি হয়। কিছুদিন পরিষ্কার না করা হলে এগুলোর গায়ে সবুজ বর্ণের তাম্রমলের আবরণ সৃষ্টি হয়। এটি এক প্রকার কপার লবণ। এর উপাদান পরিবেশের ওপর নির্ভর করে। তাম্রমল সাধারণত কপার (II) কার্বনেট এবং কপার (II) হাইড্রোক্সাইডের মিশ্রণ [CuCO3.Cu(OH)2]। তাম্রমল জৈব অ্যাসিডে দ্রবীভূত হয়। তাই জৈব অ্যাসিডসমৃদ্ধ ফল যেমন তেঁতুল দিয়ে পিতলের তৈরি সামগ্রীকে পরিষ্কার করলে তাম্র্রমল দূরীভূত হয়ে সোনালি সৌন্দর্য ফিরে পায়।
উত্তর-গ.
লাল দলটির প্রস্তাবনা পরমাণুর গঠনসম্পর্কিত বিজ্ঞানী নিলস বোরের মতামতকে প্রতিফলন করে। জানি, পরমাণুর গঠনসম্পর্কিত বিজ্ঞানী নিলস বোরের মডেলের স্বীকার্যসমূহ হলো:
# পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে বৃত্তাকার পথে ইলেকট্রনসমূহ ঘুরতে থাকে।
# নিউক্লিয়াসের চারদিকে বৃত্তাকার কতগুলো স্থির কক্ষপথ আছে, যাতে অবস্থান নিয়ে ইলেকট্রনসমূহ ঘুরতে থাকে। এগুলোকে শক্তিস্তর বা অরবিট বলা হয়। শক্তিস্তরসমূহকে কল্পিত সংখ্যা n-এর মান অনুসারে K, L, M, N দ্বারা প্রকাশ করা হয়। প্রথম শক্তিস্তরকে n = 1, (K শক্তিস্তর) দ্বিতীয় শক্তিস্তরকে n = 2 (L শক্তিস্তর) এভাবে n-এর মান 3, 4, 5 ইত্যাদি পূর্ণসংখ্যা মানে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং শক্তিস্তরসমূহকে যথাক্রমে M, N, O দ্বারা প্রকাশ করা হয়। একটি নির্দিষ্ট শক্তিস্তরে অবস্থানকালে ইলেকট্রনসমূহ শক্তি শোষণ অথবা বিকিরণ করে না।
# যখন কোনো ইলেকট্রন একটি নিম্নতর কক্ষপথ বা শক্তিস্তর যেমন n = 1 থেকে উচ্চতর কক্ষপথ n = 2-তে স্থানান্তরিত হয়, তখন নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি শোষণ করে। আবার যখন কোনো উচ্চতর শক্তিস্তর যেমন n = 2 থেকে নিম্নতর কক্ষপথ n = 1-এ স্থানান্তরিত হয়, তখন শক্তি বিকিরণ করে।
পরমাণুর গঠন সম্পর্কিত বিজ্ঞানী নিলস বোরের মডেলের স্বীকার্যসমূহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এই মডেলের সংক্ষিপ্ত রূপ হলো লাল দলের প্রস্তাবনা (পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে কতগুলো বৃত্তাকার স্থির কক্ষপথে ইলেকট্রনগুলো ঘূর্ণায়মান থাকে)।
উত্তর-ঘ.
রাদারফোর্ড আলফা কণা বিচ্ছুরণ পরীক্ষার সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে পরমাণুর গঠন সম্পর্কে একটি মডেল প্রদান করেন, যা সৌর মডেল হিসাবে পরিচিত। এর প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ
# পরমাণুর কেন্দ্রস্থলে একটি ধনাত্মক চার্জবিশিষ্ট ভারী বস্তু বিদ্যমান। এই ভারী বস্তুকে পরমাণুর কেন্দ্র বা নিউক্লিয়াস বলা হয়। পরমাণুর মোট আয়তনের তুলনায় নিউক্লিয়াসের আয়তন অতি নগণ্য। নিউক্লিয়াসে পরমাণুর সব ধনাত্মক চার্জ ও প্রায় সব ভর কেন্দ্রীভূত।
# পরমাণু বিদ্যুত্ নিরপেক্ষ। অতএব নিউক্লিয়াসের ধনাত্মক চার্জযুক্ত প্রোটন সংখ্যার সমানসংখ্যক ঋণাত্মক চার্জযুক্ত ইলেকট্রন পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে পরিবেষ্টিত করে রাখে।
# সৌর জগতের সূর্যের চারদিকে ঘূর্ণায়মান গ্রহসমূহের মতো পরমাণুর ইলেকট্রনগুলো নিউক্লিয়াসের চারদিকে অবিরাম ঘুরছে। ধনাত্মক চার্জবিশিষ্ট নিউক্লিয়াস ও ঋণাত্মক চার্জবিশিষ্ট ইলেকট্রনসমূহের পারস্পরিক স্থির বৈদ্যুতিক আকর্ষণজনিত কেন্দ্রমুখী বল এবং ঘূর্ণায়মান ইলেকট্রনের কেন্দ্র বহির্মুখী বল পরস্পর সমান। দেখা যাচ্ছে পরমাণুতে নিউক্লিয়াসের অবস্থান ও বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যায় শতভাগ সফল হলেও কয়েকটি বিষয়ে এই মতবাদটি ব্যর্থ; যেমন-
# সৌরমণ্ডলের গ্রহসমূহ সামগ্রিকভাবে চার্জবিহীন অথচ ইলেকট্রনসমূহ ঋণাত্মক চার্জযুক্ত।
# ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্বানুসারে কোনো চার্জযুক্ত বস্তু বা কণা কোনো বৃত্তাকার পথে ঘুরতে থাকলে তা ক্রমাগত শক্তি বিকিরণ করবে এবং তার আবর্তন চক্রও ধীরে ধীরে কমতে থাকবে। সুতরাং ইলেকট্রনসমূহ ক্রমেই শক্তি হারাতে হারাতে নিউক্লিয়াসে প্রবেশ করবে। অর্থাত্ রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল অনুসারে পরমাণু সম্পূর্ণভাবে একটি অস্থায়ী অবস্থা প্রাপ্ত হবে। অথচ পরমাণু থেকে ক্রমাগত শক্তি বিকিরণ বা ইলেকট্রনের নিউক্লিয়াসে প্রবেশ কখনোই ঘটে না।
# পরমাণুর বর্ণালি গঠনের কোনো সুষ্ঠু ব্যাখ্যা এ মডেল দিতে পারে না।
# আবর্তনশীল ইলেকট্রনের কক্ষপথের আকার ও আকৃতি সম্বন্ধে কোনো ধারণা রাদারফোর্ডের মডেলে দেওয়া হয়নি।
# একাধিক ইলেকট্রনবিশিষ্ট পরমাণুতে ইলেকট্রনগুলো নিউক্লিয়াসকে কীভাবে পরিক্রমণ করে, তার কোনো উল্লেখ এ মডেলে নেই।
এসব সমস্যা সমাধানে বিজ্ঞানী পরমাণুর গঠন এবং একই সঙ্গে পারমাণবিক বর্ণালি ব্যাখ্যার জন্য নিলস বোর তাঁর বিখ্যাত পরমাণু মডেল প্রকাশ করেন। এ মডেলের স্বীকার্যসমূহ হলো:
# পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে বৃত্তাকার পথে ইলেকট্রনসমূহ ঘুরতে থাকে। নিউক্লিয়াসের চারদিকে বৃত্তাকার কতগুলো স্থির কক্ষপথ আছে, যাতে অবস্থান নিয়ে ইলেকট্রনসমূহ ঘুরতে থাকে। এগুলোকে শক্তিস্তর বা অরবিট বলা হয়। এই নির্দিষ্ট শক্তিস্তরে অবস্থানকালে ইলেকট্রনসমূহ শক্তি শোষণ অথবা বিকিরণ করে না।
# যখন কোনো ইলেকট্রন একটি নিম্নতর কক্ষপথ থেকে উচ্চতর কক্ষপথে স্থানান্তরিত হয়, তখন নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি শোষণ করে। আবার যখন কোনো উচ্চতর শক্তিস্তর থেকে নিম্নতর কক্ষপথে স্থানান্তরিত হয়, তখন শক্তি বিকিরণ করে।
বোর পরমাণু রাদারফোর্ড মডেলের সীমাবদ্ধতা অনেকখানি দূর করেন; কিন্তু কতগুলো ক্ষেত্রে এটিও ত্রুটিযুক্ত; যেমন—
# বোর পরমাণু মডেল হাইড্রোজেন ও হাইড্রোজেনসদৃশ এক ইলেকট্রনবিশিষ্ট আয়ন যেমন আয়নসমূহের বর্ণালি ব্যাখ্যা করতে পারলেও একাধিক ইলেকট্রনবিশিষ্ট পরমাণুসমূহের বর্ণালি ব্যাখ্যা করতে পারে না।
# এক শক্তিস্তর থেকে অপর শক্তিস্তরে ইলেকট্রনের স্থানান্তর ঘটলে, বোর পরমাণু মডেল অনুসারে বর্ণালিতে একটি করে রেখা সৃষ্টি হওয়ার কথা। কিন্তু হাইড্রোজেন ও অন্যান্য পরমাণুসমূহের আয়নের রেখা বর্ণালি অধিকতর সূক্ষ্ম যন্ত্র দ্বারা পরীক্ষণ করলে দেখা যায়, প্রতিটি রেখা কয়েকটি সূক্ষ্ম রেখায় বিভক্ত থাকে।
শিক্ষক, খুলনা জিলা স্কুল অ্যান্ড কলেজ, খুলনা