৫০ বছরে শিক্ষায় অগ্রগতি অনেক

স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ১৬ শতাংশের বেশি। আর ৫০ বছর পর এসে এখন দেশে সাক্ষরতার হার হয়েছে ৭৫ শতাংশের বেশি। এর মানে দেশের চার ভাগের তিন ভাগ মানুষই মোটামুটি পড়তে ও লিখতে পারে। কিন্তু সরকারেরই করা জাতীয় শিক্ষার্থী মূল্যায়নের (এনএসএ) তথ্য বলছে, প্রাথমিক স্তরে এখনো বাংলা ও গণিতে কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা অর্জনের হার সন্তোষজনক নয়। ২০১৫ সালে তৃতীয় শ্রেণিতে বাংলায় দক্ষতা অর্জনের হার ছিল ৬৫ শতাংশ। আর ২০১৫ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে গণিতে কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা অর্জনের হার ১০ শতাংশ।

রাশেদা কে চৌধূরী

অন্যদিকে স্বাধীনতার পর দেশে বিশ্ববিদ্যালয় ছিল মাত্র ছয়টি। আর এখন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে দেশে মোট বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে ১৫৮টি। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে হাতেগোনা কিছুসংখ্যক বাদে বেশির ভাগই ভালোভাবে চলছে না। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউসিজি) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গবেষণার দিক দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বেশ পিছিয়ে। এর মধ্যে ২০২০ সালে দেশের ১০৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২৭টি গবেষণা খাতে কোনো অর্থই ব্যয় করেনি।

৫০ বছর ধরে যে চ্যালেঞ্জ ছিল, সেই চ্যালেঞ্জ এখনো রয়ে গেছে। আর সেটি হলো শিক্ষার মান অর্জন। মানের সংকট এখন দৃশ্যমান। কাজেই এখন মানের দিকে অনেক বেশি দৃষ্টি দিতে হবে।
রাশেদা কে চৌধূরী সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

শুধু সাক্ষরতার হার বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা নয়, স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ভর্তির হার, পাসের হার, ঝরে পড়া রোধ, ছাত্র-ছাত্রীর সমতা, উপবৃত্তি, বছরের শুরুতে বিনা মূল্যে বই তুলে দেওয়া থেকে শুরু করে সংখ্যাগত দিক দিয়ে শিক্ষার অর্জন ও উন্নতি দৃশ্যমান। তবে সংখ্যায় ব্যাপক উন্নতি থাকলেও শিক্ষার মান নিয়ে শিক্ষাবিদদের মধ্যে প্রশ্ন আছে।

এর মধ্যে করোনার ধাক্কায় প্রায় দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় দেশের চার কোটি শিক্ষার্থীর পড়াশোনার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। চার মাস আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর সেই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা শুরু হয়েছিল। কিন্তু করোনার সংক্রমণ আবার বেড়ে যাওয়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ করতে হয়েছে। আপাতত দুই সপ্তাহের জন্য ছুটি ঘোষণা করা হলেও করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে না এলে এই ছুটি আরও বাড়তে পারে। ফলে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি আরও দীর্ঘ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মূল্যায়ন হলো, স্বাধীনতার পর দেশে শিক্ষায় সংখ্যার দিক দিয়ে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। এখন এই অগ্রগতি ধরে রেখে শিক্ষার মানের ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। সরকারও বিষয়টি অনুধাবন করে নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নসহ নানা রকম চেষ্টা করছে। সামনের পৃথিবীতে প্রথাগত শিক্ষা দিয়ে আর চলবে না। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে মাথায় রেখে পুরো শিক্ষাকে যুগোপযোগী করে ঢেলে সাজাতে হবে।

ভর্তি প্রায় শতভাগ

গত ৫০ বছরে দেশের শিক্ষায় সংখ্যার দিক দিয়ে অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইসের) সর্বশেষ প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ এডুকেশন স্ট্যাটিসটিকস, ২০২০’–এ। এই প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ১৯৭২ সালে দেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল ৭ হাজার ৭৯১টি। এগুলোয় শিক্ষার্থী ছিল প্রায় সাড়ে ১৮ লাখ। এখন মাধ্যমিক বিদ্যালয় হয়েছে ২০ হাজার ৮৪৯টি। এগুলোয় শিক্ষার্থী হয়েছে এক কোটির বেশি। ১৯৭২ সালে কলেজ ছিল ৫২৬টি। আর এখন হয়েছে ৪ হাজার ৬৯৯টি। এখন শিক্ষার্থী হয়েছে প্রায় ৪৬ লাখ। এছাড়া েদশে আলিয়া ও দাখিল মাদ্রাসা আছে ৯,৩০৫িট। এগুেলাতে িশক্ষার্থীর সংখ্যা সাড়ে ২৫ লােখর বেিশ।

বিদ্যালয় গমনোপযোগী শতভাগের কাছাকাছি শিক্ষার্থী এখন বিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে। বিপরীতে প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৮ শতাংশে। অথচ ২০০৫ সালেও প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ছিল ৪৭ শতাংশের মতো। মাধ্যমিকেও ঝরে পড়ার হার উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। এখন সারা দেশে সরকারি, বেসরকারি, কিন্ডারগার্টেন ও এনজিও পরিচালিত মিলিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ১ লাখ ৩৩ হাজারের বেশি। এর মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ৬৫ হাজারের বেশি, যার মধ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পর ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ২৬ হাজারের বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারীকরণ করেছে।

দেশে এখন প্রাথমিক স্তরে দুই কোটির বেশি শিক্ষার্থী পড়ে। এর মধ্যে ৫১ শতাংশই ছাত্রী। সরকারি বিদ্যালয়ে এই হার আরও বেশি। ভর্তির দিক দিয়ে মাধ্যমিকের ছাত্রীদের হার আরও বেশি (প্রায় ৫৫ শতাংশ)। সংখ্যা বিচারে কলেজেও ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে সমতা অর্জিত হয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো ছাত্রীরা সংখ্যায় পিছিয়ে। যদিও মেডিকেল শিক্ষায় আবার ছাত্রীরা এগিয়ে আছেন।

এ ছাড়া যেসব উপজেলায় সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ নেই, সেগুলোয় একটি করে বিদ্যালয় ও কলেজ সরকারি হয়েছে। আগে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম হতো। কিন্তু বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে পরীক্ষা নিয়ে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ হওয়ায় সেই অভিযোগ কমেছে। অনলাইনে ভর্তিপ্রক্রিয়া চালু, লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তির সিদ্ধান্তকে শিক্ষায় ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

সিদ্ধান্ত হয়, বাস্তবায়ন হয় না

শিক্ষায় পরীক্ষানির্ভরতা, শেখার চেয়ে ফলের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া, কোচিং-প্রাইভেটনির্ভরতা, শিক্ষকদের এমপিওভুক্তকরণসহ শিক্ষার বিভিন্ন খাতে নানা রকম দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে মানুষের মধ্যে বিস্তর প্রশ্ন আছে।

আবার সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাস্তবায়ন না হওয়ার ঘটনাও অনেক। ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি করার পর এটাকে বড় অর্জন বলা হলেও এক দশক পেরিয়ে গেলেও এই শিক্ষানীতিতে থাকা প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করাসহ শিক্ষানীতির গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। বরং শিক্ষানীতি উপেক্ষা করে জাতীয়ভাবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। শুধু তা–ই নয়, নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রমে দশম শ্রেণির আগপর্যন্ত কোনো পাবলিক পরীক্ষা না রাখার কথা থাকলেও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় উল্টো প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড করে এই পরীক্ষাকে স্থায়ী করতে চাচ্ছে।

নতুন শিক্ষাক্রম করা হলেও সেটিও ঠিকমতো বাস্তবায়ন করতে পারছে না সরকার। আগামী মাসে পরীক্ষামূলকভাবে চালুর কথা থাকলেও প্রাথমিক স্তরে নতুন শিক্ষাক্রম পরীক্ষামূলকভাবে চালু করার জন্য বই-ই প্রণয়ন করতে পারেনি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) প্রাথমিক শাখা। এতে ফেব্রুয়ারিতেও প্রাথমিক স্তরে নতুন শিক্ষাক্রম চালু নিয়ে অনিশ্চয়তা শুরু হয়েছে। ২০০৮ সালে শিক্ষায় সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হলেও শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি না থাকায় সেটিও ঠিকমতো বাস্তবায়িত হচ্ছে না। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের একাধিক তদারক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় অর্ধেক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা পুরোপুরিভাবে সৃজনশীল প্রশ্ন করতে পারেন না।

জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে সমন্বিত শিক্ষা আইন করার কথা থাকলেও আইনের খসড়া নিয়ে ১১ বছর ধরে কেবল আলোচনাই হয়েছে, আইনটি আর হয়নি।

মূল্যায়ন ও পরামর্শ

৫০ বছরে শিক্ষার মূল্যায়ন ও করণীয় বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, ৫০ বছরে বাংলাদেশে যেসব ক্ষেত্রে উন্নয়ন দৃশ্যমান, তার মধ্যে শিক্ষা খাত একটি। প্রাথমিকে প্রায় শতভাগ ভর্তি, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ছেলে-মেয়ের সমতা অর্জনসহ শিক্ষার বেশ কিছু অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। তবে ৫০ বছর ধরে যে চ্যালেঞ্জ ছিল সেই চ্যালেঞ্জ এখনো রয়ে গেছে। আর সেটি হলো শিক্ষার মান অর্জন। মানের সংকট এখন দৃশ্যমান। কাজেই এখন মানের দিকে অনেক বেশি দৃষ্টি দিতে হবে।