সহায়ক বই মুখস্থনির্ভর হলে শাস্তি হওয়া উচিত

অধ্যাপক এম তারিক আহসান
ছবি: প্রথম আলো

দীর্ঘ আলোচনার পর শিক্ষা আইন হতে যাচ্ছে। এতে কোচিং-প্রাইভেটসহ শিক্ষার নানা বিষয় রয়েছে। ইতিমধ্যে এ নিয়ে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা চলছে। শিক্ষা আইনের বিভিন্ন বিষয়বস্তু নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটির সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক এম তারিক আহসান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিবেদক মোশতাক আহমেদ

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: দীর্ঘ প্রায় এক যুগ ধরে আলোচনার পর শিক্ষা আইন হতে যাচ্ছে, ইতিমধ্যে আইনের খসড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তাতে শিক্ষা যে একটি অধিকার, সেটি কেমনভাবে থাকছে বা থাকা উচিত বলে মনে করেন?

এম তারিক আহসান: এটি আনন্দের বিষয় যে এত দিন পরে হলেও শিক্ষা আইনটি হতে যাচ্ছে। এ নিয়ে আমরা অনেকবার পর্যালোচনা করেছি এবং মতামত দিয়েছি। তবে আমি মনে করি, নিয়ন্ত্রণের চেয়ে নাগরিক ও শিক্ষার্থীদের জন্য আইনটি কতটুকু ভূমিকা রাখছে, সেদিকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার। এটির জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলের উচিত হবে শিক্ষা অধিকারের বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে আইনে থাকার ব্যবস্থা করা। একই সঙ্গে আরও কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। তার মধ্যে রয়েছে নতুন শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার বড় সংস্কার হতে যাচ্ছে এবং করোনা মহামারিতে কিছু চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছে। এ বিষয়ে আইনে সুনির্দিষ্ট করণীয় থাকা দরকার।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আপনি করোনা পরিস্থিতিতে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জের কথা বলছিলেন, তো শিক্ষা আইনে কী কী ধরনের বিষয় থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন?

এম তারিক আহসান: আমি শুরুতেই বলেছিলাম করোনা পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে আসলে আমাদের নতুন বিষয় আইনে সংযোজন করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে বলতে চাই, করোনার কারণে পড়াশোনার গতানুগতিক নিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়া হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। দীর্ঘ বন্ধের কারণে করোনার সময়ে শিখনচর্চাগুলো কখনো বাড়িতে হয়েছে, কখনো অনলাইনে, রেডিও-টিভির মাধ্যমে হয়েছে। এই নমনীয় ব্যবস্থার জন্য যা যা করা দরকার, সেগুলো শিক্ষা আইনে থাকা দরকার। একই সঙ্গে এ বিষয়ে নৈতিক বিষয়গুলোও সুস্পষ্টভাবে থাকা দরকার।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: শিক্ষানীতিতে বলা আছে গাইড, নোট, প্রাইভেট টিউশন ও কোচিং প্রভৃতির ফলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণ প্রক্রিয়া ও মান অর্জন বিঘ্নিত হচ্ছে। এ জন্য এগুলো বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে। কিন্তু আমরা যত দূর জানতে পেরেছি, শিক্ষা আইনের খসড়ায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এগুলো রাখা হয়েছে। শিক্ষকেরা নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট ও কোচিং করাতে না পারলেও অন্যদের করানোর সুযোগ পাবেন। আবার গাইড, নোট বন্ধের কথা বলা হলেও সহায়ক বই রাখা হচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?

এম তারিক আহসান: নোট, গাইড, কোচিং, প্রাইভেট ইত্যাদি যদি শিক্ষার্থীকে মুখস্থপ্রবণতা বাড়ানোর জন্য কাজ করে, তাহলে অবশ্যই এগুলো আইনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে এসবের বিরুদ্ধে যে ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, তা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা উচিত। তবে সহায়ক বইয়ের যে ভূমিকা, তার একটি প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন টেস্ট যেমন ভাষাগত টেস্ট ইত্যাদির জন্য বিভিন্ন সহায়ক বই আছে। সেগুলোর উদ্দেশ্য কিন্তু মুখস্থ করানো নয় বা পরীক্ষায় যেসব প্রশ্ন আসবে, তার হুবহু উত্তর শেখানো নয়। বরং শিক্ষার্থীকে কতভাবে পারদর্শী করে তুলতে পারবে, সে রকম কিছু ধারণা দেওয়ার জন্য সহায়ক গ্রন্থ উপকারী। কিন্তু মুখস্থনির্ভর সহায়ক বই যদি হয়, তাহলে শাস্তিমূলক হওয়া উচিত। তাই আমি মনে করি, সহায়ক বই অনুমোদনের জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে (এনসিটিবি) বিশেষভাবে দায়িত্ব দেওয়া উচিত। একই সঙ্গে এসব সহায়ক বই অনুমোদনের ক্ষেত্রে একটি পর্যালোচনামূলক বিশেষজ্ঞ দল রাখা উচিত। যা এসব সহায়ক বই অনুমোদনের আগে সুনির্দিষ্টভাবে পর্যালোচনা করে অনুমোদন দেবে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: তার মানে কি আপনি বলছেন, নোট, গাইড, কোচিং, প্রাইভেট একেবারে বন্ধ করা উচিত। কিন্তু এনসিটিবির অনুমোদন নিয়ে সহায়ক বই থাকতে পারে?

এম তারিক আহসান: অবশ্যই গতানুগতিক নোট, গাইড, কোচিং, প্রাইভেট বন্ধ করা উচিত। তবে এনসিটিবির অনুমোদন নিয়ে সহায়ক বই থাকতে পারে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: বলা হচ্ছে নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী গাইড, নোট, প্রাইভেট টিউশন ও কোচিং প্রয়োজনই হবে না। বাস্তবে কি এটি সম্ভব? কারণ, সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি চালুর সময়েও এমন আশার কথা বলা হয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে আমরা ভিন্ন চিত্র দেখছি। সার্বিকভাবে কী বলবেন?

এম তারিক আহসান: নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় যেভাবে শিখন অভিজ্ঞতাগুলো যাচাই করার কৌশলগুলো বলা আছে, তাতে আগের মতো মুখস্থ করে লিখে দিয়ে আসার সুযোগ নেই। এর ফলে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা চাইলেও মুখস্থ করে কিছু করতে পারবে না। নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শিক্ষার্থী, যা জানল তা প্রয়োগ করে দেখাতে হবে। এই প্রয়োগ করার মাধ্যমেই তার মূল্যায়ন হবে। এতে শিক্ষার্থী মুখস্থনির্ভর প্রস্তুতি করতে পারবে না। ফলে কোচিং-প্রাইভেট এবং গাইড বইয়ের প্রয়োজনীয়তা থাকবে না, প্রয়োজনীয়তা হারিয়ে যাবে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করার কথা বলা হয়েছে, যদিও তা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। যেহেতু প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক, তাই এই বিষয়টি আইনে থাকা দরকার আছে কি?

এম তারিক আহসান: প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করাই উচিত। তবে বাস্তবতার নিরিখে এখন এটি করার মতো প্রস্তুতি নেই। তবে অদূর ভবিষ্যতে এটি করার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে এবং আইনেও তা সংশোধন করে সংযোজন করতে হবে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: অতীত অভিজ্ঞতা বলে, শিক্ষার অনেক সিদ্ধান্তই বাস্তবায়িত হয় না।এখন শিক্ষা আইন হলেও সেটি কতটা বাস্তবায়িত হবে বলে মনে করেন?

এম তারিক আহসান: শিক্ষা আইন যেন কেবল আইন আকারেই পড়ে না থাকে, এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া দরকার। যাঁরা এটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকবেন, তাঁরা কেন, কী দায়িত্ব পালন করবেন এবং না করলে কী হতে পারে, সেই বিষয়গুলো আইনে সুস্পষ্টভাবে থাকা দরকার। যাতে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সহজ হয়। একই সঙ্গে আইনের ধারা-উপধারাগুলোকে মানুষের উপযোগী করে মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য নানা ধরনের সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। সর্বশেষ যেটি বলব, সেটি হলো শিক্ষা আইন যেন শুধু নিয়ন্ত্রণের জন্য না হয়, বরং শিক্ষার্থী ও নাগরিকের অধিকার যেন নিশ্চিত হয়। এ জন্য যা করা দরকার, সেগুলো আইনে থাকা দরকার। এটিই আমাদের প্রত্যাশা। তাহলেই এই আইন বাস্তবায়নযোগ্য হবে।