শিক্ষকেরা মূল্যায়ন বুঝলেও সমস্যা ‘নৈপুণ্য’ অ্যাপে 

৫১ শতাংশ শিক্ষক বলেছেন, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মূল্যায়ন অ্যাপ ‘নৈপুণ্য’-এর মাধ্যমে ফলাফল তৈরি করতে গিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন।

নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়ন নিয়েই এখন বেশি আলোচনা চলছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) করা এক জরিপের তথ্য বলছে, কমবেশি প্রায় সব শিক্ষকই মূল্যায়ন নির্দেশিকাগুলো বুঝতে পারছেন। যদিও অর্ধেকের বেশি শিক্ষক (৫১ শতাংশ) নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মূল্যায়ন অ্যাপ নৈপুণ্যে’-এর মাধ্যমে ফলাফল তৈরি করতে গিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছেন।

নতুন শিক্ষাক্রমের বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকদের ওপর গত জানুয়ারি মাসে পরিচালিত এক অনলাইন জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সাড়ে তিন লাখ শিক্ষকের মধ্যে ২ লাখ ৫৩ হাজার ১৫৯ জন শিক্ষক জরিপে অংশ নিয়েছিলেন। মূলত গত বছর অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বাৎসরিক সামষ্টিক মূল্যায়ন কার্যক্রমের বিষয়ে এই জরিপ করা হয়েছিল। 

পর্যায়ক্রমে ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে (উচ্চমাধ্যমিক) বাস্তবায়িত হবে নতুন শিক্ষাক্রম। নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের বড় অংশ হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিকভাবে (শিখনকালীন)। 

এদিকে নতুন শিক্ষাক্রমের মূল্যায়ন আরও কীভাবে সহজ করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন পদ্ধতি চূড়ান্ত করার সার্বিক কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য ১৪ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। 

 রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, নতুন শিক্ষাক্রম আধুনিক ও যুগোপযোগী। কিন্তু সেটির সঙ্গে তাল মিলিয়ে উপযুক্ত শিক্ষক তৈরি করতে হবে। না হয় সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে।

গত বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। প্রথম বছর প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন এই শিক্ষাক্রম শুরু হয়। আর গত জানুয়ারি শুরু হওয়া নতুন শিক্ষাবর্ষে ওই তিনটি শ্রেণি ছাড়াও নতুন করে দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে চালু হয়েছে এই শিক্ষাক্রম। পর্যায়ক্রমে ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে (উচ্চমাধ্যমিক) বাস্তবায়িত হবে নতুন শিক্ষাক্রম। নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের বড় অংশ হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিকভাবে (শিখনকালীন)। 

মূল্যায়ন বিষয়ে কতটুকু বোঝেন শিক্ষকেরা

জরিপের মাধ্যমে শিক্ষকদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বাৎসরিক সামষ্টিক মূল্যায়ন (বার্ষিক মূল্যায়ন) নির্দেশনা কতটুকু ভালোভাবে বোঝা গেছে। এর জবাবে খুব ভালোভাবে বোঝা গেছে বলেছেন এমন শিক্ষক ২২ দশমিক ৫ শতাংশ। ৩৯ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষক বলেছেন, ভালোভাবে বোঝা গেছে। অর্থাৎ ভালোভাবে বোঝেন ৬১ শতাংশের বেশি শিক্ষক। আর মোটামুটি বুঝতে পারা শিক্ষকের হার ৩৭ দশমিক ৬ শতাংশ। খুব ভালো বুঝেছেন এমন শিক্ষকের হার সবচেয়ে বেশি চট্টগ্রামে। এরপর আছে বরিশাল ও ঢাকা বিভাগে। ভালো বুঝেছেন এমন শিক্ষক বেশি ময়মনসিংহে। তারপর আছেন ঢাকার শিক্ষকেরা। আর মোটামুটি বুঝেছেন এমন শিক্ষকের হার সবচেয়ে বেশি রংপুরে। 

নৈপুণ্য অ্যাপ ব্যবহারের পরিস্থিতি

নতুন মূল্যায়নে ধারাবাহিকভাবে মূল্যায়ন কার্যক্রম হয়। এই কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নৈপুণ্য নামে একটি অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে। মূল্যায়নের তথ্য সংরক্ষণের জন্য অ্যাপটি ব্যবহার করা হয়। নির্ধারিত পদ্ধতিতে শিক্ষকেরাই এই অ্যাপে তথ্য দেন। 

এনসিটিবির জরিপে শিক্ষকদের কাছে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বাৎসরিক সামষ্টিক মূল্যায়ন কীভাবে করছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ৪৩ শতাংশের বেশি শিক্ষক বলেছেন, নৈপুণ্য অ্যাপ ব্যবহার করে মূল্যায়ন করেছেন। আর ১৪ শতাংশ বলেছেন, হাতে-কলমে এই কাজ করেছেন। আর ৪২ শতাংশের মতো শিক্ষক জানিয়েছেন, উভয় মাধ্যমেই এই কাজটি করেছেন। 

ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বাৎসরিক সামষ্টিক মূল্যায়নে চ্যালেঞ্জ কী জানতে চাওয়া হয়েছিল শিক্ষকদের কাছে। তাতে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের কথা বলেছেন পারদর্শিতার সূচকে ইনপুট দেওয়ার বিষয়ে। ৩৩ শতাংশ শিক্ষক এই বিষয়ে চ্যালেঞ্জের কথা বলেছেন। এ ছাড়া একই দিনে একাধিক বিষয়ের মূল্যায়ন কার্যক্রম পরিচালনা করা, ট্রান্সক্রিপ্ট তৈরি, সময় অনুযায়ী কাজ শেষ করা, মূল্যায়নের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণের ব্যয় বহন ও সব শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ করাকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন শিক্ষকেরা। 

খুব ভালো বুঝেছেন এমন শিক্ষকের হার সবচেয়ে বেশি চট্টগ্রামে। এরপর আছে বরিশাল ও ঢাকা বিভাগে। ভালো বুঝেছেন এমন শিক্ষক বেশি ময়মনসিংহে। তারপর আছেন ঢাকার শিক্ষকেরা। আর মোটামুটি বুঝেছেন এমন শিক্ষকের হার সবচেয়ে বেশি রংপুরে। 

শিক্ষকদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল মূল্যায়ন অ্যাপ নৈপুণ্য পরিচালনা করতে গিয়ে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়েছে। এর জবাবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অ্যাপের মাধ্যমে ফলাফল তৈরিতে চ্যালেঞ্জ হয় বলে জানিয়েছেন ৫১ শতাংশ শিক্ষক। আর ২৪ শতাংশ শিক্ষক অভিভাবকদের ‘রিপোর্ট কার্ড’ বোঝাতে চ্যালেঞ্জে পড়েছেন। তবে বাকিদের সমস্যা হয়নি। ১৬ শতাংশ শিক্ষক বলেছেন, শিক্ষার্থীদের রিপোর্ট কার্ড বোঝাতে চ্যালেঞ্জ হয়েছে। এ ছাড়া ট্রান্সক্রিপ্ট তৈরিতে চ্যালেঞ্জের কথা বলেছেন ৩০ শতাংশ শিক্ষক। 

জানা গেছে, রিপোর্ট কার্ডের ভাষা আরও সহজ করার জন্য শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন।

জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটির সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক এম তারিক আহসান প্রথম আলোকে বলেন, নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের শুরুর পর্যায় এটি। এর মধ্যেও ভালো দিক হলো কমবেশি প্রায় সব শিক্ষকই মূল্যায়ন নির্দেশিকাগুলো বুঝতে পারছেন। তবে নৈপুণ্য অ্যাপটি পরে চালু হওয়ায় এ নিয়ে প্রথম দিকে কিছু চ্যালেঞ্জ হচ্ছে। এটি মূল্যায়নের সমস্যা নয়, এটি কারিগরি ত্রুটি। আশা করা যাচ্ছে এই সমস্যাও দ্রুত কেটে যাবে।