বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লাভলী কিনোয়া চাষে সফল, সন্তানকেও পড়াচ্ছেন
দুই বছর আগের ভয়াল বন্যায় পানির তীব্র স্রোতের কারণে ঘরের কোনো মালামালই রক্ষা করতে পারেননি লাভলী বেগম। বন্যার পানিতে ঘরের সঙ্গে ভেসে যায় তাঁদের হাঁস-মুরগিও। যখন চারদিকে অন্ধকার দেখছিলেন, সে সময় তাঁর পাশে এসে দাঁড়ায় লোকাল গভর্নমেন্ট ইনিশিয়েটিভ অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (লজিক) প্রকল্প।
লজিক প্রকল্পটি সুইডেন ও ডেনমার্ক সরকারের আর্থিক সহায়তায়, ইউএনডিপি এবং ইউএনসিডিএফ বাংলাদেশের কারিগরি সহযোগিতায়, স্থানীয় সরকার বিভাগের উদ্যোগে কমিউনিটিভিত্তিক জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজনে স্থানীয় পর্যায়ের অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিকল্পনা ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অর্থায়নের জন্য ২০১৭ সাল থেকে কাজ করছে।
কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার মোহনগঞ্জ ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড মধ্যেরচর এলাকার বাসিন্দা লাভলী বেগম বলেন, ‘গত ১০ বছরে বন্যা ও নদীভাঙনে এখন পর্যন্ত আমার বাড়ি ভেঙেছে ৮ বার। ঘর যখন ভাঙে তখন নতুন করে ঘর মেরামত করতে হয়। কখনো সঞ্চয়ের টাকা, কখনো ধারের টাকা দিয়ে এসব করতে হয়। এরপর আর হাতে কোনো টাকা থাকে না। জীবিকা নির্বাহ কঠিন হয়ে যায়। আবার শুধু স্বামী যা টুকটাক আয় করেন, তাতে সংসার ঠিকভাবে চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। তাই এসব সমস্যা সমাধানে নিজেই কিছু করার চেষ্টা করি।’
লাভলী বলেন, নিজে কী করা যায়, খোঁজ করতে করতে এক প্রতিবেশী শিক্ষক বললেন লজিক প্রকল্পের কথা। ওই প্রকল্প থেকে লাভলীকে জলবায়ু সহনশীল জীবিকায়নের জন্য কিনোয়া চাষের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় ২০২৩ সালে, যা বদলে দেয় তাঁর জীবন। এই প্রকল্পের মাধ্যমে কীভাবে এটি চাষ করতে হয়, যত্ন নিতে হয় এবং ফসল সংগ্রহ করতে হয়, তা হাতে–কলমে দেখানোর পাশাপাশি মাঠে নিয়েও প্রশিক্ষণ দেন লজিকের কর্মকর্তারা। এই প্রশিক্ষণ নেওয়ার প্রথম বছরেই কিনোয়া চাষ করে সফলতা পান লাভলী।
লাভলী বেগম বলেন, ‘লজিক থেকে ট্রেনিং পেয়ে কিনোয়া চাষ শুরু করলে প্রথম দিকে সবাই কটুকথা বলত। এগুলো দিয়ে কিছু হবে না, এগুলো কেউ কিনবে না, এর চেয়ে ভুট্টা চাষ করা ভালো, তখন গ্রামের অনেকেই এমন কথা বলত। এখন গ্রামের অনেক মানুষ আমার কাছে আসে, পরামর্শ নেয় কীভাবে কিনোয়া চাষ করবে।’
২০২৩ সালে লজিক প্রকল্প থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর রৌমারীর মোহনগঞ্জের চরের ৬০ শতাংশ জমি ভাড়া নিয়ে কিনোয়া চাষ করেন লাভলী বেগম। দ্রুত ফলন পান। প্রায় ১২ মণ কিনোয়া হয় তাঁর জমিতে। সেগুলো ১৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে ৬৭ হাজার ২০০ টাকা পান। কিনোয় চাষে তাঁর খরচ হয় মাত্র ১৫ হাজার টাকা।
একই জমিতে ভুট্টা চাষ করলে কষ্ট হতো উল্লেখ করে লাভলী বলেন, ‘ভুট্টার ভালো বীজ চেনা কঠিন। অনেকেই প্রতারিত হয়ে ফসল পাননি। পরে আফসোস করেছেন। আবার ভুট্টার বীজের দামও বেশি। কিছুটা মনোযোগ দিয়ে যত্ন করতে হয়। চুরির আশঙ্কা আছে। ভুট্টা পরিপক্ব হলে খেত থেকে একা তোলা যায় না। আলাদা মজুরিতে লোক নিতে হয়। শুকাতে ও ফসল বিক্রি উপযোগী করতেও বেগ পোহাতে হয়। হিসাব করে দেখেছি, তাতে কিনোয়ার মতো লাভ হয় না। যে জমিতে ভুট্টা চাষে আমার খরচ হতো ৩০ হাজার টাকা, সেখানে অর্ধেক খরচেই কিনোয়া চাষ করেছি। ভুট্টা চাষে লাভ হতো ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। সেখানে কিনোয়া চাষে লাভ হয়েছে ৫০ হাজার টাকার বেশি।’
লাভলী বেগমের ছেলে মাদ্রাসায় পড়ে। কিনোয়া বিক্রির টাকা দিয়ে ছেলের পড়াশোনার খরচ চালাচ্ছেন তিনি। লাভলী বেগম বলেন, ‘কিনোয়া বিক্রির টাকা দিয়ে একটি গরু কিনেছি। যখন কিনোয়ার মৌসুম থাকে না, তখন গরুসহ বিভিন্ন গবাদিপশু পালন করি।’
কিনোয়া সব শস্যের মা হিসেবে পরিচিত। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে দক্ষিণ আমেরিকায় এটির চাষ শুরু হয়েছিল। বর্তমানে এর পুষ্টিগুণের কারণে জনপ্রিয়তা বাড়ছে। কিনোয়া প্রোটিন, ফাইবার, থায়ামিন, কপার, ভিটামিন বি৬-এর ভালো উৎস। বাংলাদেশের বাজারেও ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে কিনোয়া। রৌমারীর মধ্যেরচরে কিনোয়া চাষে লাভলীর সফলতা দেখে গ্রামের আরও অনেকে এখন তাঁর কাছে আসেন কিনোয়া চাষের পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে। লাভলীও আগ্রহ নিয়ে তাঁদের শেখান। এভাবে নদীভাঙন আর মঙ্গায় জর্জরিত মধ্যেরচরে নতুন দিনের স্বপ্ন বুনছেন লাভলী বেগম।