ক্যানটিনে ভাতের পরিমাণ কম, দাম বেশি, তরকারির মূল্যও বেশি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের পাঁচ হলের নানা সমস্যার কথা তুলে ধরে মানববন্ধন করেন এসব হলের কিছু শিক্ষার্থী
ছবি: তানভীর আহম্মদ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের জন্য থাকা পাঁচটি আবাসিক হলে নিম্নমানের খাবার, পর্যাপ্ত সুপেয় পানির ব্যবস্থা না থাকাসহ নানা সমস্যা এবং বৈষম্যমূলক ও অদ্ভুত সব নিয়মের কথা জানিয়েছেন আবাসিক ছাত্রীদের একটি অংশ। এসব সমস্যা-সংকট সমাধানে ছয় দফা দাবি জানিয়ে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে তিন দিনের সময় বেঁধে (আলটিমেটাম) দিয়েছেন তাঁরা। এই সময়ের মধ্যে দাবি বাস্তবায়নে পদক্ষেপ না নেওয়া হলে অনশন কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ছাত্রীরা।

আজ রোববার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে এক মানববন্ধন থেকে এই হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীবৃন্দের’ ব্যানারে আয়োজিত এই মানববন্ধনে বিভিন্ন হলের ছাত্রীরা অংশ নেন। তাঁদের ছয় দফা দাবি হলো—অনাবাসিক ও এক হলের ছাত্রীদের অন্য হলে ঢোকার ব্যবস্থা করা; খাবারের মান বৃদ্ধি ও প্রয়োজনীয় নজরদারির ব্যবস্থা করা; পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানির ফিল্টার স্থাপন করা; হলের কর্মচারীদের দৌরাত্ম্য কমানো এবং ছাত্রীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া; হলে ফার্মেসি স্থাপন ও কোনো ছাত্রী রাতে অসুস্থ হয়ে পড়লে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা; এবং অগ্রিম আবেদন ছাড়া নাম এন্ট্রির মাধ্যমে রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ‘লেট গেট’ দিয়ে ঢোকার ব্যবস্থা করা।

মানববন্ধনের অন্যতম আয়োজক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত শামসুন নাহার হলের আবাসিক ছাত্রী ও ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতা আশরেফা তাসনীম বলেন, ‘সারা দিন ক্লাস-টিউশন করে হলে গিয়ে আমাদের রান্না করতে হয়। কারণ, হলের খাবার খুবই নিম্নমানের। ক্যানটিনে ভাতের পরিমাণ কম, দাম বেশি, তরকারির দামও বেশি। একটা টিউশন করে কত টাকা পাওয়া যায়? ক্যাম্পাসে রিকশাভাড়া অনেক।’

আশরেফা তাসনীম বলেন, রাত দুইটার পর হলের পাঠকক্ষ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর হলের প্রতিটি ভবনের ফটক লাগিয়ে দেওয়া হয়। এক ভবন থেকে অন্য ভবনে যাওয়া যাবে না। ছাত্রীদের একেকটা ভবনে আটকে রেখে তাঁরা আসলে কোন নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চান, জানি না। ভূমিকম্প, আগুন বা অন্য কোনো বিপদ হলে তখন কী হবে?

ছাত্রীদের হলের নানা সমস্যার কথা উল্লেখ করে আশরেফা বলেন, ‘হলে ন্যূনতম প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। আমরা ভাত খেতে পারব না, পানি পান করতে পারব না, ওষুধটাও পাব না—আমরা কীভাবে থাকব? আমরা কি মানুষ নই? প্রশাসনিক চাপ থাকবে, বিভাগে ঠিকমতো ক্লাস-পরীক্ষা হবে না, তার ওপর ক্যারিয়ারের চাপ—আমরা অসুস্থ হয়ে যাই। এখানে মনোচিকিৎসকের ব্যবস্থা নেই, কিন্তু আত্মহত্যা রোধে সিলিং ফ্যান ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

আশরেফা বলেন, শামসুন নাহার হলে পাঁচ তাকের ওয়ার্ডরোব রাখতে দেওয়া হয় না। রোকেয়া হলে ওয়ার্ডরোবই রাখা যায় না। একেকটা হল হচ্ছে সার্কাস, আলাদা আলাদা রকমের সার্কাস। একেক হলে একেক রকম নিয়ম। জরুরি কিছু থাকলে হল প্রশাসনের কাছে অগ্রিম আবেদন করতে হয়, নইলে ১০টার পরে হলে ঢোকা যায় না। এখন কেউ যদি দুর্ঘটনায় পড়েন, তিনি কীভাবে তা অগ্রিম জানবেন?

ছাত্রীদের হলগুলোতে সুপেয় পানির সংকটের একটি চিত্র তুলে ধরেন আশরেফা তাসনীম। তিনি বলেন, ‘শামসুন নাহার হলের তিনটি ভবনে তিনটি বৈদ্যুতিক ফিল্টার আছে। পানির জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় আর ফিল্টারে যে পানি আসে, তা বোতলে রাখলে দুই দিনে বোতল লাল হয়ে যায় এবং বালু আসে। পানি কিনে খেতে হয়। পাঁচ লিটার পানি কিনতে গেলে ৭০ টাকা লাগে। প্রতিদিন ৭০ টাকার পানি আর ৬০ টাকার ভাত কিনব? ভাত আর পানি খেয়েই থাকব তাহলে?’

আশরেফা তাসনীম বলেন, ‘রোকেয়া হলে সবচেয়ে বেশি নারী শিক্ষার্থী থাকেন। সেখানে চারটি ফিল্টার আছে, যার দুটি সারা বছর নষ্ট থাকে। অন্য দুটি ফিল্টারে যে পানি আসে, তা এতই সামান্য যে পানি নিতে গেলে এক-দেড় ঘণ্টা লেগে যায়। বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলে দুটি ফিল্টার আছে। দুটি ফিল্টার দিয়ে কীভাবে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ শিক্ষার্থীর পানির ব্যবস্থা হয়, বুঝলাম না। কবি সুফিয়া কামাল হলে ৬টি ফিল্টার থাকলেও পানির যথাযথ ব্যবস্থা নেই। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে প্রায় দেড় হাজার ছাত্রীর জন্য দুটি ফিল্টার আছে।’

ছয় দফা দাবি বাস্তবায়নে তিন দিনের মধ্যে প্রশাসনের কার্যকর উদ্যোগ দেখতে চান আশরেফা। তিনি আরও বলেন, ‘দাবি আদায়ে আগামীকাল সোমবার আমরা উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপি দেব। তিন দিনের মধ্যে দাবি বাস্তবায়নে কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া হলে আমরা অনশনে বসব, অন্তত আমি একা হলেও বসব।’

প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিভাগে তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত কবি সুফিয়া কামাল হলের আবাসিক ছাত্রী ও ছাত্র ফেডারেশনের নেতা উমামা ফাতেমা বলেন, ‘সারা দিন ক্লাস-ল্যাব করে হলে গিয়ে আমরা একটু ভালো খাবার ও ভালোভাবে থাকার আশা করি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে হলে গিয়ে দুমুঠো ভালো খাবারের নিশ্চয়তা থাকে না। হলের খাবারে যথেষ্ট ক্যালরি থাকে না। খাবারের দাম যেভাবে বাড়ানো হচ্ছে, মানটা সেভাবেই খারাপ হচ্ছে।’

রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী ও ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতা নুসরাত তাবাসসুম বলেন, ‘আমরা প্রশাসনকে তিন দিন সময় দিচ্ছি। এই সময়ের মধ্যে আমাদের ছয় দফা দাবি বাস্তবায়নে কাজ শুরু না হলে এবং শিক্ষার্থীদের দাবি নিয়ে প্রশাসন কথা বলতে রাজি না হলে আমরা আবার কর্মসূচি দেব। প্রয়োজনে আমরা অনশনেও বসে যেতে পারি।’

মানববন্ধনে অন্যদের মধ্যে শামসুন নাহার হলের ছাত্রী উম্মে সাদিয়া প্রাপ্তি ও বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলের ছাত্রী রাফিয়া রেহনুমা বক্তব্য দেন।