প্রাথমিক শিক্ষকদের টানা আন্দোলনে বার্ষিক পরীক্ষার ওপর প্রভাব পড়ার শঙ্কা

শিক্ষকদের আন্দোলনের কারণে পাঠদান বন্ধ। তাই শিক্ষার্থীদের কেউ শ্রেণিকক্ষে গল্প করছে, আবার কেউ ঘুমাচ্ছে। আজ সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কুমিল্লা নগরের ছোটরা এলাকার মালেকা মমতাজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।ছবি: প্রথম আলো

সহকারী শিক্ষকদের বেতন দশম গ্রেডে উন্নীত করাসহ তিন দফা দাবিতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তিন দিন ধরে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন। এর পাশাপাশি অনেক বিদ্যালয়ে গতকাল রোববার থেকে অর্থাৎ দুই দিন ধরে কর্মবিরতিও চলছে।

শিক্ষকদের টানা আন্দোলনের কারণে শিক্ষাবর্ষের শেষ সময়ে এসে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। এর ফলে আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে শুরু হতে যাওয়া বার্ষিক পরীক্ষার ওপর প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন শিক্ষকেরা।

বর্তমানে সারা দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ৬৫ হাজার ৫৬৯টি। এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী এক কোটির বেশি এবং শিক্ষক রয়েছেন পৌনে চার লাখের বেশি। এর মধ্যে সহকারী শিক্ষকের অনুমোদিত পদ ৩ লাখ ৬৯ হাজার ২১৬ টি, কিন্তু বর্তমানে কর্মরত ৩ লাখ ৫২ হাজার ২০৮ জন। ১৭ হাজার ৮টি পদ এখনো শূন্য।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর লালবাগ শিক্ষা এলাকার অধীন একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন প্রধানশিক্ষক আজ সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, আগে দেখা যেত এ ধরনের কর্মবিরতি সব বিদ্যালয়ে খুব একটা পালন করা হতো না। কিন্তু এবার তা ব্যতিক্রম। যেমন, লালবাগ শিক্ষা এলাকার অধিকাংশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকেরা কর্মবিরতি পালন করছেন। অন্য সময় শিক্ষা কর্মকর্তারা এসব বিষয়ে কঠোর থাকলেও এবার সেটাও খুব একটা দেখা যাচ্ছে না।

এই প্রধান শিক্ষক আরও জানান, আজ তাঁদের বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা এসেছিল। কিন্তু সহকারী শিক্ষকেরা ক্লাস নেননি। ফলে তিনিই কিছু পড়িয়েছেন। বার্ষিক পরীক্ষার আগে আর অল্পদিন ক্লাস হওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু ইতিমধ্যে দুই দিন ধরে কর্মবিরতি চলেছে। এভাবে চলতে থাকলে বার্ষিক পরীক্ষার ওপর প্রভাব পড়বে।

আজ দুপুর ১২টার কিছু আগে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে দেখা যায় সারা দেশ থেকে আসা অসংখ্য শিক্ষক অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের বিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনার ওপর এর প্রভাব পড়েছে।

আরও পড়ুন

শহীদ মিনারে কথা হয় একজন নারী শিক্ষকের সঙ্গে। তিনি টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার একটি বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। বললেন তিনি সহকারী শিক্ষক, কিন্তু প্রশাসনিক প্রয়োজনে ২০১৮ সাল থেকে তিনি প্রধান শিক্ষকের চলতি দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁদের বিদ্যালয়ে চারজন শিক্ষকের সবাই কর্মবিরতিতে আছেন। তবে সবাই শহীদ মিনারে আসেননি। দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত এখানেই থাকবেন।

এই শিক্ষক বললেন ‘বাচ্চাদের পড়ালেখার ক্ষতি হচ্ছে, এটা আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক। আমরা এটা করতে চাই না। আমরা দ্রুত বিদ্যালয়ে ফিরতে চাই। আমরা চাই রাষ্ট্র আমাদের দ্রুত বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করুক।’

জামালপুরের মেলান্দহ থেকে আসা আরেকজন সহকারী শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, গত শনিবার থেকে আন্দোলনে আছেন। পরবর্তী সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন।

আন্দোলন চলার মধ্যে গতকাল রোববার সন্ধ্যায় সচিবালয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষকদের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু তাহের মো. মাসুদ রানাসহ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

বৈঠকে উপস্থিত একাধিক শিক্ষক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা শিক্ষকদের বেতন গ্রেড বৃদ্ধির বিষয়ে কাজ করছে। এ জন্য সময় চাওয়া হয়। আন্দোলন প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়। তবে শিক্ষকেরা তা মানেননি।

তবে আলোচনার সুবিধার্থে প্রথমে বিদ্যালয়ে কর্মবিরতি স্থগিতের ঘোষণা দেওয়া হলেও সাধারণ শিক্ষকেরা তাতে আপত্তি জানান। তাঁরা তা মানেননি।

আজ সোমবার বিকেলে অর্থ বিভাগের সচিবের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। এই বৈঠকের পর শিক্ষকেরা পরবর্তী পদক্ষেপ জানাবেন।

শিক্ষকদের অপর দুটি দাবি হলো শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতি এবং চাকরির ১০ ও ১৬ বছর পূর্তিতে উচ্চতর গ্রেড দেওয়া। তিন দফা দাবিতে তাঁরা গত শনিবার থেকে কর্মসূচি পালন করছেন। কর্মসূচির প্রথম দিনে গত শনিবার শাহবাগে শিক্ষকদের ওপর পুলিশ হামলা করেছেন। এর ফলে সারা দেশে শিক্ষকেরা বেশি ক্ষুব্ধ হয়েছেন।

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকেরা বর্তমানে জাতীয় বেতন স্কেলের ১৩ তম গ্রেডে বেতন পান। প্রধান শিক্ষকেরা আছেন ১১ তম গ্রেডে। সম্প্রতি দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে ৪৫ জন প্রধান শিক্ষকের বেতন গ্রেড এক ধাপ বাড়িয়ে দশম গ্রেডে উন্নীত করা হয়েছে, যা সারা দেশের সব প্রধান শিক্ষকের জন্যও প্রযোজ্য হতে যাচ্ছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সহকারী শিক্ষকদের বেতন ১১ তম গ্রেডে উন্নীত করার বিষয়েও পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় গত ৪ নভেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো প্রস্তাবে আন্দোলন পরিস্থিতি এবং শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনার বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। তার আগে একই ধরনের প্রস্তাব পাঠানো হয় অর্থ বিভাগে।

জাতীয় বেতন স্কেলে দশম গ্রেডে শুরুর মূল বেতন ১৬ হাজার টাকা, ১১ তম গ্রেডে ১২ হাজার ৫০০ টাকা এবং ১৩ তম গ্রেডে ১১ হাজার টাকা। এর সঙ্গে বাড়িভাড়াসহ অন্যান্য ভাতা যোগ হয়।