শিক্ষার্থীদের ভর্তিযুদ্ধ ও কিছু প্রাসঙ্গিক কথা

গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা শেষে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে আসছেন শিক্ষার্থীরা। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
ফাইল ছবি

মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সারা দেশেই ভর্তি কার্যক্রম চলছে। সব অভিভাবকই চান, তাঁদের সন্তানেরা কাঙ্ক্ষিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হোক। কিন্তু এটা অনেকের ক্ষেত্রে বিভিন্ন কারণেই সম্ভব হয়ে ওঠে না। ফলে এ সময়ে সন্তানদের ভর্তি নিয়ে দারুণভাবে উদ্বিগ্ন থাকেন অভিভাবকেরা। থাকারই তো কথা। প্রত্যেকেই তো চান, তাঁর সন্তান সবচেয়ে ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হোক। কিন্তু দেশে এ ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতাটা অনেক বেশি। তাঁর ওপর গত বছর থেকে ভর্তি কার্যক্রম চলছে লটারির মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে যোগ্যতা নয়, বরং ভাগ্যের ওপরই নির্ভর করতে হয় সবাইকে। তাই ভর্তির জন্য লটারির ফলাফল যখন প্রকাশিত হয়, তখন কাঙ্ক্ষিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে না পেরে অনেকেই আশাহত হন। কেউ কেউ যতটুকু মন খারাপ করার কথা, তার চেয়ে অনেক বেশি মন খারাপ করেন, যা কোনোমতেই কাম্য নয়।

বর্তমানে শিক্ষার্থীদের জন্মতারিখ একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয়। বলা যায়, এটি এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। অভিভাবকেরা জন্মতারিখ নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন। জন্মতারিখ সর্বনিম্ন কত হলে ভর্তি হওয়া যাবে, জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া যাবে, ভবিষ্যতে চাকরি পেতে কোনো সমস্যা হবে না, এসব ভেবে জন্মসনদে নিজদের ইচ্ছামতো জন্মতারিখটি সেট করার চেষ্টা করেন। তাই ভর্তির পূর্বে জন্মতারিখ সংশোধনের হিড়িক পড়ে যায়। ফলে সন্তানের আসল জন্মতারিখটির কোনো অস্তিত্ব থাকে না। ইচ্ছাকৃতভাবে সন্তানের ওপর একটা মিথ্যা/ভুল জন্মতারিখ চাপিয়ে দেওয়া হয়। আর পরবর্তীকালে এ জন্মতারিখ ব্যবহার করেই চাকরি করে রিজিকের ব্যবস্থা হয়। এ জন্মতারিখ দিয়েই অত্যন্ত উৎসাহ–উদ্দীপনা নিয়ে একটা ভুল দিনে জন্মদিন পালন করা হয়, যা কোনোমতেই কাম্য নয়। অথচ আমাদের সময় জন্মতারিখ নিয়ে কেউ মাথা ঘামাতেনই না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় অথবা নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশনের সময় শ্রেণিশিক্ষকেরাই অনুমান করে একটি জন্মতারিখ বসিয়ে দিতেন। আমার যতদূর মনে পড়ে, আমার ক্ষেত্রে এমনটিই হয়েছে। কথাটি যে শুধু আমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তা–ই নয়। আমার বন্ধুবান্ধব বা সমসাময়িক সময়ের প্রায় সবার ক্ষেত্রেই (একেবারেই অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া) একই অবস্থা হওয়ার কথা। আর তাতে যে কারও কোনো অসুবিধা হয়েছে, এমনটি নয়। আর বর্তমানে অযথাই একটা বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করে আমরা অহেতুক টেনশনে ভুগছি। আর জেনেশুনেই একটা অন্যায়কে প্রশ্রয় দিচ্ছি।

একটা কথা ভেবে আমি আশ্চর্য হই। আমরা অভিভাবকেরা যদি আমাদের সন্তানদের প্রকৃত পথের সন্ধান দেওয়ার চেষ্টা না করি, তবে তারা জীবনসংগ্রামে জয়ী হওয়ার জ্বালানি সংগ্রহ করবে কোথা থেকে? আমাদের সন্তানদের সব দিক থেকেই সুস্থ প্রতিযোগী হিসেবে গড়ে তোলা জরুরি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আমরা তাদের মাথায় ভুল ধারণা ঢুকিয়ে দিই। যেমন আমাদের দেশে আমরা মা-বাবারা সন্তানদের আগেই এমন ধারণা দিই যে অমুক বিদ্যালয়ে ভর্তি হতেই হবে। আর কোনো কারণে যদি সে সেই বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারে, তবে আমরা তো মন খারাপ করিই পাশাপাশি আমাদের সন্তানেরাও এ পরিস্থিতিতে অনেক ক্ষেত্রেই মানসিকভাবে একেবারেই ভেঙে পড়ে। আমি এমন অনেক শিক্ষার্থীকে দেখেছি, যারা কাঙ্ক্ষিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে না পেরে পড়াশোনার উৎসাহই হারিয়ে ফেলে। তখন আমরা শত চেষ্টা করেও আর তাদের পড়াশোনার সুস্থ-স্বাভাবিক মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে পারি না।

সারাদেশে চলছে এইচএসসি পরীক্ষা
ফাইল ছবি

২০২১ সালের ভর্তির সময় আমি দেখেছি, শুধু সরকারি বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য নেত্রকোনা, আটপাড়া, বারহাট্টা, কেন্দুয়াসহ অনেক দূরের এলাকা থেকে শিক্ষার্থী আমাদের মোহনগঞ্জ পাইলট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। তাদের এলাকায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খারাপ, এমনটা কিন্তু নয়। এই শিক্ষার্থীরা এখন অনেক কষ্টের মধ্যে আছে। শিক্ষার্থীরা তো কষ্ট করছেই, তাদের নিয়ে আসেন তাদের অভিভাবকেরা। তাঁদেরও অনেক কষ্ট হচ্ছে, সময়ও নষ্ট হচ্ছে। অথচ তাঁরা যদি তাঁদের সন্তানদের তাঁদের বাড়ির কাছের কোনো বেসরকারি বিদ্যালয়ে ভর্তি করতেন, তবে তাঁদের সময় বেঁচে যত, অর্থ বেঁচে যেতো, সর্বোপরি তাঁদের কষ্টও কমে যেত। আর এতে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় সময়টা অনেকটাই বেড়ে যেতে। মজার বিষয় হলো এ সহজ কথাটি কাউকে শত চেষ্টা করেও বোঝানো যাবে না।

শ্রমজীবীর ছেলে মো. মুস্তাকীম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী

অথচ আমাদের সন্তানদের সামনে অনেক উৎসাহব্যঞ্জক উদাহরণ তুলে ধরার অনেক সুযোগ আছে। যেমন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় এবার প্রথম হয়েছে এক শ্রমজীবীর ছেলে মো. মুস্তাকীম। যে পড়াশোনার পাশাপাশি তার কাঠমিস্ত্রি বাবার সহযোগী হিসেবে কাজ করে। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ইউনিটের ও গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় বাংলাদেশের নামীদামি অনেক কলেজের হাজারো শিক্ষার্থীকে পেছনে ফেলে প্রথম হয়েছে মাদ্রাসার দুজন শিক্ষার্থী। অধ্যবসায়ের মাধ্যমে বিজয়ী এসব উদাহরণ আমাদের সন্তানদের সামনে আমরা তুলে ধরি না। বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হওয়া মিফতাহুল আলম সিয়াম কিন্তু ঢাকার কোনো নামীদামি কলেজের শিক্ষার্থী ছিল না। সে তার এলাকার কলেজ থেকেই এইচএসসি পাস করেছে। সে নিজেই বলেছে যে প্রত্যেকের মধ্যেই থাকে সুপ্ত প্রতিভা, যাকে অধ্যবসায়ের মাধ্যমে প্রস্ফুটিত করতে হয়। আর এ কাজ করতে পেরেই সে আজ দেশসেরা শিক্ষার্থীর স্বীকৃতি পেয়েছে। আমরা এসব উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিতে চাই না। আমাদের সন্তানদের সামনে এসব উদাহরণ তুলে ধরে তাদের অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করি না। আমরা সফলতার শর্টকাট পথ খুঁজে বেড়াই, যা কোনোমতেই ঠিক নয়।

আর একটা কাজ আমরা করি, যেটা কোনোমতেই কাম্য নয়। শিক্ষার্থীদের গ্রুপ (বিজ্ঞান, মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষা ইত্যাদি) নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোনো বিচার-বিবেচনা ছাড়াই আমাদের সন্তানদের ওপর একটা গ্রুপ চাপিয়ে দিই। আমরা অভিভাবকেরা প্রায় সবাই চাই যে আমাদের সন্তানেরা চিকিৎসক/প্রকৌশলী হোক। তাই ভাবি, বিজ্ঞান বিভাগে তাদের পড়তেই হবে। তাদের বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার যোগ্যতা আছে কি না, তা ভাবিই না। ফলে অনেকেই বিজ্ঞান বিভাগে পড়তে গিয়ে ফলাফল খারাপ করে। তখন উচ্চশিক্ষা নেওয়ার জন্য ভালো কোনো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ারই সুযোগ থাকে না। অথচ মোটামুটি ভালো ফলাফল করে মানবিক বিভাগ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার অনেক সহজ সুযোগ থাকে। তখন তাঁর জন্য প্রশাসনসহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্যাডার/বিভাগে চাকরি পাওয়ার সুযোগ থাকে। উন্নত দেশগুলোতে মেধা অনুযায়ী গ্রুপ নির্বাচনের ব্যবস্থা থাকে। আর আমাদের দেশে এ বিষয় এখনো অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের খেয়ালখুশির ওপর নির্ভর করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গ্রুপ নির্বাচনে ভুলটা হয়ে যায়। আর এর খেসারত দিতে হয় শিক্ষার্থীকেই। এর ফল হয় অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী।

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা পরিদর্শন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. মতিয়ার রহমান হাওলাদারের নেতৃত্বে শিক্ষক ও কর্মকর্তারা।
ছবি: সংগৃহীত

আমি সহকারী শিক্ষক থাকা অবস্থায় দীর্ঘদিন নবম শ্রেণির শ্রেণিশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছি। তখন আমি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বহুবার বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে মেধা অনুযায়ী গ্রুপ নির্বাচন করা উচিত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমি বেশির ভাগ সময়ই সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছি। কেন্দুয়া জয়হরি সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালনের সময়ও বিষয়টি বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি। আমার বর্তমান কর্মস্থলেও একই অবস্থা। প্রায় সবাই চিকিৎসক/প্রকৌশলী হতে চায়। কেউ প্রশাসন বা অন্য কোনো বিভাগে চাকরি করার কথা ভাবেও না। তাই বিজ্ঞান বিভাগে পড়তেই হবে, এমন একটা জেদ নিয়ে পড়ে থাকে। কিন্তু আমার কিছু মেধাবী শিক্ষার্থী, যারা মানবিক বিভাগে পড়েছে, তারা খুব সহজেই ঢাকা বা অন্য কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছে এবং পরবর্তীকালে বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়ে প্রশাসন, পুলিশ ও অন্যান্য ক্যাডারে চাকরি করছে এবং খুব ভালো অবস্থানে আছে। আর মোটামুটি মেধাবী শিক্ষার্থীদের অনেকেই বিজ্ঞান বিভাগে পড়ে মেডিকেল, বুয়েট, ঢাকা বা অন্য কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না পেয়ে খুব মন খারাপ করেছে, এমন অনেককেই আমি দেখেছি। তবে বিজ্ঞান বিভাগে পড়া যাবে না, এমন কথা কিন্তু আমি বলছি না। যারা গণিত-বিজ্ঞানে ভালো, তারা অবশ্যই বিজ্ঞান বিভাগে পড়বে। আমাদের মেধাবী চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানী অবশ্যই দরকার। কিন্তু বিজ্ঞান বিভাগে পড়তেই হবে, অন্য বিভাগে পড়লে সব রসাতলে যাবে, এমন চিন্তা করা আর শিক্ষার্থীকে এমন ধারণা দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

আমি নেত্রকোনায় সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার থাকার সময় একবার বিজ্ঞান কুইজে অংশ নেওয়ার জন্য শহরের বিভিন্ন বিদ্যালয়ের কিছু মেধাবী শিক্ষার্থী নিয়ে জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে যাই। তখন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ছিলেন আনোয়ার হোসেন আকন্দ। অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আন্তরিক পরিবেশে কিছুক্ষণ কথা বলেন। এ সময় তিনি শিক্ষার্থীদের কাছে তাদের জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে জানতে চান। তাদের অধিকাংশই বলে যে তারা চিকিৎসক হতে চায়। কেউ কেউ বলে যে তারা প্রকৌশলী হতে চায়। একজনও প্রশাসক বা অন্য কোনো পেশার কথা বলেনি। আমার যতদূর ধারণা হয়েছিল, এতে আনোয়ার হোসেন আকন্দের মনটা কিছুটা খারাপই হয়েছিল।

আর একটা উদাহরণ দিই। ২০১৯ সালে মোহনগঞ্জ পাইলট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর কিছু শিক্ষার্থীকে নিয়ে বিদ্যালয়ের সে সময়ের প্রধান শিক্ষক, আমি ও কয়েকজন শিক্ষক ‘বঙ্গবন্ধুকে জানো, মুক্তিযুদ্ধকে জানো’ শিরোনামের একটা ভিডিও তৈরি করার উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তৎকালীন সচিব সাজ্জাদুল হাসানের মোহনগঞ্জের বাসায় যাই তাঁর একটা সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য। আমরা যাওয়ার পর খুব ব্যস্ততা সত্ত্বেও স্যার আমাদেরসহ শিক্ষার্থীদের তাঁর বাসার একটা নিরিবিলি কক্ষে নিয়ে যান। সাক্ষাৎকার দেওয়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তিনি আন্তরিক পরিবেশে কিছু কথাও বলেন। আমাদের বিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি। বিদ্যালয়টাকে তিনি এখনো খুব ভালোবাসেন। মোহনগঞ্জে এসে বিদ্যালয়টিকে না দেখে চলে গেছেন, এমন ঘটনা আমি অন্তত দেখিনি। আমার বিশ্বাস, এ বিদ্যালয়ের কাউকে দেখলেই হয়তো তাঁকে নস্টালজিয়ায় পেয়ে বসে। যা হোক একপর্যায়ে তিনি শিক্ষার্থীদের কাছে তাদের জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে জানতে চান। তাঁদের কেউ চিকিৎসক, কেউবা প্রকৌশলী হবে বলে জানায়। কেউ প্রশাসক বা অন্য কিছু হবে, এমনটা বলেনি। আমি জানি না, এতে স্যারের মন খারাপ হয়েছিল কি না। তবে আমরা কিছুটা বিব্রতই হয়েছিলাম। কারণ, স্যার শুধু মোহনগঞ্জেই নয়, বরং সারা বাংলাদেশেই ঈর্ষণীয় একজন ব্যক্তিত্ব। অথচ স্যারের মতো হওয়ার লক্ষ্য কারও নেই! এই হলো আমাদের শিক্ষার্থীদের চিন্তাচেতনার অবস্থা। আমরাই তাদের মাথায় এ রকম চিন্তাচেতনা ঢুকিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আমাদের সমাজে যে আরও সুন্দর সুন্দর পেশা আছে, তা আমরা নিজেরাও বুঝতে চাই না, আমাদের সন্তানদেরও বোঝাতে চাই না। তাদের আমরা একটা বৃত্তের মধ্যে আটকে রাখছি। এর বাইরেও যে একটা অনেক বড় জগৎ আছে, তার সন্ধান আমাদের সন্তানদের কে দেবে? আমার যে শিক্ষার্থীরা পত্রিকার বড় সাংবাদিক, টেলিভিশনের নামকরা প্রতিবেদক, যাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সত্যকে তুলে ধরছেন, দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চষে বেড়িয়ে দেশের অজানা ও সুন্দর সুন্দর তথ্য তুলে ধরছেন, দেশের গৌরবের বিষয়গুলোকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরছেন, তাঁদের জন্য গর্বে আমার বুকটা ভরে যায়। অনেক সময় আবেগে আমার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে। তাঁরা চিকিৎসক/প্রকৌশলীর চেয়ে কম কিসে? এমন আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে। এসব উদাহরণ আমরা আমাদের সন্তানদের সামনে তুলে তাদের স্বপ্নবাজ করে তুলি না কেন?

আমি আমার এমন শিক্ষার্থীর কথা জানি, যে চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়তে চায়নি। কিন্তু ওর চিকিৎসক মা–বাবা ওকে জোর করে মেডিকেলে ভর্তি করেছেন। সে ভর্তি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু পড়াশোনায় খুবই অমনোযোগী হয়ে পড়েছে। জানি না সে কোর্সটা শেষ করে তার পেশায় সফল হতে পারবে কি না। মহান আল্লাহ তাআলা যেন তাকে সাহায্য করেন। সে যেন তার মা-বাবার আশা পূর্ণ করতে পারে।

জীবন কুসুমাস্তীর্ণ নয়। এ কথা অত্যন্ত পুরোনো, কিন্তু একেবারেই নির্ভেজাল সত্য কথা। সর্বকালের সেরা মানব আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) যে কত প্রতিকূলতা পেরিয়ে মহান আল্লাহ তাআলার রহমতে চূড়ান্ত সফলতা অর্জন করেছিলেন, তা সবার জানা। বিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিস বা প্লেটোর জীবনের সফলতার পেছনেও কাজ করেছে আজীবন অধ্যবসায় ও সংগ্রাম। আমাদের বঙ্গবন্ধুর সফলতার পেছনেও আছে শুধু সংগ্রাম আর লড়াকু মানসিকতা। তাহলে আমাদের সন্তানেরা শর্টকাট পথে সফলতা পেয়ে যাবে, এমনটা আশা করি কেন? আমাদের উচিত বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে ভাবা। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রতিভার যে সুপ্ত আগুন রয়েছে, অনুপ্রেরণা আর সহযোগিতা দিয়ে সেটা জ্বালিয়ে দেওয়াই আমাদের মূল কাজ হওয়া উচিত।

একটি কথা মনে রাখা ভালো। মহান আল্লাহ তাআলাই জানেন, আমাদের সন্তানেরা ভবিষ্যতে কোন অবস্থায় থাকবে। জন্মতারিখ পরিবর্তন করে, জোর করে গ্রুপ বা পেশা চাপিয়ে দিয়ে, টিউটরের পর টিউটরের বোঝা তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে, নামীদামি বিদ্যালয়ে ভর্তি হতেই হবে—এমন ধারণায় তাদের ভারাক্রান্ত করে তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারব, এমন ধারণা যেন আমরা কখনো না করি। বরং ইচ্ছাকৃতভাবে এটা করতে গিয়ে আমরা আমাদের সন্তানদের সমস্যার পাহাড়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছি। বরং এটা না করে আমাদের উচিত আমাদের সন্তানদের সত্যিকারের মানুষ করে গড়ে তোলার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করা। আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে তাদের নিয়তি নির্ধারণ করার ক্ষমতা আমাদের নেই। আমরা শুধু তাদের সফলতার জন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা করে যেতে পারি। আর ভাগ্যের শেষটা নির্ধারণ করার ক্ষমতা একমাত্র মহান আল্লাহ তাআলারই আছে। তাঁর ওপর বিশ্বাস রেখে সব ধরনের ছলচাতুরী বাদ দিয়ে সঠিক পথে আমাদের সন্তানদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা উচিত। আন্তরিক চেষ্টা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে সফলতা আসবেই ইনশা আল্লাহ। মহান আল্লাহ তাআলা আমাদের ও আমাদের সন্তানদের সহায় হোন। আমিন।

*লেখক: মো. মোতাহার হোসেন, প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত), মোহনগঞ্জ পাইলট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়, মোহনগঞ্জ, নেত্রকোনা