জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স প্রথম বর্ষের নতুন সিলেবাসে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি(আইসিটি) অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্তটি সময়োপযোগী ও দূরদর্শী একটি পদক্ষেপ। বর্তমান যুগকে বলা হয় ‘প্রযুক্তির যুগ’। শিক্ষা, গবেষণা, কর্মক্ষেত্র ও দৈনন্দিন জীবনে প্রযুক্তির ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। ডিজিটাল যুগে শিক্ষার্থীদের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা তাঁদের আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে সাহায্য করবে। তবে শিক্ষক ও ল্যাবরেটরির সীমাবদ্ধতা শিক্ষার্থীদের কার্যকর প্রশিক্ষণ গ্রহণে কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। তারপরও একজন শিক্ষার্থীকে ভবিষ্যতে সফল হওয়ার জন্য প্রযুক্তির ‘মৌলিক জ্ঞান’ থাকা জরুরি।
১. কেন এই সংযোজন জরুরি
বর্তমানে সরকারি–বেসরকারি সব ক্ষেত্রেই কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। চাকরির বাজার থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবন পর্যন্ত সব জায়গায় আইসিটির জ্ঞান এখন একটি মৌলিক প্রয়োজন। এই পরিস্থিতিতে অনার্স প্রথম বর্ষ থেকেই শিক্ষার্থীদের আইসিটি সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হলে তাঁরা শিক্ষাজীবনের শুরুতেই একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করতে পারবেন। আইসিটি জ্ঞান বর্তমানে যেকোনো চাকরির জন্য একটি আবশ্যকীয় যোগ্যতা বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। নতুন সিলেবাসে আইসিটি বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় শিক্ষার্থীরা অনার্স শেষ করার আগেই প্রযুক্তিনির্ভর কাজ করার জন্য ‘নিজেকে প্রস্তুত’ করে তুলতে পারবেন। আধুনিক গবেষণা ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সফটওয়্যার ও অনলাইন টুল ব্যবহার করা হয়। প্রথম বর্ষ থেকেই আইসিটি শেখা থাকলে শিক্ষার্থীরা তাঁদের উচ্চতর পড়াশোনায় এই টুলগুলো সহজে ব্যবহার করে নিজেকে ও নিজের বিষয়কে যুগোপযোগী করে তুলতে পারবেন। এটি শিক্ষার্থীদের শুধু কম্পিউটার চালানো শেখাবে না; বরং ডিজিটাল সাক্ষরতা, অনলাইন নিরাপত্তা ও তথ্য ব্যবস্থাপনার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও ধারণাসহ যোগ্য করে গড়ে তুলতে সহায়তা করবে।
২. শিক্ষার্থীদের জন্য গুরুত্ব
আইসিটি শিক্ষা কেবল একটি বিষয় নয়; বরং আধুনিক শিক্ষার জন্য অপরিহার্য। শিক্ষার্থী শুরু থেকেই প্রযুক্তিনির্ভর পড়াশোনায় অভ্যস্ত হবেন। ডিজিটাল দক্ষতা বৃদ্ধি, কম্পিউটার, সফটওয়্যার ও অনলাইন টুলের ব্যবহার শেখা, গবেষণা ও অ্যাসাইনমেন্টে সহায়তা, প্রজেক্ট, প্রেজেন্টেশন ও অন্যান্য শিক্ষামূলক কার্যক্রমে কার্যকর ভূমিকা রাখবেন। চাকরি ও উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতি, প্রাথমিক কম্পিউটার স্কিল এখন প্রতিযোগিতামূলক কর্মজীবনের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা। এখন আইসিটি বিষয়ে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে। অনলাইন রিসোর্স ও অনুশীলনের সুযোগ থাকলে শিক্ষার্থীরা নিজেই শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে নিজের দক্ষতা বাড়াতে পারেন। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার জানা থাকলে শিক্ষার্থীরা দৈনন্দিন জীবনে অনেক কাজ সহজে করতে পারেন, যা তাঁদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। ভবিষ্যৎ কর্মজীবনে আরও অনেক অগ্রগতির সুযোগ অর্জন করবেন।
৩. সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ
যদিও আইসিটি বিষয়টির গুরুত্ব অপরিসীম, তবে কলেজ পর্যায়ে কিছু সাধারণ সীমাবদ্ধতা রয়েছে—
ক. শিক্ষক সীমিত: সব কলেজে প্রশিক্ষিত আইসিটি শিক্ষক পাওয়া সহজলভ্য নয়। সব কলেজে প্রশিক্ষিত আইসিটি শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে।
খ. ল্যাব ও সরঞ্জামের অভাব: যথাযথ ল্যাব না থাকায় ব্যবহারিক শিক্ষা অনেক সীমিত অবস্থায় আছে, তা দূর করতে হবে।
গ. অবকাঠামোগত ও অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা: কম্পিউটার, সফটওয়্যার ও ইন্টারনেট সংযোগ সীমিত থাকার কারণে ব্যবহারও কম, এটা বাড়াতে হবে।
ঘ. শিক্ষার্থীর প্রস্তুতি ও আগ্রহের ভিন্নতা: সব শিক্ষার্থী সমানভাবে আইসিটি বিষয়ে আগ্রহী না–ও হতে পারেন। কিন্তু নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের কেন আইসিটি বিষয় অনেক দরকারি, তা সঠিকভাবে বোঝাতে হবে।
৪. সমাধানের উপায়
যেকোনো ‘নতুন সিলেবাস’ চালু করার সময় কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। এ ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব, অনেক কলেজের পুরোনো অবকাঠামো ও শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় কম্পিউটার ল্যাবের অপ্রতুলতা কিছু সম্ভাব্য সমস্যা হতে পারে। তবে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার জন্য যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করা সম্ভব। আইসিটি শিক্ষাকে কার্যকর করার জন্য কিছু সাধারণ সুপারিশ—প্রতিটি কলেজে কার্যকর ল্যাব স্থাপন, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও নিয়মিত কর্মশালা আয়োজন, সরকারি–বেসরকারি অংশীদারত্বে ল্যাব ও সরঞ্জাম উন্নয়ন, অনলাইন লার্নিং প্ল্যাটফর্মকে পাঠ্যক্রমে সংযুক্ত করা, শিক্ষার্থীদের নিজে নিজে শিক্ষার জন্য অনলাইন ভিডিও, কোর্স ও টিউটোরিয়াল ব্যবহারে উত্সাহিত করা। এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করলে শিক্ষার্থীরা আইসিটি বিষয়ে প্রাথমিক দক্ষতা অর্জন করতে পারবেন এবং ডিজিটাল যুগে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকবেন।
৫. খুলে দেবে নতুন দিগন্ত
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজে আইসিটি শিক্ষার সংযোজন একটি সময়োপযোগী উদ্যোগ। আইসিটি বিষয়ে সীমাবদ্ধতা থাকলেও এটি শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল দক্ষতা বৃদ্ধি করবে। ভবিষ্যতের কর্মজীবনে তাঁদের আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তুলবে। ডিজিটাল যুগে এটি শুধু একটি বিষয় নয়, এটি শিক্ষার্থীদের আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে সমন্বিত করে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করছে। সঠিক প্রশিক্ষণ, ল্যাব–সুবিধা ও আধুনিক শিক্ষার সুবিধা নিশ্চিত করলে এই সংযোজন শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন দিগন্ত খুলে দেবে।
*লেখক: মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন, সহকারী অধ্যাপক, সিদ্ধেশ্বরী কলেজ, ঢাকা