মেয়েদের শিক্ষায় কুমুদিনী মেডিকেল

চলছে ক্লাস
চলছে ক্লাস

দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার মায়ের নাম ছিল কুমুদিনী দেবী। মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি মাকে হারান। গর্ভবতী মায়ের চিকিৎসার জন্য সারা গ্রাম খুঁজেও তখন একজন চিকিৎসক পাননি। আর কাউকে যেন বিনা চিকিৎসায় না মরতে হয়, তাই ১৯৪৪ সালে রণদা প্রসাদ নিজ গ্রামে মায়ের নামে প্রতিষ্ঠা করেন কুমুদিনী হাসপাতাল। আর ২০০১ সালে রণদা প্রসাদ সাহার নাতি রাজীব প্রসাদ সাহার হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় কুমুদিনী উইমেন্স মেডিকেল কলেজ।

ঢাকা থেকে ৭০ কিলোমিটার উত্তরে টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর উপজেলায়, লৌহজং নদীর পাশেই কলেজটির অবস্থান। কয়েক দিন আগে ক্যাম্পাসে পা রেখেই চোখে পড়ল হাসপাতাল ও কলেজের প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিশিষ্টজনের ছোট ছোট ছবি দিয়ে তৈরি রণদা প্রসাদ সাহার একটি প্রতিকৃতি।

সবুজে ঘেরা চারপাশ, পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, সাজানো-গোছানো, নিরিবিলি পরিবেশ দেখলে যে কাউকেই মুগ্ধ করবে। একই সীমানার ভেতরে হাসপাতাল আর কলেজ ক্যাম্পাস। একটি ওভারব্রিজের মাধ্যমে কলেজ আর হাসপাতাল যুক্ত করা হয়েছে।

মেয়েদের পড়ালেখার জন্য নিরাপদ পরিবেশ আছে এই মেডিকেল কলেজে। ছবি: সাগরিকা বিশ্বাস
মেয়েদের পড়ালেখার জন্য নিরাপদ পরিবেশ আছে এই মেডিকেল কলেজে। ছবি: সাগরিকা বিশ্বাস

ক্যাম্পাসের নিচতলায় প্রশাসন বিভাগ। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সম্পূর্ণ আবাসিক এই কলেজে এমবিবিএস ও বিডিএস কোর্সে এখন দেশি-বিদেশি বিভিন্ন বর্ষে ৬৩৩ জন শিক্ষার্থী পড়ছেন। বিদেশি শিক্ষার্থী আছেন ১৬০ জন। এর মধ্যে নেপালের ৪০ জন ও ভারতের ১২০ জন শিক্ষার্থী। বিডিএসে পড়ছেন ৪৮ জন।

মূল ভবনের নিচতলা ও দোতলায় শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যাধুনিক চারটি লেকচার গ্যালারি। ক্যাম্পাস থেকে অল্প দূরে মেয়েদের থাকার জন্য আছে জয়া, বিজয়া, অমিয় বালা ও অরনিমা নামে চারটি হোস্টেল। আরও একটি ভবন নির্মাণাধীন। বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে আলাদা হোস্টেল ও ডাইনিং সুবিধা। কুমুদিনী হাসপাতাল ও কলেজ ক্যাম্পাসের ভেতরেই চোখে পড়বে একটি বড় পুকুর। অবসরে এই পুকুরপাড়েই শিক্ষার্থীদের আড্ডা জমে।

শিক্ষার্থী–কর্মীদের ছোট ছোট ছবি দিয়ে তৈরি রণদা প্রসাদ সাহার প্রতিকৃতি
শিক্ষার্থী–কর্মীদের ছোট ছোট ছবি দিয়ে তৈরি রণদা প্রসাদ সাহার প্রতিকৃতি

ক্লাসের ফাঁকে কলেজের পড়াশোনা, পরিবেশ, নিরাপত্তা, ক্যাম্পাস জীবন—নানা বিষয়ে কথা হলো শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন শাহপার নাহরীর। ঢাকার হলিক্রস থেকে পাস করে এখানে ভর্তি হয়েছেন তিনি। প্রশ্ন করেছিলাম, কুমুদিনী কলেজেই কেন ভর্তি হলেন? বললেন, ‘রণদা প্রসাদ সাহার প্রতিষ্ঠিত মেয়েদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভারতেশ্বরী হোমসের ছাত্রী ছিলেন আমার মা। তাই এখানকার পরিবেশ সম্পর্কে মায়ের কাছেই শুনেছি। ভর্তি হয়ে বুঝলাম, কলেজটা সত্যিই মেয়েদের জন্য খুবই ভালো। খুব সুন্দর পরিবেশও। ক্লাসে কোনো সমস্যা হলে শিক্ষকেরা খুব সাহায্য করেন।’

দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান। ময়মনসিংহ থেকে এখানে পড়তে এসেছেন। তাঁর কাছে কলেজটি আগে থেকেই পরিচিত। কারণ দুই কাজিন এখানে পড়েছেন। ‘আমি আম্মুকে আগে থেকেই বলে রেখেছিলাম, সরকারি কোনো মেডিকেলে চান্স না পেলে আমাকে যেন কুমুদিনীতেই ভর্তি করে। আর প্রথম দিন এসেই দেখি ক্যাম্পাসে নানা রঙের ফুল। এত রঙের ফুল আমি আগে কখনো দেখিনি।’ হেসে বলছিলেন নুসরাত। সদ্য পাস করেছেন বিডিএসের শিক্ষার্থী শতাব্দী ভৌমিক। বলছিলেন, ‘এই ক্যাম্পাসে অনেক স্মৃতি, খুব মিস করব প্রিয় ক্যাম্পাসকে।’

অবসরে এই পুকুরপাড়েই আড্ডা দেন শিক্ষার্থীরা
অবসরে এই পুকুরপাড়েই আড্ডা দেন শিক্ষার্থীরা

ভারতের কাশ্মীর থেকে এখানে পড়তে এসেছেন বিস্মা বাট। তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তিনি। চিকিৎসক হওয়ার পর বাংলাদেশেই দরিদ্র মানুষের সেবা করতে চান তিনি। একই মত প্রকাশ করেন নেপাল থেকে আসা দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী প্রণিশা শর্মা। তিনি বলেন, ‘নেপালে বাংলাদেশি কনসালট্যান্টের মাধ্যমে এই কলেজ সম্পর্কে জেনেছি।’

কুমুদিনী হাসপাতালের পরিচালক চিকিৎসক দুলাল চন্দ্র পোদ্দার জানালেন, ‘আগে এখানে বিডিএস কোর্স চালু ছিল না। এখন দেশের নানা প্রান্ত থেকে মেয়েরা এই কোর্সে ভর্তি হচ্ছে। ভবিষ্যতে এখানে বিভিন্ন বিষয়ে স্নাতকোত্তর কোর্স চালুসহ কলেজের উন্নয়নে আরও কিছু বিষয় আমাদের পরিকল্পনায় আছে।’

৭৫০ শয্যাবিশিষ্ট আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন কুমুদিনী হাসপাতাল শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শেখার সুযোগ করে দিচ্ছে। সদ্য প্রকাশ করা হয়েছে মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল। আরও একটি নতুন ব্যাচ এসে মুখরিত করবে এই ক্যাম্পাস। কুমুদিনী উইমেন্স মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা নতুনদের বরণ করে নেওয়ার অপেক্ষায় আছেন।

মোহাম্মদ আবদুল হালিম
মোহাম্মদ আবদুল হালিম

শুধু চিকিৎসক নয়, ভালো মানুষ গড়তে চাই
মোহাম্মদ আবদুল হালিম
অধ্যক্ষ
মুদিনী উইমেন্স মেডিকেল কলেজ
মেয়েদের শিক্ষার প্রসারে আমরা কাজ করছি। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এখানে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের উদ্দেশ্য শুধু চিকিৎসক তৈরি করা নয়, ভালো মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। এখান থেকে এমবিবিএস পাস করে আমাদের মেয়েরা দেশ-বিদেশে সম্মানের সঙ্গে মানুষের সেবা করছে। বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও তারা বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে কাজ করছে। দেশ-বিদেশে সফলতার সঙ্গে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে—এমন শিক্ষার্থীও অনেকে আছে। আমাদের এখানে যেসব মেয়ে ভালো ফল করে তাদের জন্য আমরা পুরস্কারের ব্যবস্থা করি। শিক্ষার্থীদের ভালো ফলাফল অব্যাহত রাখার জন্য যা কিছু প্রয়োজন, আমরা করব। রণদা প্রসাদ সাহার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আমাদের মেয়েরা দুস্থ ও অসহায় মানুষের সেবা করবে, এটাই চাওয়া।