মায়ায় জড়ানো ক্যাম্পাস

কলেজের পাঠাগার। ছবি: স্বপ্ন নিয়ে
কলেজের পাঠাগার। ছবি: স্বপ্ন নিয়ে

হাঁটতে হাঁটতে আমরা তখন কলেজের পুকুরপাড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। শুনতে পেলাম কেউ একজন বলছেন, ‘জীবন থেকে কখন যে অনার্সের সময়টা চলে গেল, বুঝতেই পারিনি।’ বক্তার নাম কিরণ। সরকারি হরগঙ্গা কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র তিনি। ১ আগস্ট আমরা ঘুরে দেখছিলাম মুন্সিগঞ্জের স্বনামধন্য এই কলেজটির ক্যাম্পাস। সেদিন চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠান চলছিল। সে আয়োজন এতই মনোমুগ্ধকর, কিছুক্ষণ বসে অনুষ্ঠান উপভোগ করার আগ্রহ দমিয়ে রাখা গেল না। উপস্থিত শিক্ষার্থীদের বক্তব্যে উঠে আসছিল সরকারি হরগঙ্গা কলেজের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা। কলেজ যে তাঁদের কতখানি মায়ায় জড়িয়ে ফেলেছে, ঘুরেফিরে সে কথাই বলছিলেন শিক্ষার্থীরা।

হ্যাঁ, সরকারি হরগঙ্গা কলেজের পরিবেশটা মায়ায় জড়িয়ে যাওয়ার মতোই। খুব সকালেই শুরু হয় শিক্ষার্থীদের আনাগোনা। আর বিকেলে তো কলেজ প্রাঙ্গণ পুরো এলাকার মানুষের কাছেই ‘বেড়ানোর জায়গা’ হয়ে ওঠে। হোস্টেলের ছাত্র ও এলাকার ছেলেপুলেরা কলেজের বিশাল মাঠে খেলাধুলা করেন। মাঠের চারদিকে রাস্তা, দুই পাশে গাছের সারি। তার পাশেই ২, ৩, ৪ তলা ভবনগুলো। মাঠের পূর্ব দিকে বাগান, দক্ষিণে কলেজের সবচেয়ে পুরোনো ভবনটার সঙ্গে শহীদ মিনার, পাশেই আরও একটি বাগান। আর আছে শতবর্ষী একটি জামগাছ। মাঠের পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে ছাত্রছাত্রীদের বসার সুবিধার জন্য মাথার ওপর তৈরি হয়েছে তিনটি বড় ছাতা। আছে বিশাল পুকুর। পুকুরের দুই পাড়ে দুটি ছাত্রাবাস (একটি ছাত্রাবাস এখন পরিত্যক্ত)। সব মিলিয়ে পরিবেশটা সত্যিই মনে রাখার মতো।

হরগঙ্গা কলেজে ১৯৯৫-৯৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি চালু হয়। এখন কলেজে ১৫টি বিষয়ে অনার্স ও ৯টি বিষয়ে মাস্টার্স কোর্স চালু আছে। শিক্ষক আছেন ৮৫ জন। শিক্ষার্থী প্রায় ১১ হাজার। কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্বে রয়েছেন অধ্যাপক মীর মাহ্‌ফুজুল হক। জানা গেল, এ বছর ঢাকা বিভাগের শ্রেষ্ঠ অধ্যক্ষ নির্বাচিত হয়েছেন তিনি।

মাঠে বসেই জমে শিক্ষার্থীদের আড্ডা
মাঠে বসেই জমে শিক্ষার্থীদের আড্ডা

সরকারি হরগঙ্গা কলেজের জন্মের পেছনের গল্প শোনালেন হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান। ‘১৯৩৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর আমাদের কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। কলেজটির প্রতিষ্ঠাতা টঙ্গিবাড়ী উপজেলার আশুতোষ গাঙ্গুলী। তাঁর বাবা হরনাথ গাঙ্গুলী ও মা গঙ্গাশ্বরী দেবীর নামের প্রথম অংশ অনুসারে কলেজটির নামকরণ করা হয়েছিল। সে সময় অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক হরগঙ্গা কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন।’

সরকারি হরগঙ্গা কলেজের সহকারী গ্রন্থাগারিক শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন বললেন এ কলেজের কয়েকজন কৃতী ছাত্রের কথা। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আমিনুদ্দিন সরকার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের নির্বাচিত ডিন এ কে রফিকুল ইসলাম, সরকারি কর্মকমিশনের সাবেক সদস্য এ কে এম শামসুল হক। বেশ কয়েকজন দেশবরেণ্য অধ্যাপক এই কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ, লেখক ও অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, প্রাবন্ধিক অরবিন্দ পোদ্দার, নাট্যকার ও অভিনেতা মমতাজ উদ্‌দীন আহমেদসহ অনেকেই বিভিন্ন সময়ে এই কলেজে অধ্যাপনা করেছেন।

পড়ালেখার পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমের জন্যও মুন্সিগঞ্জে হরগঙ্গা কলেজের সুনাম আছে। শিক্ষার্থীদের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মধ্যে আছে রেড ক্রিসেন্ট, রোভার স্কাউট ও বিএনসিসি। ক্যাম্পাসে গানের ক্লাব হলো সংগীতচক্র। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সুরের মূর্ছনায় মঞ্চ মাতানোর দায়িত্বটা এই ক্লাবের সদস্যরাই নিয়ে থাকেন। ওদিকে উদ্ভাবনী ভাবনা নিয়ে কাজ করে চলেছে বিজ্ঞান ক্লাব। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে সরব থাকে হরগঙ্গা কলেজ প্রাঙ্গণ। বিশেষ দিনগুলোতে শিক্ষার্থীরা তো বটেই, এলাকার মানুষও এসে ভিড় করেন কলেজ ক্যাম্পাসে।

চতুর্থ বর্ষের শিক্ষা সমাপণী অনুষ্ঠানের এই মুহূর্ত ক্যামেরায় ধরে রাখতে চাইলেন বিদায়ী শিক্ষার্থীরা
চতুর্থ বর্ষের শিক্ষা সমাপণী অনুষ্ঠানের এই মুহূর্ত ক্যামেরায় ধরে রাখতে চাইলেন বিদায়ী শিক্ষার্থীরা

সহশিক্ষা কার্যক্রমগুলোতে শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের পাশেই থাকেন। ২০১১ সালে কলেজ থেকে বের হয়েছিল রবি প্রণাম নামে একটি স্মারকগ্রন্থ। ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে কাজী কথা। গবেষণামূলক এই বইগুলোতে দেশের বরেণ্য সাহিত্যিক, শিক্ষক ও গবেষকেরা লিখেছেন। তাঁদের পাশাপাশি স্থান পেয়েছে শিক্ষার্থীদের লেখাও।

ঘুরে ঘুরে আলাপ হলো শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। শোনা হলো তাঁদের চাওয়া-পাওয়ার কথা। অর্থনীতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র জাহিদুল ইসলাম বলছিলেন, ‘প্রতিটি বিভাগে ইনকোর্স পরীক্ষা চালু আছে, এটা আমাদের পড়াশোনার সবচেয়ে ভালো দিক। ইনকোর্সের ফলে আমাদের ফল ভালো হচ্ছে।’ হিসাববিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র সোহেল রানা জানালেন না পাওয়ার কথাও, ‘কলেজে একটা ক্যানটিন নেই, লাইব্রেরিতে নেই নতুন বই। যাতায়াতের জন্য ভালো ব্যবস্থা নেই। যা-ও একটা বাস আছে, সেটা বেশির ভাগ সময় নষ্ট হয়ে পড়ে থাকে।’ দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী আমেনা আক্তারের বক্তব্য, ‘মেয়েদের কমনরুমের পরিবেশ ভালো না। একটা পরিচ্ছন্ন কমনরুম থাকলে খুব ভালো হতো।’

কথা হলো কলেজের কয়েকজন প্রভাষকের সঙ্গে। উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. রাসেল কবির, হিসাববিজ্ঞানের মো. আবদুর রহমান, ইংরেজির সায়েদা সেলিনা—সবাই এই কলেজেরই শিক্ষার্থী ছিলেন। উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. রাসেল কবির বলেন, ‘ছাত্র অবস্থায় খুব ইচ্ছে ছিল সরকারি কর্মকর্তা হব। যে কলেজের ছাত্র ছিলাম, সেই কলেজে শিক্ষক হয়ে যোগদান করাটা ভাগ্যের ব্যাপার।

এই কলেজ থেকে জীবনে অনেক কিছু পেয়েছি। এই প্রতিষ্ঠান আমার কাছে নিজ ঘরের মতো। আদর, যত্ন, ভালোবাসা দিয়েই এই ঘরটা সাজাতে চেষ্টা করি।’

মীর মাহ্ফুজুল হক
মীর মাহ্ফুজুল হক

শুধু ভালো ফল নয়, ভালো মানুষ চাই

মীর মাহ্ফুজুল হক, অধ্যক্ষ, সরকারি হরগঙ্গা কলেজ, মুন্সিগঞ্জ

প্রতিবছর এখান থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে উল্লেখসংখ্যক ছাত্রছাত্রী মেডিকেল, প্রকৌশল ও অন্য স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় জায়গা করে নিচ্ছে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর অনেক শিক্ষার্থী বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসে, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কাজ করে কলেজের সুনাম ছড়াচ্ছে। আমরা চাই দেশসেরা কলেজের তালিকায় আমাদের কলেজেরও নাম থাকুক। আমাদের লক্ষ্য শুধু ভালো ফল নয়। আমার এই প্রতিষ্ঠান থেকে এমন মানুষ তৈরি করতে চাই যারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেতৃত্ব দেবে। যদি দক্ষ, যোগ্য, ন্যায়পরায়ণ মানুষ হিসেবে শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলতে পারি, তাহলেই বুঝব কলেজের জন্য কিছু করতে পেরেছি।