ছাত্রীদের আরেক পরিবার

এই ক্যাম্পাস ছাত্রীদের জন্য বুক ভরে দম নেওয়ার জায়গা। ছবি: কবির হোসেন
এই ক্যাম্পাস ছাত্রীদের জন্য বুক ভরে দম নেওয়ার জায়গা। ছবি: কবির হোসেন

আট বছর বিরতির পর পড়ালেখায় ফেরা তো সহজ নয়। জান্নাত আরা ফেরদৌসীর জন্য সেটা ছিল আরও কঠিন।

মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পেরিয়েছেন। ভালো ছাত্রী ছিলেন। হুট করে বিয়ে হয়ে গেল বলে পড়ালেখা বন্ধ হলো তখন। আবার যখন পড়বেন বলে ঠিক করলেন, জান্নাতের ঘরে তখন চার বছরের মেয়ে। সংসার সামলানোর গুরুভারও তাঁর কাঁধে। তবু সাহস করে ভর্তি হলেন ঢাকার সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটিতে। শুরুতে নিজের ওপর বিশ্বাস ছিল না একেবারেই। ভাবছিলেন, আমি কি পারব? শিক্ষকদের অনুপ্রেরণা পেয়ে জান্নাত যখন ক্লাসে মন দিয়েছেন, মেয়ে আমিরা তখন একটু একটু করে বড় হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়েরই ডে–কেয়ার সেন্টারে। সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির সোশিওলজি অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী জান্নাতের সিজিপিএ এখন ৩.৯৯ (৪–এর মধ্যে)।

রাজধানীর হাটখোলায় অবস্থিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টিতে এখন ছুটি চলছে। তবু আমাদের অনুরোধে, স্বপ্ন নিয়ের সঙ্গে আড্ডা দিতে গত মঙ্গলবার ক্যাম্পাসে এসেছিলেন একদল ছাত্রী। লম্বা ছুটি পেয়ে, বাসায় থেকে ছাত্রীরা নাকি হাঁপিয়ে উঠেছেন। ক্যাম্পাসের চেনা পরিবেশে পা রেখেই বুক ভরে দম নিলেন। ‘প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত এখানেই তো আমাদের সময় কাটে। বেশি দিন ছুটি কাটাতে ভালো লাগে না। ক্যাম্পাস আর বন্ধুদের মিস করি। বাড়ির বাইরে এটাও তো আমাদের একটা পরিবার।’ বললেন ছাত্রীদের একজন।

এই পরিবার নিয়ে সবার ঝুলিতেই অজস্র গল্প। কারও গল্প অনুপ্রেরণার, কারও বন্ধুত্বের। একে একে তাঁরা বললেন, আমরা টুকে নিলাম।

 বিপদে মেয়েদের পাশে

তানহা মীম নরসিংদীর মেয়ে। সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটিতে পড়ছেন জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগে। বাড়ির লোকজন বলেছিল, ‘মেয়েদের এত পড়ালেখার কী দরকার? যদি পড়তেই হয়, বিয়ে করে স্বামীর টাকায় পড়ো।’ কিন্তু তানহা মেনে নিতে পারেননি। নিজের দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধেই নিয়েছেন। টিউশনি করে ঢাকা শহরে থাকা, বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি দেওয়া...কঠিন হয়ে যায় তাঁর জন্য। তাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ টিউশন ফি ছাড়ের ব্যবস্থা করেছে। ভালো ফলের জন্য তিনি ৫০ শতাংশ বৃত্তি পান। বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শিক্ষা সহায়ক তহবিল’ থেকে পান আরও কিছুটা ছাড়। সব মিলিয়ে মনে বল পেয়েছেন তানহা। কথা বলার সময় তাঁর কণ্ঠে আত্মবিশ্বাসের ছাপ টের পাওয়া গেল।

শিক্ষার্থীদের শুধু সনদ নয়, এই আত্মবিশ্বাসটাও দিতে চায় সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি। বিভিন্ন সময় ছাত্রীরা যখন বিপদে পড়েছে, পাশে দাঁড়িয়েছেন শিক্ষকেরা। কখনো কখনো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও এগিয়ে এসেছে। বিবিএর ছাত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস যেমন একবার সময়মতো টিউশন ফি দিতে পারছিলেন না। এক শিক্ষক ডেকে বলেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম তো আমি বদলাতে পারব না। তোমার টাকাটা আমি দিচ্ছি। তুমি পরে আমাকে দিয়ে দিয়ো।’ মেয়েরা যেন রাস্তাঘাটে হেনস্তার শিকার না হন, সে জন্য আত্মরক্ষার কৌশল শেখানোর ব্যবস্থা আছে এখানে। শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের শিশুসন্তানদের জন্য আছে ডে–কেয়ার সেন্টার।

কেন এখানে এসে ছাত্রীরা বুকভরে দম নেন, বুঝতে বেগ পেতে হলো না।

 শেখার আনন্দ

বিজনেস অ্যাডমিিনস্ট্রেশন (বিবিএ ও এমবিএ), কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই), ইংলিশ ্ল্যাংগুয়েজ অ্যান্ড লিটারেচার, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ এবং সোশিওলজি অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ—বিভাগ পাঁচটি হলেও ছাত্রীদের মধ্যে কোনো বিভাজন নেই। যেহেতু সবাই এক পরিবারের সদস্য, প্রত্যেকেই একে অপরের চেনা। সিএসই বিভাগের আয়োজিত কর্মশালায় অংশ নেন বিবিএর ছাত্রীরা। ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ অ্যান্ড লিটারেচার বিভাগ যখন শেক্​সপিয়ারের নাটক মঞ্চস্থ করে, সেখানে যোগ দেন সোশিওলজি অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজের ছাত্রীরাও। বিভাগ আলাদা হতে পারে, শেখার আগ্রহটা সবার।

মেয়েদের পড়ালেখাটা যেন আনন্দদায়ক হয়, সেই চেষ্টা থাকে শিক্ষকদের। বিবিএর ছাত্রীরা জানালেন, কিছুদিন আগে মার্কেটিং ক্লাসে তাঁরা ডিজনি ওয়ার্ল্ড নিয়ে আলোচনা করেছেন। রাপাঞ্জেল, সিনড্রেলা, মোয়ানা, আলাদিন—ডিজনির এসব চরিত্রগুলোর বিপণনকৌশল সম্পর্কে ‘প্রেজেন্টেশন’ দিয়েছেন তাঁরা। জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের সঙ্গে যুক্ত আছে বেসরকারি টিভি চ্যানেল—দীপ্ত টিভি। পাস করার পরপরই ছাত্রীরা সেখানে ইন্টার্নশিপের সুযোগ পান। সব বিভাগের ছাত্রীরা এক হয়ে কখনো কখনো দলবেঁধে ঘুরে আসেন বড় বড় প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়। বিভিন্ন সভা, সেমিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, প্রতিযোগিতা, খেলাধুলার মধ্য দিয়েও সারা বছর সরব থাকে ক্যাম্পাস।

 আত্মবিশ্বাসের আলোয়

প্রয়োজন অনুসারে ভালো ফলের ভিত্তিতে পড়ালেখার পাশাপাশি ক্যাম্পাসেই কাজের সুযোগ পান সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির কোনো কোনো শিক্ষার্থী। ইংরেজি বিভাগের সানজানা তাঁদের মধ্যে একজন। ‘২০১৭ সালে আমি প্রতিদিন ২ ঘণ্টা করে ডিপার্টমেন্টের অফিসে কাজ করেছি। সে জন্য আমাকে সম্মানীও দেওয়া হয়েছে,’ বললেন তিনি।

পড়ালেখায় আগ্রহ জোগাতে আরও নানা আয়োজন আছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ অ্যান্ড লিটারেচার বিভাগের ছাত্রী নাদিয়া হকের গল্পটা শুনুন—‘এখানে ভর্তি হওয়ার আগে আমার এক বছরের গ্যাপ ছিল। নিজের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলাম। ভর্তি হওয়ার পর প্রথম সেমিস্টারেই রেজাল্ট ভালো হয়েছিল, পুরস্কার হিসেবে আমার ২৫ শতাংশ টিউশন ফি মওকুফ করা হলো। হঠাৎ করেই টের পেলাম, আমার হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছে।’ সোশিওলজি অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে একই বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন তাসফিয়া তানজিম। নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির এমন সুযোগ পেয়ে তিনি স্বপ্ন পূরণের পথে এক ধাপ এগিয়ে গেছেন।

অধ্যাপক বেগজাদী মাহমুদা নাসির ছিলেন মেয়েদের এই বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য। জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি নারীশিক্ষা আন্দোলনে নিরলসভাবে কাজ করেছেন। নারীদের জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করাও ছিল তাঁর সেই চেষ্টার অংশ। ২০১৫ সালে তিনি প্রয়াত হন। জান্নাত আরা ফেরদৌসী, তানহা মীম, নাদিয়া হকদের মতো প্রত্যয়ী তরুণীদের সঙ্গে দেখা হলে নিশ্চয়ই আনন্দে তাঁর বুক ভরে যেত!

>পেশাজীবনের জন্য মেয়েদের প্রস্তুত করতে চাই
ড. পারভীন হাসান, উপাচার্য, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি
ড. পারভীন হাসান
ড. পারভীন হাসান
সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৯৩ সালে, সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজ প্রাঙ্গণে। এর মধ্যে নানা ঝামেলার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়টা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ২০০৯ সালে আমরা আবার চালু করি। মাত্র পাঁচজন ছাত্রী নিয়ে শুরু, এখন সেই প্রতিষ্ঠানেই প্রায় ৫০০ ছাত্রী। শুরুতে টিনশেড ঘর, এরপর ইত্তেফাক ভবনে দুইটা তলা নিয়ে কার্যক্রম, সবশেষে এই নিজস্ব ভবনে আসা। আমাদের শক্তির জায়গা তিনটি। প্রথমত এটি মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়। দ্বিতীয়ত, আমাদের ক্যাম্পাসটা এমন জায়গায় অবস্থিত, যেখানে এ রকম একটা বিশ্ববিদ্যালয় না হলে হয়তো অনেক মেয়েরই উচ্চশিক্ষা নেওয়ার সুযোগ হতো না। তৃতীয়ত, একদল দক্ষ, নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক, যাঁরা সব সময় ছাত্রীদের সময় দিতে প্রস্তুত। অনেকে বলে, আপনারা কেন ছেলেদেরও ভর্তি করেন না? তাহলে তো আরও অনেক শিক্ষার্থী পাবেন। আমরা বলি—না। প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য অধ্যাপক বেগজাদী মাহমুদা নাসিরের যে স্বপ্ন ছিল, সেই স্বপ্ন সামনে রেখেই আমরা এগিয়ে যেতে চাই। এখানে অনেক রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে আছে। অনেকেরই পড়ালেখা শেষ করার আগেই বিয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু করে। আমরা মেয়েদের বোঝাই, যে পরিবার বলছে পড়ালেখা বন্ধ করে তুমি সংসারী হও, সেখানে গিয়ে তো তুমি সুখী হতে পারবে না। কেবল পড়ার জন্য পড়া নয়, আমরা মেয়েদের পেশাজীবনের জন্য প্রস্তুত করতে চাই। যেন তারা স্বাবলম্বী হতে পারে। আমরা বলি, শুধু পড়াশোনা করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসো না। ক্যাম্পাসে আসো, বই পড়ো, সিনেমা দেখো, আড্ডা দাও, বন্ধুত্ব করো, নিজের জড়তা দূর করো। নিজেকে উপস্থাপন করা শিখলেই তুমি কর্মজীবনে সফল হতে পারবে। এখানে বিবাহিত মেয়েরা পড়ে। যাদের সন্তান আছে, ডে–কেয়ার সেন্টারে বাচ্চাদের রেখে ক্লাস করতে পারে। ডে–কেয়ার সেন্টারে ছয় মাসের বাচ্চা থেকে শুরু করে দশ বছরের বাচ্চারাও থাকে, খেলা করে। দেখে ভালো লাগে। সামনে আরও কয়েকটি বিভাগ চালু করার ইচ্ছা আছে। আমরা আরও বেশ কয়েকটি নতুন ল্যাবরেটরি তৈরি করতে চাই। যেন আগামীর পৃথিবীর জন্য মেয়েরা প্রস্তুত হতে পারে। অন্য অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে বেতন অনেক কম। তবু এই টাকাটুকু দিতেও তো মা-বাবার কষ্ট হয়, কোনো না–কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। মেয়েদের বলি, তোমরা মা-বাবার এই কষ্টের মান রেখো।