কেন পড়ব প্রত্নতত্ত্ব

প্রত্নতত্ত্ব তাদেরই পড়া উচিত, যাদের অ্যাডভেঞ্চারের নেশা আছে। ছবি: সাহিব নিহাল
প্রত্নতত্ত্ব তাদেরই পড়া উচিত, যাদের অ্যাডভেঞ্চারের নেশা আছে। ছবি: সাহিব নিহাল
ইতিহাস, বিজ্ঞান, সাহিত্য, প্রকৌশল—কত রকম বিষয় আছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। কোন বিষয়ে আমি পড়ব, সিদ্ধান্ত নেওয়াই কঠিন। স্বপ্ন নিয়ের এই বিভাগে আমরা একেকটি বিষয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। আজ প্রত্নতত্ত্ব সম্পর্কে বলেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক নুরুল কবির

কী পড়ানো হয়

আজ আমরা যে জীবনটা যাপন করছি, তার বিকাশ কীভাবে হলো, সেটা জানাই হলো প্রত্নতাত্ত্বিকের কাজ। তাই জীবনের প্রতিটি অংশ সম্পর্কেই প্রত্নতাত্ত্বিককে জানতে হয়। ‘ক্রস-ডিসিপ্লিন’ যেটাকে বলে। মানুষের আচরণ, প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে হয়, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, ইতিহাস, ভূগোল, দর্শনসহ প্রায় সবই পড়তে হয়। আসলে আমরা পড়ি না, এমন কোনো বিষয় নেই। এ কারণে আমাদের সবকিছুর পণ্ডিতও বলা হয়। এভাবে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সবকিছুই আমাদের জানতে হয়। আমরা সংস্কৃতির পরিবর্তনকে জানতে চাই আর সংস্কৃতি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সংস্কৃতি হলো সবকিছুর যোগফল।

ভবিষ্যৎ কী?
আমাদের বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্বের যে পরিমাণ ‘রিসোর্স’ রয়েছে, সেগুলোকে কাজের আওতায় আনতে চাইলে এখনো প্রায় ২০০ বছরের কাজ বাকি আছে। আমাদের উত্তরবঙ্গে যে পরিমাণ ‘সাইট’ আছে, তার মধ্যে গত ২০০ বছরে আমরা কাজ করেছি মাত্র ১০ শতাংশ সাইট নিয়ে। কাজের সুযোগ দিন দিন তৈরি হচ্ছে। ইতিহাসের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। তথ্য বাড়ছে, জ্ঞান বাড়ছে, একই সঙ্গে বিশ্ববাসী আবিষ্কার করছে তাদের সবকিছু জানতে হবে। এই জানার জায়গায় মানুষের আগ্রহ এখন সব সীমা অতিক্রম করেছে। এখানেই প্রত্নতত্ত্বের কাজ। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিকদের চাহিদাই বাড়ছে শুধু, আরও পৃষ্ঠপোষক প্রয়োজন। পুরো উত্তরবঙ্গের ইতিহাস আমাদের জানা দরকার। প্রত্নতাত্ত্বিকদের সাম্প্রতিক আবিষ্কার বলছে, আমাদের এখানকার বৌদ্ধধর্ম ও দর্শনের বিকাশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধ দর্শনের উৎস হিসেবে কাজ করেছে। আমরা জানতে না চাইলেও তারা তো জানতে চাইছে তাদের উৎসকে। তাই সব মিলিয়ে বিষয় হিসেবে প্রত্নতত্ত্বের ভবিষ্যৎ বেশ উজ্জ্বল।

ক্যারিয়ার কোথায়?
আমরা এমন একটা মহাদেশে বাস করি, যেখানের মানুষেরা সবচেয়ে বেশি জাদুঘরে যায়। মানুষ জাদুঘরে যায় অজানা ইতিহাসকে জানতে। আমাদের দেশে জাদুঘরগুলোতে প্রত্নতাত্ত্বিকদের নিয়োগ দেওয়া হলে সেখানে কাজ করার সুযোগ থাকছে। তা ছাড়া, বাংলাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যগুলোকে বাঁচাতে হলে সারা দেশে প্রত্নতাত্ত্বিক ছড়াতে হবে। উন্নত পর্যায়ে না হোক, অন্তত প্রাথমিকভাবে প্রত্নতত্ত্বের চর্চাটা যেন কলেজগুলোতে হয়। যেন পাশেই থাকা একটা ভাঙা জমিদারবাড়ি বা মন্দির-মসজিদ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ঢাকা থেকে কাউকে যেতে না হয়। এ জন্য আমরা কলেজগুলোতে প্রত্নতত্ত্ব বিষয়টা ছড়াতে চাইছি। আমরা বিসিএসে কোটা চাইছি এবং সে কাজটাও অনেক দূর এগিয়েছে।
এ ছাড়া এখন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর আছে। সরকারের ‘প্যান একাডেমিক ডিপার্টমেন্ট’-এর প্রায় সব বিভাগেই প্রত্নতাত্ত্বিকেরা কাজ করতে পারেন। যেহেতু মাটির নিচে আমাদের ঐতিহ্য আছে, আর আমাদের অঞ্চলটা ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্ব এবং গৌরব ধারণ করে আছে, এ কারণে পানি উন্নয়ন বোর্ড, ওয়াসাসহ যেকোনো প্রতিষ্ঠানের মাটি কাটার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যেকোনো কাজে প্রত্নতাত্ত্বিকদের প্রয়োজন। বিশ্বব্যাপী প্রত্নতত্ত্বের প্রতি সচেতনতা বাড়ার সঙ্গে সারা পৃথিবীর আগ্রহ ভারত এবং বাংলাদেশের দিকে আসছে। গত পাঁচ বছরে এডিবি প্রায় ২০০ কোটি টাকা খরচ করেছে। এটা আরও বাড়ত, যদি আমাদের পেশাদার প্রত্নতাত্ত্বিকদের একটা প্ল্যাটফর্ম থাকত। সেটা তৈরির কাজ চলছে। তৈরি হয়ে গেলে আমাদের ছাত্রছাত্রীদের আরও সুযোগ তৈরি হবে।
‘আর্কিওলজিক্যাল ট্যুরিজম’-এর জন্য প্রতিবছর ইউরোপীয় পর্যটকদের ৪৬ শতাংশ আসে ভারতে। তাই আর্কিওলজিক্যাল ট্যুরিজম নিয়ে কাজ করার জন্য প্রচুর প্রত্নতাত্ত্বিক প্রয়োজন। অতএব সুযোগটা ক্রমেই বাড়ছে।

কাদের পড়া উচিত?
যারা একসঙ্গে অনেক বিষয় সম্পর্কে জানতে চায়, তাদের প্রত্নতত্ত্ব পড়া উচিত। ছোটবেলা থেকে যারা ইতিহাস, যুক্তি নিয়ে আগ্রহী, যারা একধাপ এগিয়ে ভাবতে পারে। কারণ, মাটির নিচে থাকা কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনকে ওপর থেকে দেখেই বুঝতে হবে কোথা থেকে কাটতে হবে, যেন সেটার কম ক্ষতি করে বেশি তথ্য উদ্ধার করা সম্ভব হয়। এবং সবশেষে, প্রত্নতত্ত্ব তাদেরই পড়া উচিত যাদের অ্যাডভেঞ্চারের নেশা আছে। প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাজের জন্য দেশের অনেক প্রত্যন্ত স্থানে যেতে হয়। কখনো কখনো সারা দিনে দুটো রুটি আর আলুভাজি খেয়ে কাজ করতে হতে পারে। এটা সবাই পারে না। আবিষ্কার করার নেশায় যারা এগুলোকে ‘অ্যাডভেঞ্চার’ হিসেবে নিতে পছন্দ করে, তাদের জন্য প্রত্নতত্ত্ব।

অনুলিখন: সাহিব নিহাল