কীভাবে সংরক্ষণ করব আইডিয়া?

মেধাস্বত্ব অধিকারের গুরুত্ব শীর্ষক আলোচনার আয়োজক ও অতিথিরা। ছবি: সংগৃহীত
মেধাস্বত্ব অধিকারের গুরুত্ব শীর্ষক আলোচনার আয়োজক ও অতিথিরা। ছবি: সংগৃহীত

ব্যবসার দারুণ একটা আইডিয়া মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে? বন্ধুবান্ধবসহ অনেকের কাছেই হয়তো আপনার ভাবনার কথা বলেছেন। তারপর একদিন দেখলেন, আপনারই আইডিয়া কাজে লাগিয়ে অন্য কেউ ব্যবসা শুরু করেছে। কেমন হবে অনুভূতি?

মানুষের সৃজনশীল কাজকর্মকে বিশেষ অধিকার দিয়ে নিরাপত্তা বিধানের জন্যই ‘ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি রাইটস’ (আইপিআর) বা মেধাস্বত্ব অধিকার। মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, তবে কি এর মাধ্যমে আপনার আইডিয়াটি নিরাপদভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব?

প্রথমত, কপিরাইটের মাধ্যমে সৃজনশীল কোনো কাজকে স্বীকৃতি দেওয়া যায়, উদ্ভাবনকে নয়। আবার আপনার নতুন কোনো আবিষ্কারকে সংরক্ষণ করার জন্য কপিরাইট নয় বরং পেটেন্ট দরকার। কপিরাইট কিংবা পেটেন্ট কোনোটির মাধ্যমেই আইডিয়াকে সংরক্ষণ করা যায় না। তবে এর অর্থ মোটেও এই নয় যে আপনার আইডিয়াটি মূল্যবান নয়। কারণ, যেকোনো উদ্ভাবন কিংবা আবিষ্কারের পেছনে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে যেটি কাজ করে, সেটি হলো আইডিয়া। যেহেতু আইডিয়া একটি অদৃশ্য বিষয় এবং পৃথিবীতে হাজার রকমের মানুষের হাজার রকমের আইডিয়া আছে, তাই এ ক্ষেত্রে অবশ্যই নিজের আইডিয়াটিকে মূল্যবান হিসেবে প্রমাণ করতে হবে। আইডিয়ার মাধ্যমেই যেহেতু উদ্ভাবনের দ্বার উন্মোচিত হয়, সে জন্যে উদ্ভাবন কিংবা আবিষ্কারের পর্যায়ে এসে এটির নিরাপত্তা বিধান করতেই হবে।

২৬ এপ্রিল তারিখটি ‘ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি’ দিবস হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশে এখনো এই দিবসটি সবার কাছে সমান গুরুত্ব বহন করে না। এ ক্ষেত্রে সচেতনতার অভাব আছে। কিন্তু বর্তমানে আইপিআরের বৈশ্বিক বাস্তবতায় আগামী দিনের জন্য বাংলাদেশকে ভাবতে হবে। এই বিষয়টিকে মাথায় রেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনোভেশন, ক্রিয়েটিভিটি অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ সেন্টার এবং বাংলাদেশ সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদপ্তরের যৌথ উদ্যোগে গত ২৯ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফবিএস সভাকক্ষে ‘ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি রাইটস: অ্যাওয়ারনেস অ্যান্ড প্রিপারেশন ফর দ্য ইনোভেটরস অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনিউর’ শিরোনামে একটি সেমিনার আয়োজন করা হয়। সেমিনারটিতে মূল বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত দেশের অন্যতম সেরা গবেষক অধ্যাপক হাসিনা খান। ইলিশের জেনম আবিষ্কার করেও তিনি পরিচিতি পেয়েছেন। তিনি এ ধরনের সময়োপযোগী আয়োজনের ভূয়সী প্রশংসা করেন।

বিজ্ঞানের জগতে নতুন নতুন উদ্ভাবন হচ্ছে প্রতিনিয়ত আর তাই এ ক্ষেত্রে পেটেন্ট এবং কপিরাইটের গুরুত্বও বেড়ে চলেছে। বিজ্ঞানসহ অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোতে নতুন নতুন যেসব উদ্ভাবন হচ্ছে সেগুলোর জন্যে ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি রাইটসের গুরুত্ব তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। ড. হাসিনা খান তাঁর বক্তব্যে নিজের বিভিন্ন গবেষণাকর্ম এবং আর্টিকেলের কথা আলোচনা করেন। আগের ব্যর্থতা থেকে কীভাবে শিক্ষা নিয়ে সামনের দিনে আরও ভালো করা যায়, তা-ও উঠে আসে তাঁর কথায়।

তা ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক মো. গোলাম সারোয়ার তাঁর প্রেজেন্টেশনে ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি রাইটসের বিভিন্ন দিক স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেন। পেটেন্ট, ট্রেডমার্ক করার নিয়মাবলি থেকে শুরু করে কেন আগামী দিনের নতুন উদ্ভাবকদের এ ব্যাপারে সচেতন থাকা উচিত সেটিও তিনি তাঁর আলোচনায় তুলে ধরেন।

ইনোভেশন সেন্টারের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দকার বজলুল হক সেশন চেয়ার হিসেবে উপস্থিত থেকে তাঁর মূল্যবান বক্তব্যে তৃতীয় বিশ্বের পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় সমতা নিয়ে কথা বলেন এবং এ ক্ষেত্রে ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি বিষয়ে বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রগুলোর কেন এখনই সচেতন হওয়া উচিত সে বিষয়ে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে পেটেন্ট, ডিজাইন এবং ট্রেডমার্ক অধিদপ্তরের রেজিস্ট্রার (সহকারী সচিব) মোহাম্মদ সানোয়ার হোসেইন বলেন, বাংলাদেশে এখন তাদের এই অধিদপ্তর অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে কাজ করছে। সচেতনতার অভাব দূরীকরণে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ ধরনের ক্যাম্পেইন শুরু করেছেন। আইপিআর সচেতনায় বাংলাদেশ এবং বহির্বিশ্বের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরে তিনি বাংলাদেশের সব অংশীদারের করণীয়ের বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর পরিচালক ড. ফারহাত আনোয়ার তাঁর বক্তব্যে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন স্টার্টআপের মালিকদের অবশ্যই পেটেন্ট এবং কপিরাইট সম্পর্কে পরিষ্কার এবং স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে। কারণ, বর্তমানে বাংলাদেশে অন্যের আইডিয়া কপি কিংবা নকল করার একটা সুযোগ আছে তাই তিনি মনে করেন এ বিষয়ে সবার সচেতনতা এখন সময়ের দাবি। উন্নত দেশগুলোর আইপিআর সংরক্ষণের ফলে উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত রাষ্ট্রগুলোর কী অবস্থা তৈরি হতে পারে আর সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কী করণীয় সে বিষয়ে তিনি জোর দিয়েছেন।

সেমিনারটি সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন ইনোভেশন সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক মো. রাশেদুর রহমান। সবশেষে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্য এখন এই বিষয়ে সবার সচেতনতা জরুরি। একজন উদ্ভাবক, বিনিয়োগকারী, উদ্যোক্তা সবার জন্যই এসব বিষয়ের স্পষ্ট ধারণা থাকা গুরুত্বপূর্ণ।’ গবেষণা খাতে বিশেষ অর্জনের জন্য তিনি সেন্টারের পক্ষ থেকে ড. হাসিনা খানের হাতে একটি স্মারক তুলে দেন।

দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট অনেকে এই সেমিনারে অংশ নেন।