প্রিন্সটনে পড়তে চাও?

প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রাঙ্গণে তওসীফ আহসান। ছবি: সংগৃহীত
প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রাঙ্গণে তওসীফ আহসান। ছবি: সংগৃহীত
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার আগেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি থেকে ভর্তির ডাক পেয়ে গিয়েছিলেন তওসীফ আহসান। এখন সেখানেই পড়ছেন পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে। ১৭৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত, বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়টিতে কীভাবে সুযোগ পেলেন নটর ডেম কলেজের এই ছাত্র? তওসীফ আহসান লিখেছেন তাঁর অভিজ্ঞতা, পরামর্শ ও প্রিন্সটনের গল্প।

গত বছর আগস্টের শুরুর দিকে, প্রিন্সটনে প্রথমবারের মতো পা রেখেই একটা লম্বা নিশ্বাস নিলাম। তখনো ঘোর কাটেনি। কখনো ভাবিনি বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটিতে পড়ার সুযোগ পাব। আন্তর্জাতিক পদার্থবিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে রৌপ্যপদক পাওয়ার পর আমাদের কোচ অধ্যাপক আরশাদ মোমেন (পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) ও অলিম্পিয়াডের বড় ভাইয়েরা আবেদন করতে বলেছিলেন, তবে আমি খুব একটা ভরসা পাইনি। সত্যিই যখন সুযোগ পেয়ে গেলাম, বিশ্বাসই হচ্ছিল না! যদিও আনন্দ গিলে ফেলে আমাকে পড়তে বসতে হয়েছিল, কারণ তখন কদিন পরই ছিল এইচএসসি পরীক্ষা।

ছোটবেলায় মা–বাবার হাত ধরে অলিম্পিয়াডগুলোতে অংশ নিতাম। এরপর তাঁদের অনুপ্রেরণায় ও আমার স্কুল উদয়ন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের হাবিব স্যারের উৎসাহে অলিম্পিয়াড ও পদার্থবিজ্ঞানের সঙ্গে লেগে থাকা। সেখান থেকে বড় ভাইয়া, আপুদের এমআইটি, প্রিন্সটন, হার্ভার্ড, স্ট্যানফোর্ড ও অন্যান্য খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে দেখে স্বপ্ন ডানা মেলতে থাকে ধীরে ধীরে। তাই আন্তর্জাতিক মঞ্চে পদক পাওয়ার পর ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে শুরু করি। নটর ডেম কলেজের রেজা স্যার ও জহরলাল স্যারও খুব সহায়তা করেছিলেন

নম্বর নয়, মানুষ
এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির ক্ষেত্রে একটি কথা বেশ প্রচলিত—উই অ্যাডমিট পিপল, নট নাম্বারস। অর্থাৎ আমরা মানুষকে ভর্তি করি, নম্বরকে নয়। এই একটি কথা দিয়েই বোঝা যায় প্রিন্সটন বা অন্যান্য ভালো র‌্যাঙ্কিংয়ের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ার সুযোগ পাওয়ার মূলমন্ত্র হলো নিজেকে আর দশজনের চেয়ে আলাদা করার প্রচেষ্টা। প্রথমত, স্যাটে অবশ্যই ভালো করতে হবে। তবে এই একটি পরীক্ষাই যথেষ্ট নয়। এ জন্য সহশিক্ষা কার্যক্রমের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি জীবনের গল্প, জীবনদর্শনও খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেটি একেকজনের একেক রকম। আমার জন্য হয়তো পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে আগ্রহ ও স্কুলজীবনে নানা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকা কাজে দিয়েছে।

তার মানে এই নয় যে এগুলোই একমাত্র উপায়। ছবি আঁকা, বিতর্ক, গান গাওয়া, স্বেচ্ছাসেবী কাজে যুক্ত থাকা, লেখালেখি, গবেষণা—এগুলোর মাধ্যমেও অন্য রকম হওয়া সম্ভব। পুরো বাছাইপ্রক্রিয়াটি চারটি দিক থেকে বিবেচনা করা হয়। ১. সহশিক্ষা কার্যক্রম ২. স্যাট বা এসএটি ৩. নিজের জীবন বা জীবনদর্শন নিয়ে বেশ কিছু লেখালেখি এবং ৪. স্কুল-কলেজ বা গবেষণার সহযোগী অধ্যাপক বা কোচ, এমন কারও দেওয়া প্রশংসাপত্র।

একাধিক সহশিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে কিছুদিন যুক্ত থেকে ছেড়ে দিলে হবে না, বরং যেকোনো একটি বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা গুরুত্বপূর্ণ। সেটি গবেষণাপত্র বা অলিম্পিয়াড—যা-ই হোক না কেন। এখানে মূলত যে বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, তা হলো লেগে থাকার ইচ্ছা (আমার ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে—কোনো সমস্যা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত তার পেছনে লেগে থাকার অভ্যাস সম্ভবত অলিম্পিয়াড থেকেই পেয়েছি)। এইচওয়াইপিএস (হার্ভার্ড, ইয়েল, প্রিন্সটনও স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি) অন্তর্ভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে ও এমআইটিতে বেশ ভালো পরিমাণে আর্থিক সহায়তা (ফিন্যান্সিয়াল এইড) দেওয়া হয়। কাজেই বৃত্তি পাওয়া নিয়ে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

নতুন সংস্কৃতি
প্রিন্সটনে পা রেখে একটু ভড়কে গিয়েছিলাম। নানা দেশ থেকে কত মানুষ যে এখানে এসেছে! নিজের দেশের কথা মনে পড়ে কেমন একটা খালি খালি অনুভূতি হতো। তার ওপর নিজেকে প্রমাণ করার একটা চাপ কাজ করা শুরু করল, যা আগে আমার মধ্যে ছিল না। এই চাপ একেবারেই ভালো লাগত না।

এখানে একসময় আইনস্টাইন, ফাইনম্যান, জন ভন নিউমান, টেরেঞ্চে টাওয়ের মতো নামকরা অধ্যাপক, বিজ্ঞানীরা কাজ করেছেন। এডওয়ার্ড উইটেন, বাঙালি অধ্যাপক জাহিদ হাসানের (ভাইল ফারমিয়ন কণা শনাক্ত করে পদার্থবিজ্ঞানীদের মহলে বেশ আলোড়ন ফেলে দিয়েছেন তিনি) মতো মানুষেরা এখানে ছিলেন। কেমন একটা ভয় হচ্ছিল, এ রকম নতুন পরিবেশে দেশ ছেড়ে এত দূরে সব একা মানিয়ে নিতে পারব তো? এত মানুষের ভিড়ে একটা অচেনা মুখ হয়ে হারিয়ে যাব না তো?

বাঙালি বিজ্ঞানী জাহিদ হাসানের (ডান থেকে দ্বিতীয়) সঙ্গে প্রিন্সটনের বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা। ছবি: সংগৃহীত
বাঙালি বিজ্ঞানী জাহিদ হাসানের (ডান থেকে দ্বিতীয়) সঙ্গে প্রিন্সটনের বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা। ছবি: সংগৃহীত

শেষ পর্যন্ত ‘হারিয়ে গিয়েছি, এটাই জরুরি খবর’ হয়নি প্রিন্সটনের পরিবেশের কারণে। নানা দেশ ও জাতির মানুষ মিলে এখানে এত অদ্ভুত একটা পরিবেশ সৃষ্টি করে, এখানে না থাকলে বুঝিয়ে বলা মুশকিল। সবাই অন্যের সংস্কৃতি, অন্যদের সাহিত্য নিয়ে জানতে খুব আগ্রহী! গ্রেগ নামের এক ছেলের মধ্যে আমি আমাদের কবি জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে যে পরিমাণ উৎসাহ, আগ্রহ দেখেছি, সেটা আমাদের দেশের মানুষের মধ্যেও বিরল! এভাবেই প্রিন্সটনের সংস্কৃতি আমাকে আপন করে নিয়েছে দ্রুত।

এখানে যেকোনো বিষয়ে, যাকে ইচ্ছা প্রশ্ন করা যায়। কোনো মানুষ বা ধারণাই প্রশ্নের বাইরে নয়! ওরিয়েন্টেশন উৎসবের মধ্য দিয়ে সবগুলো সংস্কৃতির মধ্যে একটা যোগসূত্র তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল শুরুতেই। এখানকার আরেকটা বিচিত্র নিয়ম হলো: আউটডোর অ্যাকশন ও কমিউনিটি সার্ভিস। এখানে শিক্ষার্থীদের ১০ জনের একেকটি দলে ভাগ করে রোমাঞ্চকর কোনো অভিযানে পাঠানো হয়। দলের প্রত্যেকেই একে অপরের অচেনা। পুরো অভিজ্ঞতাটি অসাধারণ! দলের মধ্যে কেউ দার্শনিক, কেউ কিছুটা বামপন্থী, কেউ কেউ বা পিয়ানো নিয়ে পড়ে থাকে সারা দিন! এ রকম নানা ধরনের মানুষের মধ্যে নিজেকে আর একা লাগেনি!

বাঙালিরা আছে
এ বছর আমি ও রাহুল সাহা (আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে ব্রোঞ্জপদকজয়ী) বাংলাদেশি হিসেবে যোগ দিয়েছি প্রিন্সটনে। এ ছাড়া অলিম্পিয়াডের সুবাদে এখানকার অনেক বাঙালির (আযমাইন ঈক্তিদার, দেবপ্রিয় বিশ্বাস) সঙ্গে আগে থেকেই বেশ ভালো পরিচয় ছিল। ভারতীয় বাঙালি, প্রবাসী বাঙালিদের সঙ্গেও পরিচয় হয়েছে, যা আমাকে মুগ্ধ করেছে তা হলো এখানকার বাঙালি কমিউনিটির বাঙালি উৎসব। একুশে ফেব্রুয়ারিতে কিংবা পয়লা বৈশাখে মনেই হয়নি আমরা বাংলাদেশে নেই। দেবপ্রিয় বিশ্বাস ভাই, ফাইরুয আপুদের উৎসাহ ছিল দেখার মতো! প্রিন্সটন বেঙ্গল টাইগার্সের (প্রিন্সটনের বাঙালি সংগঠন) কার্যক্রম বেশ প্রশংসনীয়। সব মিলিয়ে আমরা বাঙালিরা এখানে একটি বড় পরিবারের মতো।

প্রিন্সটনে পড়ালেখার পদ্ধতি বাংলাদেশের চেয়ে অনেকটাই অন্য রকম। যেটির কথা আলাদাভাবে বলতে হয় তা হলো অধ্যাপকদের আন্তরিকতা। নোবেল পুরস্কারজয়ী অধ্যাপকেরাও ছাত্রদের সময় দেওয়ার ব্যাপারে খুব আগ্রহী! এ জন্য গবেষণা করার সুযোগ বেশ সহজ এখানে। আরেকটি ব্যাপার বাংলাদেশের থেকে আলাদা, তা হলো কোর্সের পূর্ণ স্বাধীনতা। প্রথম বর্ষের ছাত্র হয়েও মূল বিষয়ের (মেজর) বাইরের কোর্স কিংবা দ্বিতীয় বর্ষের কোর্সের অন্যান্য কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় নিয়ে পড়ার সুযোগ আছে। মেজর ঘোষণা করার আগে ২ বছর পাচ্ছি নিশ্চিত হওয়ার জন্য। আর এখানে পড়ালেখার সংস্কৃতিটা খুব বেশি সমস্যা-সমাধানকেন্দ্রিক (যা কিছুটা অলিম্পিয়াডের মতো)। সবাই মিলে দল বেঁধে প্রায় অসম্ভব একটা সমস্যা সমাধান করার আনন্দটা অন্য রকম। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে সবার সঙ্গে যখন গল্প জমে ওঠে, মনে হয় অলিম্পিয়াডের সময়টাতে ফিরে গেছি।

একদিন কোয়ান্টাম মেকানিকস ২০৮–এর স্পিন নিয়ে সমস্যা সমাধান করার সময় বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান নিয়ে কথা শুরু হলো। মহাবিশ্বের অর্ধেক কণা (বোসন) যে সত্যেন বোসের নামে, কথায় কথায় উঠে এল সেই প্রসঙ্গ। বোস যে বাঙালি ছিলেন এবং আমাদের দেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে এই যুগান্তকারী কাজটি সমাপ্ত করেছিলেন, এ কথাটি ঢাকা থেকে ৮ হাজার মাইল দূরে বসে বলতে গিয়ে হঠাৎ একটা বিষয় অনুভব করলাম। পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙালির অবদান তো কম নয়!