কবি নজরুল কলেজে প্রয়োজনের অর্ধেক শিক্ষকও নেই

কবি নজরুল সরকারি কলেজের ছাত্রদের একমাত্র ছাত্রাবাস এভাবেই চলছে বেহাল দশায়। পুরান ঢাকার মোহিনী মোহন দাস লেনে।  ছবি: প্রথম আলো
কবি নজরুল সরকারি কলেজের ছাত্রদের একমাত্র ছাত্রাবাস এভাবেই চলছে বেহাল দশায়। পুরান ঢাকার মোহিনী মোহন দাস লেনে। ছবি: প্রথম আলো

শিক্ষার্থীদের পড়াতে সবার আগে দরকার শিক্ষকের। কিন্তু পুরান ঢাকার প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কবি নজরুল সরকারি কলেজে শিক্ষকেরই সবচেয়ে বড় ঘাটতি। কলেজে উচ্চমাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত প্রায় ১৭ হাজার শিক্ষার্থী পড়েন। এ জন্য কমপক্ষে ২০৪ জন শিক্ষক প্রয়োজন হলেও আছেন মাত্র ১০৬ জন। ফলে ক্লাস নিতে গিয়ে প্রতিদিনই হিমশিম খান শিক্ষকেরা।

শিক্ষকসংকটের পাশাপাশি সারা বছরই পরীক্ষা লেগে থাকাসহ আরও কয়েকটি কারণে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ক্লাস হয় খুবই কম। তবে উচ্চমাধ্যমিকের পরিস্থিতি তুলনামূলক ভালো। গত বছরের চেয়ে এবার উচ্চমাধ্যমিকে পাসের হার ২৬ শতাংশ বেড়েছে। মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় ৪ হাজার উচ্চমাধ্যমিকে পড়ে।

কলেজে ছাত্রীদের জন্য আবাসনের কোনো ব্যবস্থা নেই। পরিত্যক্ত বাড়ি লিজ নিয়ে চলা একমাত্র ছাত্রাবাসটির অবস্থাও জরাজীর্ণ। এ ছাড়া শ্রেণিকক্ষ ও পরিবহনসংকট তো আছেই। এর আগে ২০১৬ সালের অক্টোবরে এই কলেজ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল প্রথম আলো। তখনো এ ধরনের সমস্যাগুলো ছিল। গত তিন বছরে কোনো সমস্যার সমাধান হয়নি। তখন শিক্ষক ছিলেন ১০৭ জন। আর এখন ১০৬ জন। সব মিলিয়ে সমস্যার আবর্তে ঘুরছে প্রায় ১৪৫ বছরের পুরোনো এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

কলেজের অধ্যক্ষ আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার প্রথম আলোকে বললেন, শিক্ষক পেতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি) চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আবাসনসংকটের জন্য সরকারের উদ্যোগ জরুরি। আর পরিবহনসংকট কিছুটা মেটাতে কলেজের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় দুটি দ্বিতল বাস ভাড়া করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া দুটি বাস ও একটি গাড়ি কিনতে মাউশিতে প্রস্তাব দিয়েছেন। শ্রেণিকক্ষের সংকট কাটাতে বহুতল ভবন নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি ১৮৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও কলেজ চালু হয় ১৯২৩ সালে। ১৯৭২ সালে জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের নামে কলেজটির নামকরণ হয়। বর্তমানে উচ্চমাধ্যমিক ছাড়াও ১৭টি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর স্তরে পড়ানো হয়। এর মধ্যে আরও ৫টি নতুন বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) চালুর অনুমোদন পেয়েছে। এগুলো হলো ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি, উন্নয়ন শিক্ষা, মার্কেটিং, ফিন্যান্স এবং পরিসংখ্যান।

প্রশাসনিক উন্নয়নসংক্রান্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী, যেসব বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর পড়ানো হয়, সেগুলোতে কমপক্ষে ১২ জন শিক্ষক থাকার কথা। সে হিসাবে এই কলেজে ২০৪ জন শিক্ষক থাকার কথা। কিন্তু কলেজটিতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শিক্ষকের সংকট বেশি। যেমন পদার্থবিজ্ঞানে যেখানে ১২ জন শিক্ষক দরকার, সেখানে পদই আছে ৪টি। এর মধ্যে আবার ২টি পদ শূন্য। গণিতে চারটি পদের বিপরীতে শিক্ষক আছেন তিনজন। বাংলায় শিক্ষক আছেন পাঁচজন। হিসাববিজ্ঞানে সাতটি পদের বিপরীতে আছেন ছয়জন। এই স্বল্পসংখ্যক শিক্ষকেরাই উচ্চমাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত পড়ান।

কলেজ প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, কলেজের পক্ষ থেকে বাংলায় দুজন ও পদার্থে দুজন খণ্ডকালীন শিক্ষক রাখা হয়েছে। তাঁদের দিয়ে ‘কোনোমতে’ ক্লাস চালানো হচ্ছে।

 মাউশির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সারা দেশের সরকারি কলেজগুলোর শিক্ষকসংকট কাটানোর জন্য প্রায় ১২ হাজার শিক্ষকের পদ সৃষ্টির প্রক্রিয়া চলছে। সেটি অনুমোদন হওয়ার পর নিয়োগ দেওয়া গেলে শিক্ষকের সংকট দূর হবে।

যত ওপরের শ্রেণি, তত ক্লাস কম

কলেজের স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর স্তরের একাধিক শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেন, উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে ক্লাস হলেও যত ওপরের শ্রেণিতে ওঠা হয়, ততই ক্লাস কম হয়। ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতকোত্তরের (এমবিএ) ছাত্র জয় কর্মকার প্রথম আলোকে বলেন, ক্লাস হয় না বললেই চলে।

স্নাতক (সম্মান) ইসলামিক স্টাডিজের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মাহমুদ খান বললেন, ক্লাস খুবই কম হয়। তবে ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র আবু তালেব জানান, তাঁদের নিয়মিত ক্লাস হয়।

কলেজ প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান অধ্যক্ষ উচ্চমাধ্যমিক স্তরের তদারকির জন্য ‘নিবিড় পর্যবেক্ষণ’ কমিটি করে দিয়েছেন। এতে ইতিবাচক ফল পাচ্ছেন। এবার উচ্চমাধ্যমিকে তাঁদের কলেজে পাসের হার বেড়ে হয় ৮৫ দশমিক ৫২ শতাংশ, যা গতবার ছিল ৫৯ শতাংশ।

আবাসন ও শ্রেণিকক্ষের সংকট দূর হয়নি

কলেজে শ্রেণিকক্ষ আছে ৩৭টি, যা প্রয়োজনের চেয়ে কম। শিক্ষক ও শ্রেণিকক্ষের সমস্যায় সকালের দিকে উচ্চমাধ্যমিকের ও পরে স্নাতক-স্নাতকোত্তরের ক্লাসের সময়সূচি রাখা হয়েছে।

মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৪০ শতাংশ ছাত্রী হলেও তাঁদের জন্য ছাত্রীনিবাস নেই। পুরান ঢাকার শ্যামবাজারের মোহিনী মোহন দাস লেনে একটি পরিত্যক্ত (মূলত অর্পিত সম্পত্তি) বাড়ি লিজ নিয়ে ছাত্রদের জন্য শহীদ শামসুল আলম নামের ছাত্রাবাস করা হলেও সেই ভবন জরাজীর্ণ। গতকাল শুক্রবার ছাত্রাবাসটির কয়েকটি কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, দিনের বেলাতেই তা অন্ধকারাচ্ছন্ন। সব মিলিয়ে প্রায় দেড় শ ছাত্রের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে ছাত্রাবাস হলেও খাবার ও পানির সমস্যা বেশি। ১০৩ নম্বর কক্ষের বাসিন্দা জয় কর্মকার বলেন, ছাত্রাবাসে খাবারের (ডাইনিং) ব্যবস্থা না থাকায় বাইরে খেতে হয়।