সরকারি বিজ্ঞান কলেজ: সংকট শ্রেণিকক্ষে, ফলে এগোচ্ছে

সরকারি বিজ্ঞান কলেজের বারান্দার ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে পড়ছে। গত রোববার দুপুরে।  ছবি: প্রথম আলো
সরকারি বিজ্ঞান কলেজের বারান্দার ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে পড়ছে। গত রোববার দুপুরে। ছবি: প্রথম আলো

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির এক পাশে কলেজ। আরেক পাশে পৃথক মাধ্যমিক বিদ্যালয়। পুরোনো আধপাকা একাধিক ভবনে কলেজের অধিকাংশ শ্রেণিকক্ষ। কয়েকটি দেখতে গুদামের মতো। দুপুরেই অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে। বারান্দাগুলো অবশ্য ছাদ দেওয়া। কিন্তু ছাদের বিভিন্ন অংশে পলেস্তারা খসে পড়ছে। রড দেখা যায়।

কলেজের বিজ্ঞান ও ইংরেজি বিষয়ের দুজন শিক্ষক সেগুলো দেখিয়ে বললেন, কখনো কখনো পলেস্তারা মাথার ওপর পড়ার দশা হয়। ভেতরে বসার কক্ষগুলো মেরামত করে কোনোমতে চালানো হলেও বৃষ্টি ও গরমের সময় কয়েকটি শ্রেণিকক্ষে ক্লাস নেওয়াই দুরূহ ব্যাপার হয়ে যায়। 

রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় অবস্থিত বিজ্ঞানের জন্য বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি বিজ্ঞান কলেজের চিত্র এটি। সম্প্রতি একদিন কলেজে গেলে কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বললেন, শ্রেণিকক্ষের সংকটই কলেজটির বড় সমস্যা। ছাত্র বাড়লেও দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকদের নতুন পদ সৃষ্টি না হওয়াও আরেকটি সমস্যা। তবে এই সংকটের মধ্যেই পড়াশোনার ওপর বাড়তি নজর দিয়েছে বর্তমান কলেজ প্রশাসন। এতে পরীক্ষার ফলের দিক দিয়ে কলেজটি আবারও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। এ বছর উচ্চমাধ্যমিকে পাসের হার ও জিপিএ-৫ দুটোই আগের দুই বছরের চেয়ে ভালো হয়েছে। 

কলেজের অধ্যক্ষ বনমালী মোহন ভট্টাচার্য্য প্রথম আলোকে বলেন, শ্রেণিকক্ষের সমস্যাসহ কলেজের অবকাঠামোগত সমস্যা থাকলেও যা সামর্থ্য আছে, তা দিয়েই পড়াশোনার বিষয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আগামী বছর উচ্চমাধ্যমিকের ফল আরও ভালো হবে বলে তিনি আশা করছেন। 

১৯৫৪ সালে কারিগরি উচ্চবিদ্যালয় হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি শুরু হলেও বিএসসি কোর্স চালুর মধ্য দিয়ে ‘সরকারি বিজ্ঞান কলেজ’ হিসেবে যাত্রা শুরু হয় ১৯৮৫ তে। বিএসসি কোর্স এখন বিলীন হওয়ার পথে। বিএসসিতে ৪২ জন ছাত্র ভর্তি হলেও তাঁদের ক্লাস হয় না বললেই চলে। বিএসসির শিক্ষার্থীরাও আসেন না। দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রদের এই কলেজটি মূলত উচ্চমাধ্যমিককে ঘিরেই পরিচালিত হচ্ছে। উচ্চমাধ্যমিকে প্রায় ২ হাজার ৬০০ ছাত্র পড়ছে, যারা সবাই বিজ্ঞানের। 

২০১৬ সালের ডিসেম্বরে প্রথম আলো কলেজটি নিয়ে প্রতিবেদন করেছিল। তখনো শ্রেণিকক্ষ, আবাসন, পরিবহন ও শিক্ষকের পদ সৃষ্টি না হওয়ার মতো সংকট চলছিল। তবে এখন পরীক্ষার ফল ভালোর পথে ফিরেছে। ছাত্রদের যাতায়াতের জন্য দুটি বাস হয়েছে। ছোট হলেও কলেজে ক্যানটিন চালু হয়েছে। সহশিক্ষা কার্যক্রমও বেড়েছে। 

এ বছর উচ্চমাধ্যমিকে অনিয়মিত মিলিয়ে পরীক্ষা দিয়েছিলেন ১ হাজার ৫৫৬ জন। এর মধ্যে পাস করেছেন ১ হাজার ৫৪২ জন। নিয়মিত পাঁচজন ছাত্র পাস করতে পারেননি। পাস না করা বাকি নয়জন বোর্ডের ভুলের কারণে ভর্তি করা বাণিজ্য শাখার ছাত্র। পাস করা ছাত্রদের মধ্যে ৪৫০ জন জিপিএ-৫ পেয়েছেন। গত বছর জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ৫৭ জন। আর ২০১৭ সালে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ২৪৭ জন।

একাধিক শিক্ষক বললেন, এখন ক্লাসের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অন্যান্য পরীক্ষার পাশাপাশি একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ক্লাস পরীক্ষা (সিটি) এবং অভ্যন্তরীণভাবে আলাদা করে এমসিকিউ বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়। ইমন শেখ নামে দ্বাদশ শ্রেণির এক ছাত্র প্রথম আলোকে বলে, সে কলেজের ছাত্রাবাসে থাকে। এখন ক্লাসে না গিয়ে উপায় নেই। অধ্যক্ষ নিজেই আকস্মিকভাবে ছাত্রাবাসে এসে খোঁজ নেন কোনো শিক্ষার্থী ক্লাসের সময় ছাত্রাবাসে রয়ে গেল কি না। 

কলেজ সূত্রে জানা গেছে, ক্লাস নিয়মিত হলেও শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়তে হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ছাত্র বললেন, বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে বেশি প্রাইভেট পড়তে হয়। এমনকি বাংলা বিষয়েও পড়তে হয়। আর কলেজেরই কয়েকজন শিক্ষক তাঁদের পড়ান। 

অধ্যক্ষ বললেন, সরকারি নিয়ম মেনে শিক্ষকেরা ‘অতিরিক্ত ক্লাস’ নেন। যদিও একাধিক ছাত্র বলেছেন, কোনো কোনো বিষয়ের শিক্ষক সরকারনির্ধারিত ফির চেয়ে বেশি টাকা নেন। যেমন পদার্থের একজন শিক্ষক মাসে এক হাজার টাকা নেন।

শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষক ও আবাসন অবস্থা 
একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ১৬টি শাখায় (সেকশন) পড়ানো হয়। একেকটি শাখায় ১৫০ জন ছাত্র। ১৬টি শ্রেণিকক্ষ থাকলেও বেশির ভাগই পুরোনো এবং সমস্যায় জর্জরিত। এর মধ্যে ই-৫, ই-১১ সহ কয়েকটি শ্রেণিকক্ষের অবস্থা করুণ। সম্প্রতি কয়েকটি কক্ষ ঘুরে দেখা যায়, দুপুরেই অন্ধকার হয়ে আছে কক্ষগুলো। 

কলেজ প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষকের সৃষ্ট পদ ২৩টি। যদিও সংযুক্তি মিলিয়ে কর্মরত শিক্ষক আছেন ৪৫ জন। রসায়নে শিক্ষক আছেন পাঁচজন, ইংরেজিতে ছয়জন, উদ্ভিদবিজ্ঞানে তিনজন।

ছাত্রদের প্রায় ৭০ শতাংশই ঢাকার বাইরে থেকে আসা। কয়েকজন শিক্ষক জানালেন, অধিকাংশ ছাত্রই কলেজের ছাত্রাবাসে থাকতে চান। কিন্তু দুটি ছাত্রাবাসে মাত্র ৩৫৪ জন ছাত্র থাকতে পারেন। ফলে অনেককে বাইরে কষ্ট করে থাকতে হয়। 

একাধিক শিক্ষক ও ছাত্র বললেন, প্রায় নয় একর জায়গা নিয়ে চলা কলেজে প্রচুর খালি জায়গা আছে। অবকাঠামো ও শিক্ষক বাড়িয়ে বিশেষায়িত কলেজটিতে বিজ্ঞানের ছাত্রদের আরও সুযোগ দেওয়া সম্ভব।