আমাদের একটা গল্প আছে

>
বাঁ থেকে সত্যজিৎ চন্দ্র রায়, সুমি খাতুন ও কাজী সজীব আহমেদ। ছবি: সাইফুল ইসলাম
বাঁ থেকে সত্যজিৎ চন্দ্র রায়, সুমি খাতুন ও কাজী সজীব আহমেদ। ছবি: সাইফুল ইসলাম
ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী বৃত্তি পেয়ে স্বপ্ন পূরণের পথ খুঁজে পেয়েছেন অনেক শিক্ষার্থী। এ পর্যন্ত ৯৪২ জন বৃত্তি পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে স্নাতক শেষ হয়েছে ৯০ জনের। পড়ালেখা শেষ করে যাঁরা কর্মজীবনে প্রবেশ করেছেন, তাঁদের মধ্য থেকে পড়ুন তিন তরুণের কথা।

এবারের পূজা অন্য রকম

সত্যজিৎ চন্দ্র রায়
সহকারী পরিচালক (অপারেশন), নৌপরিবহন অধিদপ্তর

ছোটবেলায় আমি পড়ালেখা করেছি দিনাজপুরের নুরুল হুদা উচ্চবিদ্যালয়ে। বাবা মুড়ির ব্যবসা করতেন। এই ব্যবসা করে আমাদের তিন ভাইকে পড়ালেখা করানো তো সহজ ছিল না। ভালো কিছু খাওয়ার আবদার আমরা কোনো দিন করিনি। ভালো জামাকাপড় তো ছিল না। একটা শার্ট, একটা প্যান্ট—এই দিয়ে চলত। পূজার সময় আশপাশের সবাই নতুন জামা পরত। আমাদের মন খারাপ হতো, কিন্তু বাবাকে নতুন জামার কথা বলার সাহস পেতাম না।

একটা ভাঙাচোরা সাইকেল ছিল। সেই ভাঙা সাইকেল চালিয়ে সাত কিলোমিটার দূরের স্কুলে যেতাম। কখনো সাইকেলের চেইন ছিঁড়ে যেত, চাকা ঘুরত না। মনে হতো, আমার পড়ালেখার চাকাও বুঝি থেমে গেল।

উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্টের অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি পেলাম। তখন দুশ্চিন্তা অনেকটা দূর হয়েছিল। রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল নিয়ে পড়েছি। নৌপরিবহন অধিদপ্তরে আমার চাকরির ছয় মাস হলো। এবার পূজায় মায়ের জন্য শাড়ি, বাবার জন্য লুঙ্গি আর আত্মীয়স্বজনদের জন্য আমার সাধ্যমতো কেনাকাটা করেছি। ছোটবেলায় বাবা আমাকে পূজায় নতুন জামা দিতে পারেননি। কিন্তু তিনি তাঁর সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করেছেন। মা-বাবার হাতে নতুন কাপড় দেওয়ার যে আনন্দ, সেই আনন্দের কথা ভাবলেই চোখে জল আসে।

একদিন প্রশ্নের উত্তর দেব

সুমি খাতুন
প্রভাষক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি

‘তুমি পড়ালেখা করে বড় হলে আমাদের কী লাভ?’ আমাকে এই প্রশ্ন করেছিলেন এক প্রতিবেশী। কথাটা এখনো আমার কানে বাজে।

আমার বাড়ি খুলনার ডুমুরিয়ায়। বাবা দিনমজুর ছিলেন। মা কাঁথা সেলাই করে টুকটাক আয় করতেন। কখনো কারও কাছে হাত পাতিনি। কিন্তু পড়ালেখায় একটু সহযোগিতার জন্য অনেক সময় প্রতিবেশী, স্বজনদের কাছে যেতে হয়েছে। তখনই এক প্রতিবেশী দুকথা শুনিয়ে দিয়েছিলেন।

আমি সব সময় চেয়েছি, পড়ালেখার বাইরেও আমার দুনিয়াটা বড় হোক। স্কুলে পড়ার সময় বিতর্ক করেছি। অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি পেয়ে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পেরোনোর পর যখন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম, তখনো আমি প্রোগ্রামিংসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নিয়েছি। ব্র্যাক ব্যাংক–প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য শিক্ষাবৃত্তি পেয়েছিলাম বলেই আসলে নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস বেড়ে গিয়েছিল।

এখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের পড়াই। আমার সংগ্রামের গল্প অবশ্য আমি আমার ছাত্রদের বলিনি কখনো। কারণ, আমার মনে হয়, গল্পটা এখনো বলার মতো হয়নি। নিজের শিক্ষাজীবন ও পড়ানোর অভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধি করেছি, আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় একটা বড় সমস্যা আছে। আমার স্বপ্ন, আমি আমাদের গ্রামে একটা স্কুল করব। শিক্ষাব্যবস্থার এসব সীমাবদ্ধতা সেই স্কুলে থাকবে না। যেদিন স্বপ্ন পূরণ হবে; আমি পড়ালেখা করে বড় হলে কার কী লাভ—এ প্রশ্নের উত্তর সেদিনই দেব।

এখন দায়িত্ব আমাদের
কাজী সজীব আহমেদ
সাব ইন্সপেক্টর, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা, নারায়ণগঞ্জ

ছোটবেলা থেকে অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা করেছি বলেই একটা আত্মবিশ্বাস ছিল। ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্টের অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি পেয়েছি। ভালো ছাত্র ছিলাম বলে স্কুলেও শিক্ষকেরা আমাকে বিনা মূল্যে প্রাইভেট পড়াতেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে টিউশন করে নিজের খরচ চালিয়েছি। সব সময় আত্মবিশ্বাস ছিল, একটা না একটা কিছু হবে।

আমার বাড়ি মুন্সিগঞ্জে। বাবা দিনমজুরের কাজ করতেন। শুধু পরিবারে নয়, আত্মীয়স্বজনদের মধ্যেও আমিই সবচেয়ে বেশি পড়ালেখা করেছি। তাই সবার আমার প্রতি একটা প্রত্যাশা ছিল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর শেষ করার পরপরই ব্যাংকে চাকরি নিই। কিন্তু আমার লক্ষ্য ছিল ভিন্ন। ব্যাংকের চাকরির পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছিলাম। সাব ইন্সপেক্টর হিসেবে যখন টিকে গেলাম, তখন আর দ্বিতীয় ভাবিনি।

আমরা যারা ব্র্যাক ব্যাংক–প্রথম আলো ট্রাস্টের অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি পেয়েছি, আমাদের নিয়ে এবারই একটা অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন করা হয়েছে। অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবে আমি মনে করি, আমাদের দায়িত্ব অনেক। সবাই মিলে একটা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে চাই। যেন একে অপরের বিপদে সাহায্য করতে পারি, পাশে দাঁড়াতে পারি। একটু সহায়তা পেলেই যে মানুষ তাঁর স্বপ্ন পূরণ করতে পারে, সে কথা আমাদের চেয়ে ভালো আর কে জানে!