আমি তো কোথাও নেই!

স্বপ্ন নিয়ের অনুরোধে মডেল হয়েছেন স্নেহা, শাইরা, অকুণ্ঠ, আনজিলা, সেজান, আদিব, অবন্তী, প্রিমু ও বায়েজিদ। ছবি: খালেদ সরকার
স্বপ্ন নিয়ের অনুরোধে মডেল হয়েছেন স্নেহা, শাইরা, অকুণ্ঠ, আনজিলা, সেজান, আদিব, অবন্তী, প্রিমু ও বায়েজিদ। ছবি: খালেদ সরকার
ক্লাসে কেউ পড়ালেখায় তুখোড় হন, কেউ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড কিংবা খেলাধুলায় মাতিয়ে রাখেন ক্যাম্পাস। বিভিন্ন প্রতিযোগিতা থেকে পুরস্কার ছিনিয়ে এনে সবার নজর কেড়ে নেন অনেকে। অন্যদিকে এমন কজন শিক্ষার্থীকেও পাবেন, যাঁরা কিছুটা নিরুদ্যম, নিষ্ক্রিয়। কোনো আয়োজন, খেলাধুলা, প্রতিযোগিতা—কোথাও তাঁরা নেই। তাঁদের জন্যই লিখেছেন টেন মিনিট স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা আয়মান সাদিক


আমাদের যত বাধা
শুরুতে নিজের একটা গল্প বলি। 

বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখার আগপর্যন্ত পড়ালেখা ছাড়া শুধু খেলাধুলার প্রতিই আমার আগ্রহ ছিল। বিতর্ক কিংবা অন্য কোনো আয়োজনে কেউ অংশ নিতে বললে পালিয়ে বাঁচতাম। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটে (আইবিএ) ভর্তি হওয়ার পর পড়লাম মহা বিপদে! এখানে ক্লাসের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই ভালো বিতার্কিক। প্রথম বর্ষে কোনো একটা বিতর্ক প্রতিযোগিতায় আয়োজকেরা জোর করে আমার নাম ঢুকিয়ে দিল। 

যাহোক, সময়মতো প্রতিযোগিতায় হাজির হলাম। অন্য বিতার্কিকদের দেখেই ভয়ে আমার হাতের তালু ঘামতে শুরু করল। একেকজন সে কী তুমুল আত্মবিশ্বাস নিয়ে ইংরেজিতে বক্তৃতা দিচ্ছে, আমি তো এদের কাছে নস্যি! যেহেতু আয়োজকেরাও আমার সহপাঠী, কোনোমতে তাদের হাতে-পায়ে ধরে সেবারের মতো রক্ষা পেয়েছিলাম। 

অতএব একটা ক্লাসে যে শিক্ষার্থী কোনো কিছুতেই অংশগ্রহণ করে না বা করতে চায় না, তার মনের অবস্থা আমি বুঝি। কী কী কারণে আমরা কোনো কিছুতে অংশ নিতে ভয় পাই, কারণগুলো আগে খুঁজে বের করা যাক। 

১. কেন দরকার, বুঝি না

প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে হলে দল গঠন করতে হয়। সেজন্য কথা বলতে হবে আগ্রহী বন্ধুদের সঙ্গে। ছবি: স্বপ্ন নিয়ে
প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে হলে দল গঠন করতে হয়। সেজন্য কথা বলতে হবে আগ্রহী বন্ধুদের সঙ্গে। ছবি: স্বপ্ন নিয়ে

অনেক ছেলেমেয়েই সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নেওয়াকে অহেতুক মনে করে। আমরা ভাবি, এসবে অংশগ্রহণ করলে তো পরীক্ষায় আমার নম্বর বাড়বে না, কেউ আমাকে পারিশ্রমিক দেবে না, অযথা সময় নষ্ট করব কেন? 

২. অংশগ্রহণ করে যদি কিছু না পাই!

আমাদের মনে ভয় কাজ করে—একটা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে যদি ভালো কিছু করতে না পারি, তাহলে না জানি কী লজ্জায় পড়তে হবে! একে তো নিজের দুর্বলতাটা প্রকাশ পেয়ে যাবে, তার ওপর বন্ধুরা হয়তো টিটকারি দেবে। বলবে, কি রে, তুই নাকি ডাব্বা মেরেছিস!

৩. এসব করতে গিয়ে যদি পড়ালেখার ক্ষতি হয়?

আমাদের অনেকের মনেই ছোটবেলা থেকে একটা ধারণা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়—ছাত্রছাত্রীদের জন্য পড়ালেখা ছাড়া বাকি সব কাজই সময় নষ্ট। ‘খেলতে যেয়ো না, কোচিংয়ে যাও।’ ‘বিকেলবেলা কি গল্পের বই পড়ার সময়? যাও হোমওয়ার্ক করো!’ ‘পাশের বাসার অমুককে দেখো, একটুও সময় নষ্ট করে না। সারা দিন পড়ে।’ এসব শুনে আমরা অভ্যস্ত। তাই স্বাভাবিকভাবেই মনে হয়, কোনো কার্যক্রমে যুক্ত হলে যদি পড়ালেখার ক্ষতি হয়? যদি আমি পিছিয়ে পড়ি? 

৪. ‘টিম মেম্বার’ পাব কোথায়? 

বেশির ভাগ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে গেলে দল গঠন করতে হয়। সেটা বিজনেস কেস কম্পিটিশন, বিতর্ক কিংবা টেবিল টেনিস, যা-ই হোক না কেন। এসব কাজে যারা পটু, তারা নিজেরা আগেই দল বেঁধে ফেলে। বাকিরা তো আমার মতোই নবিশ। ওদের সঙ্গে দল করলে তো পাত্তাই পাব না। আবার যারা ভালো, তারা তাদের দলে আমাকে নেবে না। তাহলে আমি কী করব? এই দুশ্চিন্তা থেকেও আমরা অংশগ্রহণ করতে চাই না। 

৫. কীভাবে অংশগ্রহণ করতে হয় জানি না

যেকোনো প্রতিযোগিতা বা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করার কিছু পদ্ধতি আছে। কোনো কোনো জায়গায় নাম নিবন্ধন করতে হয়, কোথাও হয়তো সময়মতো হাজির হয়ে গেলেই চলে। কিন্তু আমরা অনেকেই নিয়মকানুনগুলো জানি না। কীভাবে খবর পাব, তা-ও জানি না। 

৬. ভয় লাগে

মঞ্চে দাঁড়িয়ে অনেকের সামনে কথা বলব, অনেক মানুষের দৃষ্টি থাকবে আমার দিকে—ওরেব্বাবা! ভাবলেই আমরা অনেক সময় ঘাবড়ে যাই। ছোটবেলা থেকে হয়তো এই অভিজ্ঞতা কখনো হয়নি। কিংবা একবার ক্লাসে সবার সামনে কথা বলতে গিয়ে এমন নাস্তানাবুদ হয়েছি যে আমার ভেতরে একটা ভয় ঢুকে গেছে। আমি হয়তো আর কখনো চেষ্টাই করিনি। 

৭. শুরুটা কীভাবে করব? 

এই প্রশ্নই সবচেয়ে বেশি ভোগায়। আমি তো কখনো কোথাও অংশগ্রহণ করিনি। কোনো ক্লাবে যোগ দিইনি, প্রতিযোগিতায় যাইনি। শুরু কীভাবে করব? আমি তো জানিই না, কোন কাজটা আমি পারি? কী আমার ভালো লাগে? 

আয়মান সাদিক
আয়মান সাদিক

ভয় থেকে জয়ের পথে

আমি কী করে বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নিতে শুরু করলাম, সেটা আগে বলি। বিতর্ক থেকে পালিয়ে বেঁচেছি, কিন্তু ক্লাসের প্রেজেন্টেশন থেকে তো পালানো যায় না। শুরুতে খুব ভয় লাগত। হাত ঘামত। মুখ শুকিয়ে যেত। এরপরও নিজের ওপর জোর করেই কয়েকটা বিজনেস কম্পিটিশনে অংশ নিলাম। শুরুর দিকে বেশ কয়েকবার হেরেছি। জেতার জন্য যে অংশ নিতাম, তা নয়। মনে হতো, প্রতিযোগিতা শেষ হলে বাঁচি! কিন্তু টানা কয়েকটা প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার পর মজা পেয়ে গেলাম। এরপর যখন বেশ কয়েকটা বড় প্রতিযোগিতায় পুরস্কার জিতে ফেললাম, তখন আফসোস হলো—কেন যে আরও আগে থেকেই শুরু করিনি! 

সমস্যাগুলোর কথা তো আগেই বলেছি। এবার সমাধান খোঁজা যাক। 

১. পড়ালেখার চেয়েও জরুরি

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নিয়েছি ঠিকই, কিন্তু এর গুরুত্বটা তখন এতটা বুঝতাম না। এখন যখন একটু ওপর থেকে পুরো বিষয়টা দেখি, তখন বুঝতে পারি, কখনো কখনো একাডেমিক শিক্ষার চেয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা আমার বেশি কাজে লেগেছে। মানুষের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয়, শিখেছি। নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। নিজের অজান্তেই এমন অনেক দক্ষতা গড়ে উঠেছে, যেগুলো আমাদের জন্য খুব জরুরি। 

২. জেতার আগে হারতে তো হবেই

তোমার আশপাশে যারা বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছে, খুব সফল হয়েছে, জিজ্ঞেস করে দেখো প্রত্যেকেরই শুরুতে পরাজয়ের অভিজ্ঞতা হয়েছে। তাই অন্তত হেরে যাওয়ার ভয়ে পিছিয়ে যেয়ো না। হারলে হয়তো অনেকে টিটকারি দেবে। কিন্তু খেয়াল করে দেখো, যারা নিরুৎসাহিত করে, তারা নিজেরাও আসলে অকর্মণ্য। যারা জয়ী হয়েছে, তারাও একসময় তোমার পথে হেঁটেছে। তারা জানে, জেতার আগে হারতে হয়। তাই তারা কখনো তোমাকে নিরুৎসাহিত করবে না। তুমি তাদের কথায় গুরুত্ব দিয়ো। 

৩. কে বলে সময় নেই

পড়ালেখায় মন দিলে আর কিছু করার সময় থাকে না, এটা খুবই ভুল ধারণা। সময় ব্যবস্থাপনাও একটা দক্ষতা, সেটাও তো তোমাকে শিখতে হবে। বাসায় হয়তো বলবে, তুমি সময় নষ্ট করছ। একবার একটা পুরস্কার এনে মাকে দেখাও, বাবাকে দেখাও, দেখবে তাঁদের চেয়ে খুশি আর কেউ হবে না। পুরস্কার যদি না-ও পাও, সারা দিন কী কী হলো, তুমি কী কী কাজ করলে, মা-বাবার কাছে সেই গল্পটা বলো। তুমি হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অনুষ্ঠানের জন্য বড় অঙ্কের একটা স্পনসর জোগাড় করে ফেলেছ, বন্ধুরা মিলে হয়তো ক্যাম্পাসের সব চেয়ে বড় প্রতিযোগিতাটা আয়োজন করছ—মা-বাবাকে সেটা জানাও। সম্ভব হলে তোমার অনুষ্ঠান দেখতে নিয়ে যাও। নিশ্চয়ই তাঁরা উৎসাহ দেবেন। 

৪. তোমার উৎসাহের কথা জানাও

ক্লাসে নিশ্চয়ই তোমার মতো আরও কয়েকজনকে পাবে। দলের সবাই না হয় আনাড়ি হলো, না হয় সবাই একসঙ্গেই একটু একটু করে শিখলে, তাতে কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু আগে তো তোমার আগ্রহের কথা সবাইকে জানাতে হবে। আর এখন ফেসবুক, মেসেঞ্জারের সুবাদে একটা দল করা তো খুব সহজ! মেসেঞ্জারে গ্রুপ খুলেই তো আলাপ শুরু করতে পারো। 

৫. উপায় আছে অনেক

বিভিন্ন প্রতিযোগিতা, সুযোগের কথা জানা এখন সহজ। ফেসবুকে কয়েকটা পেজে লাইক দিয়ে রাখো। আমাদের ওসামা বিন নূরের ইয়ুথ অপরচুনিটিজের ওয়েবসাইট (www.youthop.com) দেখতে পারো। আর সবচেয়ে সহজ পথ হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাবগুলোর সঙ্গে যুক্ত থাকা। যারা নানা ধরনের কার্যক্রমে অংশ নেয়, তাদের দলে যোগ দাও। দেখবে সময়মতো সব খবরই তুমি পাবে। 

৬. শেখা ও জানা

আমাদের ভয় আসলে অজ্ঞতার। আমি জানি না, আমি কখনো শিখিনি—এ কারণেই ভয় পাই। এখন শেখার কত রকম সুযোগ আছে! ইউটিউবে অজস্র টিউটোরিয়াল পাবে। আমাদের টেন মিনিট স্কুলের ওয়েবসাইট দেখে শিখতে পারো। সিনিয়রদের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে পারো। তোমার যদি আগ্রহ থাকে, তাহলে দেখবে অন্যরাও তোমাকে আগ্রহ নিয়ে সাহায্য করবে। 

৭. উত্তর নিজেই খোঁজো

কীভাবে শুরু করবে—এই প্রশ্নের উত্তর আমি দেব না। উত্তরটা তোমাকে খুঁজতে হবে। কারণ তুমিই তোমাকে চেনো, তোমার মা-বাবা-বন্ধু-বড় ভাইয়া, আপুরা তোমাকে চেনে। আমি কিন্তু তোমাকে চিনি না। বড়দের সঙ্গে কথা বলো। তোমার কীসে আগ্রহ, কীভাবে তুমি শুরু করতে পারো, সেটা তুমিই বের করো। কারণ, দিন শেষে ‘শুরু’ তোমাকেই করতে হবে।