ভারী ব্যাগ নিয়ে ৯ তলায় হেঁটে ওঠে শিক্ষার্থীরা

মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম তলা ভবন। ছবিটি সম্প্রতি তোলা। ছবি: প্রথম আলো
মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম তলা ভবন। ছবিটি সম্প্রতি তোলা। ছবি: প্রথম আলো

পিঠে ভারী স্কুলব্যাগ। সিঁড়ির কাছে পৌঁছেই দীর্ঘশ্বাস। কারণ, সিঁড়ি ভেঙে বইয়ের বোঝা নিয়ে ৯ তলায় শ্রেণিকক্ষে উঠতে হবে। মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে সরেজমিনে দেখা যায় এ দৃশ্য।

এ নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের কষ্টের শেষ নেই। কারণ, স্কুল ভবনটি ৯ তলা হলেও লিফট নেই। বিষয়টি নিয়ে অভিভাবকেরা ক্ষুব্ধ হলেও তাঁদের বলার কিছু নেই। এ বিষয়ে প্রশ্ন তুললে সন্তানকে অন্যত্র নিয়ে যেতে বলা হয়। আর শিক্ষকেরা চাকরি রক্ষায় চুপ থাকেন।

অথচ সরকারের ইমারত নির্মাণ বিধি অনুযায়ী ১৮ মিটার বা ৬০ ফুটের (৬ তলা) ওপর কোনো ভবন নির্মাণ করতে হলে লিফট থাকাটা বাধ্যতামূলক। শিশু–কিশোরদের এ প্রতিষ্ঠানে সেই আইন মানা হচ্ছে না। ভবনের নকশায় লিফট রাখার কথা ছিল।

রাজধানীর মতিঝিলে এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান শাখা। সেখানে শিক্ষার্থী প্রায় ১১ হাজার। গড়ে একজন শিক্ষার্থী বেতনসহ বিভিন্ন খাতে বছরে কমপক্ষে ১৮ হাজার টাকা দেয়। এই হিসাবে আয় বছরে প্রায় ২০ কোটি টাকা। এ ছাড়া বেসরকারি একটি ব্যাংকে স্কুলের নামে রয়েছে ২০ কোটি টাকার স্থায়ী আমানত।

একাধিক শিক্ষক জানালেন, ভবনটি ৯ তলা করা হয় ২০১৪ সালে। এ পর্যন্ত প্রায় চার কোটি টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। কিন্তু বলা হচ্ছে, লিফট বসানোর টাকা নেই। আর এ জন্য অর্ধযুগ ধরে কষ্ট পোহাচ্ছে এখানকার শিক্ষার্থীসহ অন্যরা।

১৪ অক্টোবর বেলা ১১টার দিকে ভবনের নবম তলায় বিজ্ঞানের ক্লাস চলছিল। ওই শিক্ষক কিছুদিনের মধ্যে অবসরে যাবেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, সিঁড়ি বেয়ে এত ওপরে উঠে ক্লাস নিতে কষ্ট তো হবেই।

শ্রেণিকক্ষের একাধিক ছাত্রীর কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে সবার অভিন্ন বক্তব্য ছিল, সিঁড়ি ভাঙতে তাদের কষ্ট হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অন্তত পাঁচজন অভিভাবক এ প্রতিবেদককে বলেন, বাসায় ফিরে তাঁদের সন্তানেরা ক্লান্ত, অবসন্ন থাকে। সিঁড়ি ভাঙার ভয়ে ছাত্রীদের কেউ কেউ প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট সময় স্কুলে যেতে চায় না। স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির একজন সদস্য এমনও বলেছেন, সমস্যা হলে অন্য স্কুল-কলেজ দেখতে পারেন। শিক্ষার্থীর অভাব নেই।

প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সেলিনা শামসী বলেন, নানা কারণে এত দিন লিফট লাগানো যায়নি। তবে সম্প্রতি একটি বেসরকারি ব্যাংকের কাছে তাঁরা লিফট বসানোর জন্য অনুদান পাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। ব্যবস্থাপক বিষয়টি বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছেন।

ভবনে লিফট বসানোর সুযোগ আছে বলে জানান কলেজ শাখার সহকারী অধ্যাপক ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য হামিদুল হক খান। তিনি এবং স্কুল শাখার সহকারী প্রধান শিক্ষক শহীদুল ইসলাম তা দেখানোর জন্য এ প্রতিবেদককে ভবনের ছাদের এক পাশে একটি কক্ষে নিয়ে যান। তালা খোলার পর দেখা গেল, লিফটের নির্ধারিত স্থানে পরীক্ষার পুরোনো খাতাপত্র জমিয়ে রাখা হয়েছে।

>

মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ
ছয়তলা ভবনকে নয়তলা করা হয়েছে
টাকার অভাব নেই
কিন্তু গত ছয় বছরে একটি লিফট লাগানো হয়নি

গণপূর্ত অধিদপ্তর ও রাজউকের একাধিক কর্মকর্তা এবং স্কুলের দুজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ৬ তলা ভবনটি ৯ তলা করার সময় লিফট বসানোর বিষয়টি বারবার সামনে আসে। কিন্তু পুরো বিষয়টির নিয়ন্ত্রণ ছিল স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আওলাদ হোসেনের হাতে। তিনি প্রায় ১১ বছর ওই কমিটির সভাপতি। গত ছয় বছরে লিফট বসানো নিয়ে পরিচালনা কমিটি কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওলাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি কখনো স্কুলের কোনো বিষয় নিজ নিয়ন্ত্রণে রাখেননি। পরিস্থিতিগত কারণে অতীতে লিফট বসানোর দরপত্র আহ্বান করা হয়নি। সেই পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বিস্তারিত কিছু বলতে চাননি।

 নকশায় লিফট ছিল

নিয়ম অনুযায়ী, এ ধরনের ভবন নির্মাণের জন্য রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনুমোদিত নকশার প্রয়োজন হয়। কিন্তু এই ভবনটির জন্য নকশা (কাঠামোগত) অনুমোদন করে গণপূর্ত অধিদপ্তর। জানতে চাইলে গণপূর্ত অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সাধারণত সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবনগুলোর নকশা গণপূর্ত অধিদপ্তর অনুমোদন করে। এ স্কুলের জমিটি অধিদপ্তরের মালিকানায় ছিল। স্কুল কর্তৃপক্ষের আবেদনে ২০০৭ সালে নতুন ভবনের জন্য ৯ তলার কাঠামোগত নকশা অনুমোদন করে দেয় অধিদপ্তর। নকশায় লিফট বসানোর বিষয়ও নির্দিষ্ট ছিল।

অধিদপ্তরের মতিঝিল বিভাগীয় কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী হেলাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, চারতলা পর্যন্ত গণপূর্ত অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানেই (জমা কাজ হিসেবে) নির্মিত হয়। এরপর স্কুল কর্তৃপক্ষ তাদের কাছে কোনো আবেদন না করে ধাপে ধাপে ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ করে। তিনি বলেন, সরকারের ইমারত নির্মাণ বিধি অনুযায়ী, ভবনের উচ্চতা ৬০ ফুটের বেশি হলে লিফট থাকতেই হবে।

এলাকাটি রাজউকের অথরাইজড এলাকা–৬-এর অধীন। ২০১৪ সালে স্কুল ভবনের তলা বাড়ানোর সময় এলাকার অথরাইজড কর্মকর্তা ছিলেন ফজলুর রহমান। বর্তমানে অন্য মন্ত্রণালয়ে নিয়োজিত ওই কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তলা বাড়ানোর সময় রাজউকের কাছে ভবনটির বিষয়ে একটি নিরীক্ষা আপত্তি আসে। এর ভিত্তিতে তিনি ও তাঁর প্রতিনিধিদল ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। স্কুল কর্তৃপক্ষ তাঁদের কাছে গণপূর্ত অধিদপ্তরের নকশা দেখালে তাঁরা নিরাপত্তা বজায় রেখে ভবন নির্মাণ ও ছাত্রছাত্রীদের খেলাধুলার পর্যাপ্ত স্থান রাখার অনুরোধ করে ফিরে আসেন।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে এ ধরনের অনিয়ম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ের কাছে এবং বাণিজ্যিক এলাকার মধ্যে এমন একটি অন্যায়ের দায় কেবল সরকারের না। প্রথম এই দায় হচ্ছে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির। দ্বিতীয় দায় নকশাদাতা গণপূর্ত অধিদপ্তরসহ নজরদারির দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর। এরপর আসে মন্ত্রণালয়ের দায়। তিনি আরও বলেন, একটি বয়সের মেয়েদের জন্য বয়ঃসন্ধিকালীন বিষয় পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু বড়দের মনসিকতায় পরিবর্তন আসেনি। পুরো বিষয়টির দায় এবং ইমারত নির্মাণ বিধি লঙ্ঘনের শাস্তি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এড়াতে পারেন না।