সিনেমা যখন পড়ার বিষয়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে পড়া শেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির টিশ স্কুল অব দ্য আর্টসে পরিচালনা ও প্রযোজনা বিষয়ে পড়েছেন রেজওয়ান শাহরিয়ার (সামনে, বাঁ থেকে প্রথম)। ছবি: সংগৃহীত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে পড়া শেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির টিশ স্কুল অব দ্য আর্টসে পরিচালনা ও প্রযোজনা বিষয়ে পড়েছেন রেজওয়ান শাহরিয়ার (সামনে, বাঁ থেকে প্রথম)। ছবি: সংগৃহীত

ধরুন, হঠাৎই একদিন আপনার মাথায় ভর করল সিনেমা বানানোর পোকা। মনে মনে ঠিকও করে ফেললেন, আপনি আসলে চলচ্চিত্র নির্মাতাই হতে চান। কিন্তু আপনার পড়ার বিষয় হয়তো নৃবিজ্ঞান, প্রকৌশল, ব্যবসায় শিক্ষা, কিংবা অন্য কিছু, যার সঙ্গে সিনেমার কোনো সম্পর্ক নেই। পড়ার বইয়ে আর আপনার মন বসে না। ক্লাসে বসেও আপনি হয়তো দুর্দান্ত কোনো ‘ফ্রেম’ দেখতে পান!

চাইলে নিজের আগ্রহের বিষয়টাকেই কিন্তু পড়ার বিষয় বানিয়ে ফেলতে পারেন। আবেদন করতে পারেন বিশ্বের প্রথম সারির ফিল্ম স্কুলগুলোতেও। 

কোথায় পড়ব?

বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ত্রিশালের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়—এই তিনটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেমা বিষয়ে পড়ানো হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (আইইউবি), স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস, বাংলাদেশ (ইউল্যাব), গ্রিন ইউনিভার্সিটি, কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে চলচ্চিত্রবিষয়ক কোর্স রয়েছে। আইইউবির মিডিয়া ও যোগাযোগ বিভাগের চেয়ারপারসন জাকির হোসেন জানান, তাঁরা নিয়মিত সিনেমার ওপর সেমিনার আয়োজন করেন। এসব সেমিনারে চলচ্চিত্র নিয়ে আগ্রহী যে কেউ অংশ নিতে পারেন। এখানে ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ফিল্ম স্কুল থেকেও শিক্ষকেরা আসেন।

আছে বিসিটিআই আর পাঠশালা 

২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ সিনেমা অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট। এখানে চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রশিক্ষণের ওপর ২ বছর মেয়াদি পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা কোর্স করানো হয়। বিসিটিআইয়ের ডিপ্লোমার জন্য দুই বছরে একজন শিক্ষার্থীর খরচ হয় ৬০ হাজার টাকা। অন্যদিকে চার সেমিস্টারে সিনেমা বানানোর জন্য ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে একজন শিক্ষার্থীকে প্রায় ৩ লাখ টাকা দেওয়া হয়। সপ্তাহে ৫ দিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ক্লাস হয়। প্রতিটি ব্যাচকে ইনস্টিটিউটের খরচে একবার ভারতের রামুজি ফিল্ম সিটির মতো জায়গা ঘুরিয়ে আনা হয়। এখানে ডিপ্লোমা শেষে একজন শিক্ষার্থীর নিজের ৩ থেকে ৪টি ছবি থাকে। 

অন্যদিকে ঢাকার পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউটে চলতি বছর থেকে ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশনে ১৮ মাস মেয়াদি স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা শুরু হয়েছে। তা ছাড়া সিনেমা নির্মাণের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে ৬ মাসের কোর্সও করানো হয়। 

আছে গুগল আর ফেসবুক 

প্রযোজক ও নির্মাতা আরিফুর রহমান পড়েছেন এশিয়ান ফিল্ম একাডেমি, বুসান ও এশিয়ান ফিল্ম স্কুলে। বেশ কিছু আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম ও ফিল্ম বাজারে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। বর্তমানে আছেন যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে। তিনি বলেন, ‘সিনেমা নিয়ে পড়তে চাইলে প্রথমে গুগল করে দেখে নিতে পারেন, বিশ্বের সেরা ফিল্ম স্কুল কোনগুলো। সেই স্কুলের ওয়েবসাইটে ঘেঁটে কোন বিষয়ে আপনি পড়তে চান, সেটা ঠিক করুন।’ অধিকাংশ স্কুলের ফেসবুক কমিউনিটি থাকে। সেই কমিউনিটিতে দু-একজন বাংলাদেশিও পেয়ে যেতে পারেন। যেমন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলেসের (ইউসিএলএ) স্কুল অব থিয়েটার, ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন থেকে পড়েছেন বাংলাদেশের নায়লা আজাদ, বিজন ইমতিয়াজ ও সাদিয়া খালিদ।  

পরিচালক ফ্রান্সিস কোপোলা, আলেক্সান্ডার পেনদের ক্লাস করা নির্মাতা বিজন ইমতিয়াজ বলেন, ‘তাঁরা যে আমাকে ক্লাসে তাঁদের দর্শন বা সিনেমা বানানো শিখিয়ে দিয়েছেন, তা নয়। তাঁরা শুধু নিজেদের অনুভব শেয়ার করে আমার নিজেকে বুঝতে সাহায্য করেছেন। একজন নির্মাতার নিজেকে জানা, অনুভূতিকে বোঝা আর বিশ্লেষণ করতে পারা জরুরি।’ 

সুমিতের সিনেমা শিক্ষা 

রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট থেকে পড়াশোনা শেষ করে চলচ্চিত্র পড়তে উড়াল দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির টিশ স্কুল অব দ্য আর্টসে পরিচালনা ও প্রযোজনা বিষয়ে। চারবার অস্কার মনোনয়ন পাওয়া হলিউড পরিচালক চার্লি কফম্যান, অস্কারজয়ী মার্কিন পরিচালক মার্টিন স্করসেসি থেকে শুরু করে অভিনেতা জেমস ফ্র্যাঙ্কো, লেডি গাগাসহ অনেকেই পড়েছেন এখানে। মার্কিন পরিচালক স্পাইক লি ছিলেন তাঁদের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর। তাঁর মতে, এই স্কুল যে তাঁকে নির্মাতা বানিয়েছে, তা নয়। তবে এই স্কুল থেকে তিনি কিছু বন্ধু পেয়েছেন, যাঁরা তাঁর নির্মাতা সত্তার সঙ্গে জড়িত। তাঁরা সুমিতের কাজ নিয়ে অকপট মন্তব্য করেন, যেটা জরুরি। 

একবার নাকি বিখ্যাত মার্কিন অভিনেতা ও পরিচালক আল পাচিনোর সঙ্গে একই লিফটে নামছিলেন সুমিত। নিচে পৌঁছে যাওয়ার পর সুমিত আল পাচিনোকে আগে বেরোনোর ইঙ্গিত করে বলেন, ‘ইউ ফার্স্ট’। আর আল পাচিনো বলেন, ‘নো, আফটার ইউ’। সেই কয়েক মুহূর্ত সুমিতের কাছে অনেক বড়! 

লেখাপড়া মূল কথা নয় 

মীনালাপখ্যাত নির্মাতা সুবর্ণা সেঁজুতির স্নাতক ও স্নাতকোত্তর অর্থনীতিতে। তিনি মনে করেন, যেকোনো বিষয়ের পড়াশোনা, বা যেকোনো বই একটি মানুষকে নির্মাতা হিসেবে গড়ে তোলে। সুবর্ণা অবশ্য পরে পুনের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট ইন্ডিয়া থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ ও চিত্রনাট্য লেখার ওপর স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা করেছেন। তিনি জানালেন, ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশন্স (আইসিসিআর) এর বৃত্তি নিয়ে  ভারতের ফিল্ম স্কুলগুলোতে পড়া যায়। ডিসেম্বর বা জানুয়ারি মাসে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। স্নাতক শেষে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে নির্বাচিত হতে পারেন।

আয়নাবাজিখ্যাত পরিচালক অমিতাভ রেজা চৌধুরী মনে করেন, নির্মাতা হওয়ার জন্য এই সংক্রান্ত লেখাপড়া জরুরি নয়। অমিতাভ রেজা পুনেতে পড়তে গিয়েছিলেন অর্থনীতি বিষয়ে। সেখানে প্রচুর সিনেমা দেখে তাঁর নির্মাতা হওয়ার চোখ, মন তৈরি হয়। নির্মাতা হওয়ার জন্য সিনেমা দেখার বিকল্প নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন তো আর সিনেমা দেখার জন্য পুনেতে যাওয়ার দরকার নেই!’

সিনেমা বানানোর প্রস্তুতি সম্পর্কে পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর মন্তব্যও টুকে রাখার মতো। তিনি বলেন, ‘চলচ্চিত্র নিয়ে আমি কোথাও পড়িনি। ভুল করতে করতে শিখেছি। ভুলগুলোই আমার শিক্ষক। বই নয়, মানুষ পড়ে পড়ে আমি চলচ্চিত্র নির্মাণ শিখেছি। তবে হ্যাঁ, জীবনের একটা সময়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাবলিক লাইব্রেরিতে বসে থাকতাম। প্রয়োজনীয়, অপ্রয়োজনীয় সব রকম বই পড়েছি। সেটাও হয়তো কাজে লেগেছে।’