বিকেএসপিতে পড়ার স্বপ্ন যাদের

শুধু পড়ালেখা নয়, শৃঙ্খলার শিক্ষাও দেয় বিকেএসপি। ছবি: স্বপ্ন নিয়ে
শুধু পড়ালেখা নয়, শৃঙ্খলার শিক্ষাও দেয় বিকেএসপি। ছবি: স্বপ্ন নিয়ে

দুই দশক আগেও বাংলাদেশে হয়তো পেশাদার ক্রীড়াবিদ হওয়ার কথা লোকে ভাবত না। এখন ভাবে। ভালো খেলতে পারলে অর্থকড়ির সঙ্গে মেলে যশ-খ্যাতি! অভিভাবকেরাও চান, সন্তান খেলোয়াড় হোক। কিন্তু সে জন্য চাই খেলোয়াড় তৈরির উপযোগী উন্নত অবকাঠামো, সুন্দর পরিবেশ ও সঠিক গাইডলাইন।

এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদের প্রথম পছন্দ বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি)। যে প্রতিষ্ঠান থেকে উঠে এসে বিশ্ব ক্রিকেট মাতাচ্ছেন সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিমদের মতো ক্রিকেটাররা। বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট অধিনায়ক ও বর্তমানে জাতীয় সংসদ সদস্য নাঈমুর রহমান দুর্জয়ও ছিলেন বিকেএসপির ছাত্র।

শুধু ক্রিকেট নয়, সব খেলাতেই আছে খেলোয়াড় তৈরির কারখানার ছাত্রছাত্রীদের প্রাধান্য। ফুটবলে উঠে এসেছেন মাসুদ রানা, হাসান আল মামুন, ফিরোজ মাহমুদ, মামুনুল ইসলামের মতো তারকারা; যাঁরা দীর্ঘ সময় দেশের ফুটবলে পতাকা বহন করেছেন। হকিতে আছেন মামুনুর রশিদ, রাসেল মাহমুদরা। এ ছাড়া একক খেলাগুলোতে তৈরি হয়েছেন শুটার আসিফ হোসেন, আবদুল্লাহ হেল বাকি, সাঁতারু মাহফুজার আক্তার শিলার মতো তারকারা।

বিকেএসপি শুধু খেলোয়াড় তৈরির কারখানা হিসেবে পরিচিত পেলেও এর ব্যাপ্তি এখন অনেক বড়। কঠোর শৃঙ্খলার মধ্যে বেড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানটির ছাত্র-ছাত্রীরা সামরিক বাহিনীতেও নিজেদের যোগ্যতার ছাপ রাখছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা, আধুনিক কোচ, বৈমানিক, মনোবিদসহ অন্যান্য সম্মানজনক পেশাতেও বিচরণ করছে বিকেএসপির ক্যাডেটরা।

বিশেষ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসার পদে কীভাবে আরও বেশিসংখ্যক ক্যাডেট যোগ দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে, সে লক্ষ্যে নতুন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বর্তমান প্রশাসন।

তাঁরা ছিলেন বিকেএসপির ছাত্র। বাঁ থেকে ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিম, ফুটবলার মামুনুল ইসলাম ও শ্যুটার আবদুল্লাহ হেল বাকি
তাঁরা ছিলেন বিকেএসপির ছাত্র। বাঁ থেকে ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিম, ফুটবলার মামুনুল ইসলাম ও শ্যুটার আবদুল্লাহ হেল বাকি

আছে যেসব খেলার সুযোগ

ক্রিকেট, ফুটবল, অ্যাথলেটিকস, আর্চারি, সাঁতার, কারাতে, বক্সিং, জুডো, উশু, জিমন্যাস্টিকস, বাস্কেটবল, টেনিস, হকি, ভলিবল, তায়কোয়ান্দো, শুটিং ও টেবিল টেনিস—এই ১৭টি খেলায় আধুনিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে বিকেএসপিতে।

ভর্তি পরীক্ষায় সময়

৩ জানুয়ারি থেকে শুরু হবে দেশব্যাপী বাছাইপ্রক্রিয়া। প্রথমবারের মতো বাছাইপ্রক্রিয়ায় এসেছে নতুনত্ব। এত দিন ঢাকার মূল শাখায় উপস্থিত থেকে পরীক্ষা দেওয়ার নিয়ম থাকলেও ভর্তি-ইচ্ছুকদের সুবিধার কথা ভেবে এবারই প্রথম আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দিনাজপুর, বরিশাল, খুলনা, সিলেট ও চট্টগ্রামে প্রাথমিক নির্বাচনী পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া একজন ভর্তি-ইচ্ছুক পরীক্ষার্থী এবার একাধিক খেলার ওপর পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাবে। বাছাইপ্রক্রিয়ার বিস্তারিত জানা যাবে প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে: bksp.gov.bd

ভর্তির নিয়মকানুন

সাধারণত চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে আসন খালি থাকা সাপেক্ষে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। অনূর্ধ্ব-১৪ বছর বয়সী শিক্ষার্থীরা ভর্তির সুযোগ পাবে। তবে কয়েকটি বিষয়ে আছে শিথিলতা। ক্রিকেটে পেস বোলারদের ক্ষেত্রে বয়স, অ্যাথলেটিকসে প্রতিভাবানদের ক্ষেত্রে নবম শ্রেণি ও আর্চারিতে মেয়েদের ক্ষেত্রে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিথিলযোগ্য।

বিকেএসপির প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে নির্দিষ্ট দিনে প্রশিক্ষণার্থীদের ভর্তি বাছাই প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রাথমিক বাছাইয়ে সাধারণত স্বাস্থ্য ও বয়স দেখা হয়। প্রাথমিক বাছাইয়ের দ্বিতীয় পর্বে দেখা হয় শারীরিক সক্ষমতা। তৃতীয় পর্বে শিক্ষার্থীকে মাঠে পাঠানো হয়। সেখানে আবেদন অনুযায়ী নেওয়া হয় ব্যবহারিক পরীক্ষা। প্রাথমিক বাছাইয়ে উত্তীর্ণদের পরবর্তী সময় সাত দিনের বাছাই ক্যাম্পে ডাকা হয়। সপ্তাহব্যাপী সকাল-বিকেল অনুশীলনের পর নেওয়া হয় লিখিত পরীক্ষা। মোট ১০০ নম্বরের পরীক্ষায় খেলা ৭০, লিখিত পরীক্ষায় (বাংলা, ইংরেজি ও গণিত) ২০ ও ক্রীড়াবিজ্ঞানে ১০।

স্বাস্থ্য পরীক্ষা (প্রথম ধাপ)

প্রথমেই স্বাস্থ্য পরীক্ষা। সেখানে প্রতিষ্ঠানটির চিকিৎসকেরা নির্ধারণ করে থাকেন আবেদনকারীর বয়স, উচ্চতা, ওজন ও শারীরিক কোনো ত্রুটি আছে কি না। স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ‘ইয়েস’ কার্ড পেলেই আবেদনকারী নিজ নিজ খেলার মাঠে গিয়ে শারীরিক সক্ষমতা ও ব্যবহারিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে। অর্থাৎ যে ক্রিকেটে আবেদন করেছে, সে যাবে ক্রিকেট মাঠে। যে ফুটবলে, সে যাবে ফুটবল মাঠে।

শারীরিক সক্ষমতা (দ্বিতীয় ধাপ)

আবেদন অনুযায়ী নিজ নিজ মাঠেই হয়ে থাকে শারীরিক সক্ষমতার পরীক্ষা। সাধারণত দেখা হয় স্পিড (গতি), স্ট্রেংথ (শক্তি), অ্যান্ডুরেন্স (দম), এজিলিটি (ক্ষিপ্রতা), ব্যালান্স (ভারসাম্য), ফ্লেক্সিবিলিটি (নমনীয়তা)।

ব্যবহারিক পরীক্ষা (তৃতীয় ধাপ)

সাত দিনব্যাপী দ্বিতীয় দফায় চূড়ান্ত লড়াইয়ে জায়গা করে নেওয়ার জন্য ব্যবহারিক পরীক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবেদনকারীদের খেলা অনুযায়ী নেওয়া হয় ব্যবহারিক পরীক্ষা। যেমন ক্রিকেটে ভর্তি-ইচ্ছুকদের জন্য ব্যাটিং-বোলিং ড্রিল ও ফুটবলারদের জন্য স্কিল-গেম।

প্রাথমিক বাছাইয়ের জন্য এই তিনটি ধাপই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে এক দিনে। এখান থেকে বাছাই করে নেওয়া হয় সাত দিনব্যাপী বাছাই পরীক্ষায়।

সাত দিনব্যাপী বাছাইপর্ব

সপ্তাহব্যাপী বাছাইপর্বের ধাপটি পুরোপুরি আবাসিকভাবে পরিচালনা করা হয়। ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের বিকেএসপির নিজস্ব হোস্টেলে রেখে আয়োজন করা হয় চূড়ান্ত নির্বাচনী পরীক্ষা। সপ্তাহব্যাপী সকাল-বিকেল অনুশীলনে তাদের মেধা ও দক্ষতা গুরুত্বপূর্ণ। সঙ্গে লক্ষ করা হয় আবেদনকারীর আচার-আচরণ।

সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হতে চাইলে তার জন্য ষষ্ঠ শ্রেণির সিলেবাসে পরীক্ষা হবে। আবার যে প্রতিযোগী ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হতে ইচ্ছুক, তার জন্য পঞ্চম শ্রেণির সিলেবাস।

নিয়মকানুন তো সব জানাই হলো। তাহলে এবার ছেলে বা মেয়েকে দাঁড় করিয়ে দিন পরীক্ষার লাইনে—যদি ইচ্ছে থাকে ছেলে বা মেয়েটিকে মুশফিক, আসিফ, এমিলি বা শিলার মতো তারকা হিসেবে দেখার।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. রাশীদুল হাসান
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. রাশীদুল হাসান
‘ভর্তি-ইচ্ছুকদের সুবিধার জন্য এবারই প্রথমবারের মতো আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেধা যাচাইয়ের সুবিধার্থে একাধিক খেলায় পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। ভর্তি সংক্রান্ত যে কোনো বিষয়ে কেউ আর্থিক লেনদেনের প্রস্তাব দিলে সরাসরি প্রশাসনকে জানানোর অনুরোধ করা হলো। সেরাদের খুঁজে নিতে আমরা সব রকম চেষ্টা করতে চাই।’
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. রাশীদুল হাসান
মহাপরিচালক, বিকেএসপি