কখনো বোনের জন্য, কখনো প্রাণের জন্য বিতর্ক

ক্যাম্পাসে খাবার বিক্রি করে অসুস্থ বন্ধুর চিকিৎসার জন্য টাকা সংগ্রহ করেছিলেন ক্লাবের সদস্যরা। ছবি: সংগৃহীত
ক্যাম্পাসে খাবার বিক্রি করে অসুস্থ বন্ধুর চিকিৎসার জন্য টাকা সংগ্রহ করেছিলেন ক্লাবের সদস্যরা। ছবি: সংগৃহীত

রুম নম্বর ১৩০৫। সপ্তাহে দুদিন ঢাকার তিতুমীর কলেজের বিজ্ঞান ভবনের এই ঘরটিতেই আপনি একঝাঁক নবীন বিতার্কিকের দেখা পাবেন। কখনো তাঁদের যুক্তি-তর্কের বিষয় চলচ্চিত্র, কখনো ক্রিকেট, কখনোবা রাজনীতি কিংবা ইতিহাস।

সরকারি তিতুমীর কলেজ বিতর্ক ক্লাবের বয়স খুব বেশি নয়। ২০১৭ সালের ৭ মার্চ শুরু হয়েছিল যাত্রা। বছর তিনেকের মধ্যেই কলেজের ১৫০০ শিক্ষার্থীর পরিবার হয়েছে ক্লাবটি। অবশ্য সদস্য হওয়ার নিয়মটাও বেশ কঠিন। নানা ধাপ পেরিয়ে শিক্ষার্থীরা স্থায়ী সদস্য হওয়ার সুযোগ পান। ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি মাহবুব হাসান বলছিলেন, ‘২০১৯ সালে প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থী সদস্য হওয়ার আবেদন করেছিল। আমরা ১২টা দল করে দিয়েছিলাম। এর মধ্য থেকে যারা নিয়মিত বিতর্কে অংশ নেয়, এমন ২৫০ জনকে সদস্য করে নিয়েছি।’

বিতর্ক সংগঠনের প্রতি শিক্ষার্থীদের এতটা আগ্রহের কারণ অবশ্য ভিন্ন। শনিবার আর বৃহস্পতিবার নিয়ম করে হয় কুইজ প্রতিযোগিতা। কুইজ সাজানো হয় সব সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্ন দিয়ে। বিসিএস, ব্যাংক কিংবা করপোরেট চাকরি—সব প্রস্তুতি চলে সমানতালে। সাম্প্রতিক সব বিষয় নিয়ে হয় পাঠচক্র। সদস্যরাই বিভিন্ন বিষয় ভাগ করে আলোচনা করেন। আর এতেই শিক্ষার্থীরা ভিড় জমান ক্লাবে। তবে এ সবকিছুই চলে বিতর্কের ফাঁকে। এই শিক্ষার্থীদের দাপুটে বিতার্কিক হিসেবে গড়ে তুলতে বছরব্যাপী নানা প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়। গত বছরে আন্তবিভাগ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় ৪৪টি দল। আর কুইজ প্রতিযোগিতায় সাধারণ জ্ঞানের ঝাঁপি খুলে বসেছিল ৬০টি দল।

শুধু কলেজের ভেতরেই নয়, জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন প্রতিযোগিতাতেও ক্লাবটি বেশ সরব। অল্প সময়ের পথচলাতে ক্লাবের ঝুলিতে যোগ হয়েছে নানা অর্জন। ‘এনডিএফ বিডি জাতীয় বিতর্ক উৎসব-২০১৯’–এ বিতর্ক, কুইজ ও বারোয়ারিতে বিজয়ী হয়ে দেশের শ্রেষ্ঠ ক্লাবের স্বীকৃতি ছিনিয়ে নিয়েছে ক্লাবটি। ইউসিবি পাবলিক পার্লামেন্ট বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে নামী দলগুলোকে রীতিমতো টক্কর দিয়েছে তিতুমীর কলেজ বিতর্ক ক্লাব। ২৩তম জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দলকে পরাজিত করে দ্বিতীয় রাউন্ডে উত্তীর্ণ হয়েছেন এই ক্লাবের সদস্যরা। এই প্রতিযোগিতার দ্বিতীয় রাউন্ড শুরু হচ্ছে চলতি মাসেই।

সংগঠনের সদস্যরা
সংগঠনের সদস্যরা

অবশ্য ক্লাবের সদস্যদের কাছে জয়-পরাজয় নয়, প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়াই মুখ্য। ‘বিতর্ক আমাদের পরম সহিষ্ণুতা শেখায়। উদারতা ও মানবিকতা শেখায়। আমি মনে করি, একজন পূর্ণাঙ্গ বিবেকবান মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে তাঁকে অবশ্যই যুক্তিবাদী হতে হয়। আর তার জন্য বিতর্কের বিকল্প কিছু নেই।’ বলছিলেন বিতার্কিক ইসা ইসরাত; ক্লাবের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বও সামলাচ্ছেন তিনি।

তিতুমীর বিতর্ক ক্লাবের সদস্যরা অবশ্য শুধু বিতর্কেই সেরা নন। তাঁদের মানবিকতার প্রশংসা কলেজের সবার মুখে মুখে। রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী সাদিয়া সুলতানার ক্যানসারে আক্রান্তের সংবাদে শুধু ফেসবুক স্ট্যাটাস লিখে আর দুঃখ প্রকাশ করেই দায়িত্ব শেষ করেননি বিতার্কিকেরা। সাদিয়ার চিকিৎসার অর্থ সংগ্রহে আয়োজন করেন ‘ডিবেট ফর সিস্টার’ (বোনের জন্য বিতর্ক)। বিতর্কের বিষয় নির্ধারণ করা হয় ‘এই সরকার সর্বজনীন চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করবে’ মর্মে। টিকিটের মূল্য রাখা হয় ৫০ টাকা। শিক্ষার্থীরা দল বেঁধে চলে আসেন বিতর্ক উপভোগ করতে।

এখানেই শেষ নয়। সংগঠনের সদস্যরা অর্থ সংগ্রহের জন্য বাসায় খাবার রান্না করে এনে ক্যাম্পাসে বিক্রি করেছেন। টানা ১০ দিন-রাত চেষ্টা শেষে দেড় লাখ টাকা সাদিয়ার পরিবারের হাতে তুলে দেন বিতর্ক ক্লাবের সদস্যরা। যদিও শেষ অবধি বাঁচানো যায়নি সাদিয়াকে। ক্যানসারের কাছে হার মেনেছেন তিনি। তবে মানবিক আবেদনে সাড়া দিয়ে সাদিয়ার জন্য কিছু করার প্রচেষ্টা প্রশংসা কুড়িয়েছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের।

ক্লাবের উদ্দেশ্যও শুধু নামী বিতার্কিক তৈরি নয়। দিন শেষে একজন ভালো মানুষ তৈরিই মূল লক্ষ্য তিতুমীর বিতর্ক ক্লাবের। সে কথাই বলছিলেন ইসরাত। ‘আমরা এমন একটি ক্লাব প্রতিষ্ঠা করতে চাই, যার সদস্যরা যেন গর্ব করে বলতে পারেন, “হ্যাঁ, আমি তিতুমীর কলেজে পড়ি, যেখানে একটি প্রতিষ্ঠিত বিতর্ক ক্লাব রয়েছে। যে ক্লাবে রয়েছে শ্রেষ্ঠ বিতার্কিকেরা; যাঁরা শুধু বিতর্কের মঞ্চে নন, ব্যক্তিগত জীবনেও আদর্শ মানুষ। ”’