ভিনদেশিদের বাংলা শেখার মঞ্চ

ক্লাস শেষে আড্ডায় শিক্ষার্থীরা
ক্লাস শেষে আড্ডায় শিক্ষার্থীরা

‘আমি বাংলায় গান গাই, আমি বাংলার গান গাই,

আমি আমার আমিকে চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই...’

গাইছিলেন দক্ষিণ কোরীয়ার নাগরিক মিংজু। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ঢাকার ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের (আইইউবি) বাংলা ভাষা ইনস্টিটিউট (বিএলআই) একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে। চলছিল তারই প্রস্তুতি। প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে বসবাসরত ভিন্ন দেশের নাগরিকদের মধ্যে বাংলা ভাষা ছড়িয়ে দিতে কাজ করছে আইইউবির এই অনুষদ। শুদ্ধ বাংলা চর্চার পাশাপাশি বাঙালির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে ভিনদেশি শিক্ষার্থীদের ধারণা দিতেও সাহায্য করেন তাঁরা

যেভাবে শুরু

ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের (আইইউবি) সাবেক উপাচার্য বজলুল মবিন চৌধুরী ও তাঁর বন্ধু টনি কে স্টুয়ার্টের হাত ধরে ২০০৬ সালে যাত্রা শুরু হয় বিএলআইয়ের। মার্কিন অধ্যাপক টনি কে স্টুয়ার্ট বাংলাদেশে এসে বাংলা শিখতে গিয়ে বেশ বিড়ম্বনায় পড়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, আর কোনো বিদেশিকে যেন বিড়ম্বনায় পড়তে না হয়। সেই ভাবনা থেকেই বিএলআইয়ের জন্ম।

মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্রিটিক্যাল ল্যাঙ্গুয়েজ স্কলারশিপ কার্যক্রমের অধীনে আইইউবির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে চালু করা হয় বাংলা সামার ইনস্টিটিউট। পরে নাম পরিবর্তন করে বাংলা ভাষা ইনস্টিটিউট (বিএলআই) রাখা হয়। শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত ছাত্র-ছাত্রীদের বাংলা শেখার সুযোগ থাকলেও বর্তমানে যে কেউ অনলাইন ও সরাসরি ক্লাস প্রোগ্রামে ভর্তি হতে পারেন। এই লম্বা সময়ে বিএলআই থেকে বাংলা শিখেছে দুই হাজারের বেশি শিক্ষার্থী। শুধু ক্লাসরুমের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ না রেখে শিক্ষার্থীদের হাতে–কলমে অক্ষর চেনানো ও বাক্য গঠনের উদ্দেশ্যে রাস্তার বিভিন্ন বিলবোর্ড ও পোস্টার থেকে অক্ষর খুঁজে বের করার উদ্দেশ্যে প্রায়শই ফিল্ড ট্রিপে নিয়ে যাওয়া হয়। বারো মাসে তেরো পার্বণের বাংলাদেশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পরিচয় করিয়ে দিতে আয়োজন করা হয় বিভিন্ন উৎসব। আগামী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সামনে রেখেও অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে, যেখানে বাংলা গান-কবিতার পাশাপাশি নিজ ভাষার গান-কবিতা পরিবেশন করবেন শিক্ষার্থীরা।

বাংলার প্রতি ভালোবাসা

বাংলা ভাষার গঠনশৈলীর প্রতি মুগ্ধতার কথা বললেন বিএলআইয়ের বেশ কয়েকজন বিদেশি শিক্ষার্থী। মার্কিন নাগরিক মারিয়া বলেন, ‘আমি এই দেশে বসবাস করছি। সেই হিসেবে মনে করি, বাংলা ভাষা শেখা আমার দায়িত্ব।’যুক্তরাষ্ট্রের জনাথন মনে করেন, একজন লেখক হিসেবে বাংলা সাহিত্য তাঁকে খুব টানে। বলছিলেন, ‘প্রথম যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা পড়ে মুগ্ধ হই, তখনই বাংলা শেখার সিদ্ধান্ত নিই। স্ত্রী তাতিয়ানাসহ বিএলআইতে বাংলা শিখতে ভর্তি হয়ে যাই।’ রবি ঠাকুরের ‘আমাদের ছোট নদী’ কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনালেন জনাথন। বাংলা শেখায় স্বামীকে যে তাতিয়ানা বেশ সহযোগিতা করেন, বোঝা গেল। কোনো শব্দে আটকে গেলেই পাশ থেকে শুধরে দিচ্ছিলেন তিনি।

ক্লাস শেষে আড্ডায় শিক্ষার্থীরা
ক্লাস শেষে আড্ডায় শিক্ষার্থীরা

ক্লাসের বাইরে ক্লাস

বিএলআইয়ের ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে আমরা তখন পা বাড়িয়েছি। হঠাৎ চোখে পড়ল, পাশের ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থী নেই, তবে ক্লাস চলছে! কীভাবে? শিক্ষক রেহানা পারভীনের সামনে রাখা একটি ল্যাপটপ, যার মাধ্যমে অনলাইনে ক্লাস করছিলেন শায়ের চৌধুরী নামের এক শিক্ষার্থী। শায়েরের মা-বাবা বাংলাদেশি হলেও তাঁর জন্ম যুক্তরাষ্ট্রে। ২০১৫ সালে তিনি বিএলআইতে ভর্তি হন। বিদেশ থেকেই অনলাইনে পাঠ গ্রহণ করে যাচ্ছেন তিনি। শায়ের জানালেন, তিনি তাঁর সন্তানকেও বাংলা ভাষা শেখাচ্ছেন। আর শিক্ষক রেহানা পারভীনের কাছ থেকে জানা গেল, এখন বাংলাদেশ ছাড়াও বিভিন্ন দেশ থেকে অনলাইনে প্রোগ্রামের মাধ্যমে ক্লাস করছেন ১৫ জন।

প্রিয় শব্দ

ক্লাস শেষে আড্ডা জমে উঠেছিল শিক্ষার্থীদের মধ্যে। আমরাও যোগ দিই তাঁদের সঙ্গে। জনাথন-তাতিয়ানা দম্পতি বইমেলায় যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন। এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করে বসি, বাংলা ভাষায় তাঁদের প্রিয় শব্দ কোনটা? নেপালি শিক্ষার্থী আইরিন উপাধ্যায়ের চটপট জবাব, ‘মিষ্টি।’ তাঁর মতে, বাংলাদেশের মিষ্টি খেতে যেমন সুস্বাদু, তেমনি ভাষাটাও বেশ মিষ্টি। তবে তাঁর পছন্দের খাবার কিন্তু মিষ্টি নয়, ফুচকা!

মারিয়া বাংলা ভাষার একটা বিশেষ দিকের কথা বললেন, ‘একটা শব্দের সঙ্গে আরেকটা শব্দ যোগ করা আমার কাছে ভালো লাগে। যেমন আমার নাম মারিয়া। কেউ হয়তো বলল “মারিয়া-টারিয়া”। কিংবা “চা-টা খাও”।’ এই যে চায়ের সঙ্গে টা যোগ হয়, এটাই মজার মনে হয় তাঁর কাছে। দক্ষিণ কোরীয় নাগরিক লোবন জানান, “মায়া” শব্দটি তাঁর খুব পছন্দের। আর লোবনের স্বদেশি মিংজুর প্রিয় শব্দ হলো ‘ভালোবাসি’। একবার স্ত্রীকে ভালোবাসি বলে চমকে দিয়েছিলেন তিনি।

মজার ঘটনা

বেশ কয়েক বছর ধরে ভিনদেশি শিক্ষার্থীদের পড়াতে গিয়ে বিএলআইয়ের তিন শিক্ষকের ঝুলিতে কত যে মজার ঘটনা জমা পড়েছে! একবার এক শিক্ষার্থী নাকি বিএলআই–এর প্রধান রিফাত মুনমুনের কাছে এসে বলেছিলেন, ‘আমি একটু নিচে যাব।’

 ‘কেন?’

 ‘ট্যায়া ভাংতি করতে।’ (টাকা ভাংতি করতে)

শুনে খুব অবাক হয়েছিলেন রিফাত। তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা যা শোনে, দ্রুত গ্রহণ করে ফেলে। তাই আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, কেউ যেন ভুল শব্দ না শেখে।’

শিক্ষকেরা জানালেন, শিক্ষার্থীদের বাংলা ‘তুই-তুমি-আপনি’-এর পার্থক্য বোঝাতে গিয়ে কখনো কখনো হিমশিম খান তাঁরা। ইংরেজি এক ‘ইউ’ শব্দের এত অর্থ হতে পারে, সেটা বোঝানোই মুশকিল!