উদ্যোগ ভালো, সমস্যা পড়ানো নিয়ে

২০১৭ সাল থেকে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় পাঠ্যবই দিচ্ছে সরকার। চলতি বছর পর্যন্ত পাঁচটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত নিজেদের মাতৃভাষায় লেখা পাঠ্যবই দেওয়া হয়েছে। কিন্তু উদ্যোগটি ভালো হলেও এসব বিষয়ে আলাদা শিক্ষক নিয়োগ করা হয়নি। প্রশিক্ষণের পরিস্থিতিও নাজুক। ফলে শিক্ষার্থীরা মাতৃভাষায় ভালোভাবে পড়ালেখা শিখছে না।

ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের কেবল তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত নিজেদের মাতৃভাষায় বই দেওয়া হচ্ছে। ফলে চতুর্থ শ্রেণিতে গিয়ে একজন শিশুকে আবারও সারা দেশের শিশুদের মতোই সাধারণ পাঠ্যবই পড়তে হচ্ছে। এর ফলে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির মধ্যে ‘সেতুবন্ধ’ (ব্রিজিং) তৈরিতে সমস্যা হচ্ছে।

মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষিক শিক্ষা (এমএলই) বিষয়ক কমিটির সদস্য মতুরা বিকাশ ত্রিপুরা প্রথম আলোকে বলেন, মাতৃভাষায় বই দেওয়াটি বড় পাওয়া। কিন্তু সীমাবদ্ধতা হলো যাঁরা পড়াচ্ছেন তাঁদের নিয়ে। 

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে পাঁচটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রাক্‌-প্রাথমিক স্তরের শিশুদের মাতৃভাষায় লেখা বই দিয়ে এ কার্যক্রম শুরু হয়। এই পাঁচটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলো হলো চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা (ককবরক), গারো ও ওঁরাও (সাদরি)। প্রাক্‌–প্রাথমিকের পর ২০১৮ সালে প্রথম শ্রেণি, গত বছর দ্বিতীয় শ্রেণি এবং চলতি বছর তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বইও মাতৃভাষায় ছাপিয়ে বিনা মূল্যে বিতরণ করা হয়। এ বছর এসব বই ছাপার জন্য খরচ হয়েছে ৬৮ লাখ ১৯ হাজার ৮৩৯ টাকা। 

দ্বিতীয় পর্যায়ে আরও ছয়টি মাতৃভাষায় বই দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে মণিপুরিদের জন্য দুটি ভাষায় বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতৈ এবং তঞ্চঙ্গ্যা, খাসি, বম ও ম্রো।

এনসিটিবির একাধিক শিক্ষা বিশেষজ্ঞ বলেছেন, মাতৃভাষায় বই দেওয়া হলেও বিদ্যালয়গুলোতে ঠিকমতো পড়ানো যাচ্ছে না। তার বড় কারণ শিক্ষকের অভাব। এনসিটিবির একজন সদস্য গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, তিনি নিজেই একবার খাগড়াছড়ির একটি বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখেন, বই থাকলেও তা পড়ানো হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত এসব ভাষায় পড়ানোর জন্য আলাদা শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া যায়নি। কিছু প্রশিক্ষণ দিয়ে চালানো হচ্ছে।

খাগড়াছড়ির ৯টি উপজেলায় ৭০৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। পানছড়ি উপজেলার দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় রহিন্দ্রপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কথা হয় তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী জুয়েল ত্রিপুরা ও মিথি ত্রিপুরার সঙ্গে। তারা শুনেছে, অন্য বিদ্যালয়গুলোতে মারমা ভাষায় বই পড়ানো হয়। কিন্তু তারা প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে আজ পর্যন্ত মাতৃভাষার বই চোখেও দেখেনি। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম বলেন, বিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী ত্রিপুরা। অথচ বিদ্যালয়ে এত দিন পর্যন্ত কোনো ত্রিপুরা শিক্ষক ছিলেন না। দুই দিন আগে একজন যোগ দিয়েছেন।

সদর উপজেলার ভাইবোনছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শ্রেণিতে পড়ে কৃষক আনাই মারমার ছেলে ক্যাজরিং মারমা। আনাই মারমা নিজেও মাতৃভাষার বই পড়তে পারেন না। বাড়িতেও ছেলেকে পড়ানোর মতো কেউ নেই। শুনেছেন বিদ্যালয়েও মারমা ভাষায় পড়াতে শিক্ষক নেই। আনাই মারমা বলছিলেন, অবস্থা এমন যে ছেলের বই বাড়িতেই পড়ে থাকবে। 

অবশ্য গত বুধবার সকালে খাগড়াছড়ি সদরের খাগড়াপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। এখানে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত সব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষিত শিক্ষকের মাধ্যমে পড়ানো হচ্ছে মাতৃভাষার বই।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে ১০০ জন শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারিভাবে জাবারাং উন্নয়ন সংস্থা থেকে এ পর্যন্ত চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা ভাষার ১৪৫ জন শিক্ষক ও উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

এনসিটিবির একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, দেশে কমবেশি ৪০টির মতো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী থাকলেও বেশির ভাগেরই নিজস্ব লিপি নেই। এমনকি সাঁওতালদের নিজস্ব লিপি না থাকায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের ক্ষেত্রে কোন লিপি গ্রহণ করা হবে, এ নিয়ে দ্বিধাবিভক্তির কারণে বই দেওয়া যায়নি। 

 ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সৌরভ শিকদার প্রথম আলোকে বলেন, এটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে সংশ্লিষ্ট মাতৃভাষার শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে এবং শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে হবে। শিক্ষকদের আগে এসব ভাষায় পড়তে ও লিখতে শেখানো দরকার। তাঁর পরামর্শ, নতুন করে আরও মাতৃভাষায় বই দেওয়ার আগে ইতিমধ্যে যেসব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী শিশুকে বই দেওয়া হয়েছে, তার সফলতা কতখানি, সেটা মূল্যায়ন হওয়া দরকার। 

[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি জয়ন্তী দেওয়ান]