বাংলা বিভাগে কেন পড়বেন, কী পড়ানো হয়, ক্যারিয়ার কোথায়

ইতিহাস, বিজ্ঞান, সাহিত্য, প্রকৌশল...কত রকম বিষয় আছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়। কোন বিষয়ে আমি পড়ব—সিদ্ধান্ত নেওয়াই কঠিন। আজ বাংলা নিয়ে লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক তারিক মনজুর

মানুষ হয়ে ওঠার পেছনে সাহিত্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে
মানুষ হয়ে ওঠার পেছনে সাহিত্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে
ছবি: খালেদ সরকার

বাংলা আসলে সবাই পড়ে। স্কুল-কলেজের পাঠ্য হিসেবে অন্তত বারো বছর বাংলা পড়তে হয় সবাইকে। কিন্তু কেন বাংলা পড়া হয়, তা হয়তো পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে পারবেন না আপনিও। বাংলায় যাঁরা স্নাতক বা স্নাতকোত্তর করেছেন, তাঁদের অনেকেই এই প্রশ্নের উত্তর জানেন না।

ভাষা শিক্ষার প্রথম কাজ যোগাযোগ। সেটা বাংলা ভাষাই হোক, আর ইংরেজি বা অন্য ভাষাই হোক। জ্ঞানকাণ্ডের বিভিন্ন শাখার সঙ্গে সংযোগ তৈরির উপায় হিসেবে ভাষা শিখতে হয়। সহজ করে বলি, অঙ্ক শেখার জন্য ভাষা শিখতে হয়, বিজ্ঞান পড়ার জন্য ভাষা শিখতে হয়—এটাই হলো মূল ব্যাপার। কিন্তু বাংলা শুধু ভাষা নয়।

বাংলা যখন সাহিত্য
‘মানুষ’ হয়ে ওঠার পেছনে সাহিত্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাহিত্য ব্যক্তির কল্পনা আর অনুভূতি নিয়ে কাজ করে। সাহিত্য পাঠের মাধ্যমে আপনি অন্যের প্রতি অনুভূতিশীল হয়ে উঠতে পারেন এবং বিভিন্ন উপাদানের আন্তসম্পর্ক বুঝতে পারেন। সাহিত্য আপনার তুলনা করার যোগ্যতা বাড়িয়ে দেয়, যুক্তিবোধ তৈরি করে এবং নতুন সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে।

কারা পড়তে পারে

বাংলাদেশে ইচ্ছা করলেই কেউ বাংলা পড়তে পারেন না। বাংলায় উচ্চশিক্ষা নিতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করতে হবে। শুধু বাংলা নয়, যেকোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে পড়তে চাইলে ভর্তির মেধাক্রমে আপনাকে ওপরের দিকে থাকতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষা বিষয় অনুযায়ী হয় না, হয় অনুষদভিত্তিক। এর মানে, মেধাক্রম অনুসারে পরীক্ষার্থীরা বিষয় পছন্দ করে নিতে থাকেন। এ ক্ষেত্রে বর্তমানে বাংলার চাহিদা ওপরের দিকে।

কী পড়ানো হয়
বাংলা বিভাগগুলোর সিলেবাস মূলত সাহিত্যনির্ভর। এখানে প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগের বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়। অন্যভাবে বলা যায়, বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিকের কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক ইত্যাদি পড়তে হয়। প্রাচীন যুগের চর্যাপদ–এর নাম হয়তো শুনেছেন, বাংলা বিভাগে ভর্তি হতে পারলে এবার এ সম্পর্কে বিস্তারিত পড়তে হবে। মধ্যযুগের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব কবিতা, শ্রীচৈতন্য, প্রণয় উপাখ্যান, মৈমনসিংহ গীতিকা, দোভাষী পুঁথি ইত্যাদি সম্পর্কে পড়তে হয়। বাংলা গদ্যের বিকাশে আধুনিক যুগে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ভূমিকা রয়েছে। এই পর্ব এবং এরপর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, বেগম রোকেয়া থেকে শুরু করে হাল আমলের কোনো লেখকই বাদ যান না আলোচনায়। প্রাচীন ভারতীয় রসতত্ত্ব এবং আধুনিক বিদেশি সাহিত্যের কিছু অনুবাদও পড়ানো হয়। বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা বাংলা কবিতার অলংকার-ছন্দ নিয়ে পড়েন, বাংলা ভাষার ইতিহাস পড়েন, ব্যাকরণ পড়েন, সাহিত্যের রূপ-রীতি পড়েন। তাঁদেরকে পুরোনো পাণ্ডুলিপিবিদ্যা কিংবা আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের কিছু অংশ পড়তে হয়, শিখতে হয় সাহিত্য সমালোচনা ও গবেষণার পদ্ধতিও। তবে শেখানোর পদ্ধতি আর শিখতে চাওয়ার আগ্রহের ঘাটতির কারণে প্রায় কিছুই শেখা হয় না তাঁদের। এ কারণে বাংলায় পড়েও কবিতা বুঝতে পারি না আমরা, সাহিত্য পড়েও লেখকের উদ্দেশ্য ধরতে পারি না, এমনকি নিজের উপযোগী গবেষণার ক্ষেত্রটিই আমরা বাছাই করতে পারি না।

ক্যারিয়ার কোথায়
বাংলা পড়ার সুবিধা হলো, প্রায় সব ধরনের চাকরির সুযোগ খোলা থাকে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়—কোথায় নেই বাংলা! ফলে শিক্ষকতা করার বিশাল ক্ষেত্র পড়ে রয়েছে বাংলার শিক্ষার্থীদের জন্য। বাংলায় উচ্চতর গবেষণার সুযোগ থাকায় এর মাধ্যমে দ্রুত ক্যারিয়ারের ওপরের ধাপে পৌঁছানো যায়। বাংলায় পড়ে সরকারি আমলা হতে বাধা নেই। বিসিএস পরীক্ষায় বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা খুব ভালো করেন। বিভিন্ন ব্যাংক-বিমা-এনজিও কিংবা সরকারি-বেসরকারি চাকরির সুযোগ তো থাকছেই। অনুষ্ঠান উপস্থাপনা, আবৃত্তি, লেখালেখি, সম্পাদনা, ভাষা-প্রশিক্ষণ—এ ধরনের কাজ বেশ ভালোভাবেই বাংলার সঙ্গে যায়।

ভবিষ্যৎ কী
এটা আসলে গুরুতর প্রশ্ন। স্কুল পর্যায় থেকেই বিষয় হিসেবে আমরা বাংলা পড়ি। অথচ বাংলা পড়ার মূল লক্ষ্য থেকে আমরা সব সময় দূরে রয়ে যাই। ভাষা হিসেবে বাংলা শিখতে দেরি হওয়ার কারণে অন্য বিষয়গুলোতেও শিক্ষার্থীদের পিছিয়ে পড়তে হয়। আবার নিজের স্বাধীন চিন্তা ও কল্পনাশক্তি কিংবা সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটাতে ব্যর্থ হচ্ছে বাংলা সাহিত্য। আমাদের স্কুল পর্যায়ে বাংলা শেখা মানে পাতার পর পাতা মুখস্থ করে যাওয়া। এর ফলে কোনো বিষয়কে বিশ্লেষণাত্মক ভঙ্গিতে যুক্তি দিয়ে লিখতে পারি না আমরা, পারি না ছোট চিন্তাকে দীর্ঘ করতে কিংবা দীর্ঘ বর্ণনাকে ছোটভাবে প্রকাশ করতে। অথচ কল্পনা ও অনুভূতিকে সমৃদ্ধতর করার জন্য, সমাজের বিভিন্ন উপাদানের আন্তসম্পর্ক বোঝার জন্য ও তুলনা করার জন্য, যুক্তি দাঁড় করাতে, অন্যের যুক্তিকে গ্রহণ-বর্জন করে নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারত। বাংলা পাঠক্রম, পাঠ্যপুস্তক আর প্রশ্নপদ্ধতি নিয়ে তাই এখনই ভাবতে হবে সবাইকে। নইলে বাংলা শুধু চাকরিনির্ভর একটি বিষয় হয়েই রয়ে যাবে।