ক্যাম্পাসের বইপ্রেমীরা

>

দেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়েই চালু আছে পাঠচক্র বা পাঠক সংগঠন। বইপড়ুয়ারা এখানে এক হয়ে বিভিন্ন বই নিয়ে আলোচনা করেন, আর এই সুযোগে বিস্তৃতি পায় তাঁদের জানার পরিধি। এমন কয়েকটি পড়ুয়াদের দলের সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দিচ্ছেন জাওয়াদুল আলম

ক্যাম্পাসের খোলা জায়গায় বসে বই পাঠের আসর। ছবি: সংগৃহীত
ক্যাম্পাসের খোলা জায়গায় বসে বই পাঠের আসর। ছবি: সংগৃহীত


চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতীতি
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ইসলামিক ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী মোরশেদুল ইসলাম ও তাঁর বন্ধুরা মিলে ২০১৮ সালে গড়ে তোলেন প্রতীতি। ছোটবেলা থেকেই বই পড়তে ভালোবাসতেন মোরশেদুল। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে দেখলেন, তাঁর সহপাঠীরা কেউই পাঠ্যপুস্তকের বাইরে আর কোনো বই পড়তে আগ্রহী নন। বিষয়টি খুব ভাবাত মোরশেদুলকে। নিজের ভাবনা তিনি ভাগাভাগি করে নেন বন্ধু ফয়সাল, দীদার, হাসিব আর প্রজ্ঞার সঙ্গে।

সবাই মিলে একটি পাঠচক্র চালু করার সিদ্ধান্ত নেন। তবে কিছুদিন পর বন্ধুবান্ধবেরা নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু মোরশেদুল হাল ছাড়েননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী আর কয়েকজন জুনিয়রকে নিয়ে আবার পাঠচক্রের কাজ শুরু করেন।

এরপর থেকে চবি ক্যাম্পাসে নিয়মিতভাবে প্রতি মাসে দুটি পাঠচক্রের আয়োজন করে আসছেন প্রতীতির সদস্যরা। মাসের শুরুতে এবং শেষে পাঠচক্র আয়োজিত হয় বলে জানান মোরশেদুল। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন লেখকের বই নিয়ে আলোচনা চলে প্রতিটি পাঠচক্রে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন পর্যন্ত ৩২টি পাঠচক্র হয়েছে।

শুরু থেকেই তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল, পাঠচক্রগুলোতে বই পাঠের পাশাপাশি জাতীয় ও বৈশ্বিক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা করবেন তাঁরা। সে অনুযায়ীই কার্যক্রম চলছে। কখনো কখনো বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষকেরাও পাঠচক্রে অংশ নেন।

মোরশেদুল জানান, শিক্ষকদের পাঠচক্রে আমন্ত্রণ জানানো হলেও কাউকেই প্রধান অতিথি কিংবা বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয় না। বরং পাঠচক্রে সবাইকেই ছাত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। তাঁরা মনে করেন, তাঁদের এই পাঠচক্র একটি মুক্ত আসর। তাই এখান থেকে যেকোনো মানুষই জ্ঞান আদান-প্রদান করতে পারেন।

সংগঠনের নিয়মিত সদস্য ৫০ জনের বেশি। এ ছাড়া প্রতীতির ফেসবুক গ্রুপে চলে বিভিন্ন বই অথবা লেখা নিয়ে মন্তব্য আদান-প্রদান। ফেসবুক গ্রুপের সদস্যও এক হাজার ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি থাকার সময়ও বই পাঠের এই কার্যক্রম থেমে থাকে না। ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার সময় সংগঠনটির সদস্যরা ব্যাগে করে নিজেদের বইগুলো নিয়ে যান। নিজ নিজ এলাকার বন্ধুবান্ধব ও স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েদের বইগুলো পড়তে দেন তাঁরা। ছুটি শেষে বইগুলো আবার ফেরত নিয়ে আসেন।

প্রতীতির প্রতিষ্ঠাতা জানান, সংগঠনটির নিজস্বভাবে সে রকম কোনো তহবিল নেই। তাই সংগঠনের সংগ্রহে কোনো বই নেই। মূলত নিয়মিত সদস্যদের নিজস্ব বইগুলো দিয়েই পাঠচক্রের আয়োজন করা হয়। তবে সংগঠনটির তহবিল বৃদ্ধি পেলে ভবিষ্যতে বই কিনে ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার চালু করার ইচ্ছা রয়েছে তাঁদের।

চাকরির পরীক্ষায় সাহিত্য অংশে যেন শিক্ষার্থীরা হোঁচট না খান, সেই লক্ষ্যে শুরু হয়েছিল পাঠক ফোরাম
চাকরির পরীক্ষায় সাহিত্য অংশে যেন শিক্ষার্থীরা হোঁচট না খান, সেই লক্ষ্যে শুরু হয়েছিল পাঠক ফোরাম


রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক ফোরাম
নব্বইয়ের দশকের একদম শুরুর দিকের কথা। চাকরির প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা, বিশেষ করে বিসিএস পরীক্ষায় তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থীরা বেশ পিছিয়ে। সেই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতেই পাঠচক্র শুরুর উদ্যোগ নেন রাবির তৎকালীন ছাত্র আরিফ হাসনাত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পাঠক ফোরাম নামে ১৯৯০ সালে যাত্রা শুরু করে সংগঠনটি।

চাকরির পরীক্ষায় সাহিত্য অংশে শিক্ষার্থীরা যেন হোঁচট না খান, সেই লক্ষ্যে তখন থেকে চালু হলো সাপ্তাহিক পাঠচক্র। বাংলা, ইংরেজি কিংবা অনুবাদ করা যেকোনো ধরনের বই পড়া হয় এই পাঠচক্রে। একেক আড্ডায় একেকজন উচ্চ স্বরে বই পাঠ করেন, আর অন্যরা মন দিয়ে শোনেন। পাঠচক্র শেষে আবার প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হয়ে থাকে। বইয়ের আলোচিত অংশ থেকে প্রশ্ন রাখা হয় শ্রোতাদের উদ্দেশে। সঠিক উত্তরদাতা প্রথম তিনজনকে উপহার হিসেবে দেওয়া হয় বই। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেডিয়াম–সংলগ্ন এলাকায় প্রতি সোমবার বিকেলে বসে সাহিত্যের এই আসর। পাঠক ফোরামের দীর্ঘদিনের এ আসরের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই এলাকাটি ফোরাম চত্বর নামেই সবার কাছে পরিচিত।

তবে সংগঠনটির পাঠচক্রের উদ্দেশ্য কি শুধুই চাকরির পরীক্ষায় ভালো করার জন্য সাহিত্যচর্চা? জানতে চেয়েছিলাম পাঠক ফোরামের সভাপতি আবদুল আলীমের কাছে। জবাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের স্নাতকোত্তরের এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমরা শুধু যে চাকরির পরীক্ষার জন্য সাহিত্য নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করি, ব্যাপারটি এমন নয়। আমরা পাঠচক্রে সব ধরনের বই নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করি।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের বুক ক্লাবের শুরু ১৯৯০ সালে। শুরু থেকে কত বই রিভিউ করা হয়েছে তা জানি না। তবে ২০১৭ সালে আমি যুক্ত হওয়ার পর থেকে প্রায় ১০০ বই রিভিউ করা হয়েছে।’

পাশাপাশি বিসিএস কিংবা অন্যান্য চাকরির পরীক্ষাগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় সাহিত্যচর্চার ওপর বেশ জোর দেওয়া হয়, যেন শিক্ষার্থীরা এই পাঠচক্রে আসতে আগ্রহী হন। কেননা বিসিএসসহ অন্যান্য চাকরির পরীক্ষায় ভালো করার প্রতি আলাদা আকর্ষণ সবারই থাকে।

সংগঠনের সদস্যদের সৃজনশীল লেখালেখিতে উৎসাহিত করা হয় প্রতিনিয়ত। সদস্যদের স্বরচিত ছোটগল্প, কবিতা কিংবা ছড়াগুলোকে সমন্বিত করে প্রতিবছর একটি দেয়ালিকা বের করেন তাঁরা। সদস্য ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও এই দেয়ালিকাতে লেখার সুযোগ থাকে। যেন সবাই এই সংগঠনের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে জানতে পারেন।

১৫০ টাকা দিয়ে একটি ফরম কিনে রাবির যেকোনো বর্ষের শিক্ষার্থী পাঠক ফোরামের সদস্য হতে পারেন। তবে প্রতিবছর স্নাতক পর্যায়ের নতুন ব্যাচ শুরুর পরপরই মূলত ফরম ছাড়া হয় বলে জানান আলীম।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য সংসদ
বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুটেক্স) শিক্ষার্থীরা কেবল প্রকৌশলের জটিল হিসাব–নিকাশের মধ্যে ডুবে থাকেন, এমনটা ভাবলে ভুল হবে। পড়ালেখার বাইরেও বুটেক্সের ছাত্রছাত্রীদের এক অন্য ভুবনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় বুটেক্স সাহিত্য সংসদ।

নিয়মিত সাপ্তাহিক পাঠচক্র ও সাহিত্য আড্ডা ক্যাম্পাসের বইপড়ুয়াদের এক ছাদের নিচে জড়ো করে। হ‌ুমায়ূন আহমেদ থেকে শুরু করে ড্যান ব্রাউন, বিভিন্ন লেখকের নানা ধরনের বই নিয়ে আলাপ–আলোচনা আর বিশ্লেষণ করেন তাঁরা। এ ছাড়া সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়েও জমে ওঠে আলাপ।

প্রতি সপ্তাহের মঙ্গলবারে বেলা একটায় ক্যাম্পাসের টিএসসি প্রাঙ্গণ অথবা কেন্দ্রীয় মাঠে বসে তাঁদের এই আসর। মাসে একটি সাহিত্য আড্ডা আর তিনটি পাঠচক্র অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া টেক্সটাইল শিল্পের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও এই শিল্প– সম্পর্কিত বিভিন্ন পররাষ্ট্রনীতি নিয়েও আলোচনা হয় সাহিত্য সংসদের সদস্যদের মধ্যে।

তাঁদের আগ্রহ বাড়াতে প্রতি সপ্তাহের আসরেই থাকে বিশেষ পুরস্কারের আয়োজন। প্রতিটি সাহিত্য আড্ডা কিংবা পাঠচক্র শেষে সেরা তিনজন আলোচককে একটি করে বই উপহার দেওয়া হয়। বুটেক্স সাহিত্য সংসদের সংগ্রহে রয়েছে প্রায় ৩০০ বই। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক হাবিব আজমী বলেন, ‘সংগঠনের জন্য আলাদা কোনো কক্ষ বরাদ্দ না থাকায় বইয়ের সংগ্রহ বাড়ানো যাচ্ছে না। তবে শিগগিরই আমাদের একটা কক্ষ পাওয়ার কথা। কক্ষ পেয়ে গেলে বইয়ের সংখ্যার পাশাপাশি সংগঠনের কার্যক্রমের পরিধিও বাড়বে।’

নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও বিভিন্ন বিশেষ অনুষ্ঠানে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কিত সংগঠনগুলোকেও আমন্ত্রণ জানান তাঁরা। ইতিমধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির একাধিক সংগঠনের সঙ্গে অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে বুটেক্স সাহিত্য সংসদ।

পাঠচক্র আর সাহিত্য আড্ডা ছাড়াও বুটেক্স সাহিত্য সংসদ প্রতিবছর হুমায়ূন উৎসবের আয়োজন করে। ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিবছরই এ উৎসব আয়োজিত হয়ে আসছে। হুমায়ূন আহমেদের লেখা বিভিন্ন গান, কবিতা, আলোচনা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে মুখর থাকে উৎসবের দিনটি। এ ছাড়া ইদানীং মঞ্চনাটক নিয়েও কাজ শুরু করেছে সংগঠনটি। সর্বশেষ চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে অনাহূত শিরোনামে একটি নাটক মঞ্চায়িত করে। এর আগে তাঁরা বিখ্যাত নাটক নীল দর্পণ ওবর মঞ্চায়িত করেছে।