গণবিশ্ববিদ্যালয়ের রক্তদাতাদের সংগঠন : বৃন্ত বৃত্তান্ত

রক্তদান ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক কাজে অংশ নেন বৃন্তর সদস্যরা। ছবি: সংগৃহীত
রক্তদান ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক কাজে অংশ নেন বৃন্তর সদস্যরা। ছবি: সংগৃহীত

‘ডিসেম্বরের তীব্র শীতে। রাত তিনটায় হঠাৎ ফোন এল। সন্তানসম্ভবা এক বোনের জন্য তিন ব্যাগ ও পজিটিভ রক্ত লাগবে। খুবই জরুরি। কিন্তু এত রাতে কে রক্ত দেবে? আমি বিভিন্ন ছাত্রাবাসে যোগাযোগ করে সেই রাতের মধ্যেই একটা ব্যবস্থা করলাম।’ কথাগুলো নাজমুল হোসেনের ২০১৫ সােলর ঘটনা এটা তখন গণবিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন।

একবার নয়, একাধিকবার হয়েছে এমন উদ্যোগ নিতে হয়েেছ নাজমুলের। আরও সংগঠিতভাবে রক্তের জোগান দিতে নাজমুল ভাবতে থাকেন, কী করা যায়। কয়েক দফা বিভিন্ন গ্রুপ করেন নানা নামে। শেষ পর্যন্ত গণবিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘বৃন্ত’ নামের একটি সংগঠন।

নাজমুল বলেন, ‘মানুষকে রক্ত দিতে গেলে তাঁর মুখে যে কৃতজ্ঞতার হাসি থাকে, সেটা আমি ভুলতে পারি না। আর পরে যখন শুনি, আমার বা বৃন্তর সদস্যদের দেওয়া রক্তে কেউ সুস্থ হয়ে গেছেন, এর চেয়ে ভালো লাগার আর কিছু নেই।’

এই ভালো লাগার টানেই গণবিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন নিয়ে ২০১৫ সালের ৮ জুলাই শুরু হয়েছিল বৃন্তর যাত্রা। কার্যকরী কমিটিসহ ছয় শতাধিক রক্তদাতা বৃন্তর সাবেক ও বর্তমান সদস্য। সদস্যরা সময়ে সময়ে নিজেদের উদ্যোগে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন অবধি প্রায় ৬০০ ব্যাগ রক্ত দিয়েছেন বৃন্তর সদস্যরা। আর এর সবই বিনা মূল্যে। সদস্যরা নিজ খরচে বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে গিয়ে রক্ত দিয়ে আসেন। আর্থিকভাবে অসচ্ছল রোগীকে সাহায্যও করা হয় কখনো কখনো। রক্তদান ছাড়াও বেশ কিছু মানবিক কাজে যুক্ত আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রতিষ্ঠান। শীতার্তদের শীতবস্ত্র দেওয়া, দুস্থদের মধ্যে নগদ টাকা বিতরণ, বিনা মূল্যে স্বাস্থ্য সেবা প্রদানসহ চলে নানান কার্যক্রম। গত শীতেও জয়পুরহাটের সরকারপাড়ায় শীতবস্ত্র বিতরণ করেছে সংগঠনটি।

এই সব কর্মকাণ্ডই কিন্তু পরিচালিত হয় সংগঠনের সদস্যদের দেওয়া টাকায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তারাও বিভিন্ন কর্মসূচিতে এগিয়ে আসেন। আর শিক্ষার্থীরাও বৃন্ত-অন্তপ্রাণ। রক্তদান কিংবা অন্য যেকোনো উদ্যোগে ছুটে আসেন আগ্রহ নিয়ে। ‘বৃন্ত প্রতিষ্ঠার সময় অনেকে বলেছে, রক্তদানের সংগঠনে খুব বেশি মানুষ পাবে না। কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে এত বেশি সাড়া পেয়েছি, বলার বাইরে’, বলছিলেন নাজমুল।

নাজমুলের কথার সত্যতা নিশ্চিত করলেন ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থী পিও রায় চৌধুরী। ‘প্রথম প্রথম যখন ক্লাব থেকে ডাকা হতো, এমনিই যেতাম। পরে দেখলাম, মানুষের জন্য কিছু করতে পারলে এক ধরনের আত্মতৃপ্তি কাজ করে। আর রক্ত দেওয়ার মতো মহৎ কাজের সঙ্গে থাকতে পারাটাই একটা অর্জন। এখন বিভিন্ন সময়ে ফোন আসে। আমরাও ছুটে যাই।’

শুরুর দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা এবং শিক্ষার্থীদের পরিচিতদের রক্তের প্রয়োজনে বৃন্তর সদস্যদের খোঁজ পড়ত। দিনকে দিন পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। সাভার, নবীনগরসহ আশপাশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সহায়তায় এখনো এগিয়ে আসছে বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক এই সংগঠন। বৃন্তর সদস্যরাও চান, বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সংগঠন হলেও দেশব্যাপী সেবা দিতে। সে কথাই বললেন পিও রায় চৌধুরী, ‘যখন কারও রক্তের প্রয়োজন হয়, তখন কিন্তু রক্ত পাওয়া যায় না। মানুষজনও বিভিন্ন ভীতির কারণে রক্ত দিতে চান না। ঢাকার অন্য প্রান্ত বা ঢাকার বাইরে হলেও আমরা সশরীরে গিয়ে রক্ত দিয়ে আসি। কোনো কারণে যদি সম্ভব না হয়, তাহলে বিকল্প উপায়ে রক্ত পৌঁছানোর ব্যবস্থা করি। আমার রক্তে অন্য কারও জীবন বাঁচবে, এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে!’