চ্যাম্পিয়ন দুই দলের কথা

স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক-প্রথম আলো আন্তস্কুল ও কলেজ প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় স্কুল পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ঢাকার রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের শিক্ষার্থীদের একটি দল। অন্য দিকে কলেজ পর্যায়ে বিজয়ী নটর ডেম কলেজের তিন শিক্ষার্থীর দল। চ্যাম্পিয়ন দুই দলের সঙ্গে কথা বলেছেন মিসবাহ্ উদ্দিন
সব বিজয়ীরা এক মঞ্চে
সব বিজয়ীরা এক মঞ্চে

রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ
মজার প্রোগ্রামিং

রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের তিন শিক্ষার্থী শাফিন আহমেদ, আরশাদ মাহবুব ও মাহির লাবীব। ওদের দলের নামটা একটু অদ্ভুত। আরইউএমসি_অ্যাবিসওয়াকার্স। এই নাম কেন? উত্তর দিল শাফিন, ‘আরশাদ আর আমার অনেক পছন্দের গেমস হচ্ছে ডার্ক সোলস। অ্যাবিসওয়াকার্স নামটা ওই গেমস থেকেই নেওয়া।’ ভাববেন না স্কুলপড়ুয়া এই শিক্ষার্থীরা শুধু গেম খেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক-প্রথম আলো আন্তস্কুল ও কলেজ প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় স্কুল পর্যায়ে ওরাই কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। কীভাবে প্রোগ্রামিংয়ের শুরু, কেমন করে ওরা এক হলো, এমন নানা বিষয়ে কথা হলো তাদের সঙ্গে।

শিশু-কিশোরদের জন্য প্রকাশিত সাময়িকী কিশোর আলোতে তখন প্রোগ্রামিং নিয়ে লেখা ছাপা হতো। সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী শাফিন আহমেদ ছিল সেই লেখার নিয়মিত পাঠক। এই লেখা পড়েই সে উদ্বুদ্ধ হয় প্রোগ্রামিংয়ে। কিশোর আলোতে ছাপা হওয়া নির্দেশনা অনুসরণ করে প্রথম দিকে একা একাই প্রোগ্রামিং করত শাফিন। ২০১৬ সালে জাতীয় হাইস্কুল প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় আঞ্চলিক পর্যায়ে গিয়ে বাদ পড়ে। এরপর খুব জেদ হয় তার। প্রোগ্রামিং বিষয়টার শেষ দেখতে চায় সে। বেশি করে অনুশীলন শুরু করে।

ওদিকে আরশাদ মাহবুবের শুরুটা হয় ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময়। আরশাদের কলেজপড়ুয়া বড় বোন মাঈশা মাহবুব তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ের প্রোগ্রামিং ভাষা পড়তেন। পড়ার সময় বাংলা প্রোগ্রামিং বইয়ের সাহায্য নিত। ছোট্ট আরশাদ সেসব বই-ই উল্টেপাল্টে দেখত। একসময় বন্ধু শাফিনের সঙ্গে প্রোগ্রামিং সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করে। এভাবেই প্রোগ্রামিং জগতে তার প্রবেশ। শুধু প্রোগ্রামিং নয়, গণিতেও ভালো আরশাদ। ২০১৮ সালের গণিত উৎসবে আঞ্চলিকে চ্যাম্পিয়ন ও জাতীয় পর্যায়ে প্রথম রানারআপ হয়। বাবা-মা উৎসাহ দিলেও স্কুলের পড়ার কথা মনে করিয়ে দিতেন। আরশাদের ভাষায়, ‘বাবা-মা উৎসাহ দিতেন। তবে বারবার মনে করিয়ে দিতেন, ‘স্কুলের পড়াও তো পড়তে হবে।’ বাবা-মায়ের সঙ্গে একটা অলিখিত চুক্তি করে নিয়েছিল আরশাদ। স্কুলের পড়ার পেছনে সে প্রতিদিন ২ থেকে ৩ ঘণ্টা ব্যয় করবে, কিন্তু বাকি সময় গণিত ও প্রোগ্রামিং করতে দিতে হবে।

২০১৮ সালেও শাফিন ও আরশাদ স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক-প্রথম আলো আন্তস্কুল ও কলেজ প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিল। সেবার তাদের দলের আরেক সদস্য ছিল একই স্কুলের আরেক শিক্ষার্থী আনান। আনান যদিও শাফিন-আরশাদদের ওপরের ক্লাসে পড়ত। সেবার তারা পঞ্চম হয়েছিল। পরের বছর আনান চলে গেল কলেজে। ফলে নতুন সদস্য হিসেবে যোগ হয় মাহির লাবীব। শাফিন ও আরশাদ এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। মাহির পড়ে নবম শ্রেণিতে।

তোমাদের সাফল্যের রহস্য কী? জানতে চাইলে আরশাদ বলে, ‘এককথায় বললে, আমাদের টিমওয়ার্ক। প্রোগ্রামিং কনটেস্টে গণিতের স্বচ্ছ ধারণা খুব কাজে লেগেছে।’ প্রতিযোগিতার শুরু থেকেই তাদের দলের অবস্থান ছিল প্রথম। শেষের আধঘণ্টায় কোনো র‌্যাঙ্কিং দেখানো হয়নি। তবে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ব্যাপারে আরইউএমসি_অ্যাবিসওয়াকার্স আত্মবিশ্বাসী ছিল। স্কুল পর্যায়েই যারা প্রোগ্রামিং শিখতে চায়, তাদের জন্য চ্যাম্পিয়নদের পরামর্শ, ‘প্রথম দিকে প্রোগ্রামিং অনেক কঠিন লাগতে পারে। ভয় না পেয়ে লেগে থাকলেই একসময় মজা লাগতে শুরু করবে।’

নটর ডেম কলেজ
গণিত থেকে প্রোগ্রামিংয়ে

স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক-প্রথম আলো আন্তস্কুল ও কলেজ প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার নিয়মটা বেশ মজার। এখানে মূলত বেশ কয়েকটি প্রোগ্রামিং সমস্যার সমাধান করতে দেওয়া হয় অংশগ্রহণকারী দলগুলোকে। সমস্যা হাতে পাওয়ার পর একসঙ্গে সমাধান করতে শুরু করে প্রতিযোগীরা। কোনো দল যদি কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারে, তাদের সামনে বেঁধে দেওয়া হয় একটি করে বেলুন। বেলুনের সংখ্যা দেখেই বোঝা যায়, কে কত দূর এগোল। প্রতিযোগিতা চলাকালীন নটর ডেম কলেজের এক্সট্রিম কোডার্স ভার্সন ২.০ দলের সামনে একঝাঁক বেলুন দেখে অনুমান করা যাচ্ছিল, এই দলটা অন্য রকম। ফল প্রকাশের পর দেখা গেল, তারাই হয়েছে চ্যাম্পিয়ন। ১১টার মধ্যে মোট ৯টি সমস্যার সমাধান করেছিল তারা।

এক্সট্রিম কোডার্স ভার্সন ২.০ দলের তিন সদস্য—নটর ডেম কলেজের তাসমীম রেজা, আওয়েশ ইসলাম ও জাবের আহমেদ। তিনজনই এ বছর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেবে। পরীক্ষা সামনে, তাই বলে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের আনন্দ তারা হাতছাড়া করতে চায়নি।

২০১৫ সালে জাতীয় হাইস্কুল প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় (এনএইচএসপিসি) প্রথমবার অংশ নিয়েই পঞ্চম হয়েছিল তাসমীম রেজা। এরপর আর থেমে নেই। নিয়মিত সাফল্য এসেছে। পরের বছর এনএইচএসপিসিতে চতুর্থ হয় সে। ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াডে (আইওআই) ব্রোঞ্জ পদক পায়। ২০১৮ সালে আইওআই-তে পায় সিলভার পদক। একই বছর স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক-প্রথম আলো আন্তস্কুল ও কলেজ প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয় তাসমীম রেজা, নিলয় দাস ও আশফাক ফয়সালের দল—এনডিসি নাইটকিং।

২০১৯ সালে আইওআইয়েও ব্রোঞ্জ পেয়েছে তাসমীম। শুধু প্রোগ্রামিং নয়, গণিত উৎসবেও পুরস্কার এসেছে সমানতালে। ২০১৭ সালে সে জাতীয় গণিত উৎসবে মাধ্যমিক পর্যায়ে ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য চ্যাম্পিয়নস’ হয়েছিল এই তরুণ।

আওয়েশ ইসলামের প্রোগ্রামিংয়ের হাতেখড়ি হয়েছিল স্কুল থেকে। ২০১৭ সালে রাজউক উত্তরা মডেল কলেজে রোবটিকস ক্লাব আয়োজন করে গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, প্রোগ্রামিংসহ প্রযুক্তির বিভিন্ন প্রতিযোগিতা। সেবার প্রোগ্রামিংয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল আওয়েশ। পরের বছর স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক-প্রথম আলো আন্তস্কুল ও কলেজ প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় দশম হয় হয় আওয়েশদের দল—এক্সট্রিম কোডার্স। জাবেরও সেই দলেই ছিল। নতুন করে যোগ হয়েছে তাসমিম। তাই এ বছর তাদের দলের নাম এক্সট্রিম কোডার্স ভার্সন ২.০।

তাসমিমও মূলত দলছুট হয়ে এই দলে এসে যোগ দিয়েছে। ২০১৮ সালের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক-প্রথম আলো আন্তস্কুল ও কলেজ প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয় তাসমিম রেজা, নিলয় দাস ও আশফাক ফয়সালের দল—এনডিসি নাইটকিং। এবার এইচএসসি পরীক্ষা আসন্ন বলে পড়ালেখাকেও অগ্রাধিকার দিয়েছে নিলয় ও আশফাক। প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়নি। কিন্তু তাসমিম হাল ছাড়ার পাত্র নয়। এক্সট্রিম কোডার্সের আরও একজন সদস্য প্রয়োজন জেনে যোগ দিয়ে ফেলে সে।

শুধু প্রোগ্রামিং নয়, গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের প্রতিও ভালো লাগা আছে নটর ডেমের এই শিক্ষার্থীদের। জাবের অবশ্য শুরুতে গণিতটাই বেশি ভালোবাসত। পরে বন্ধু আওয়েশের সংস্পর্শে এসে তার মাথাতেও চেপে বসে প্রোগ্রামিংয়ের ভূত। প্রোগ্রামিংয়ের ভাষা শিখে বিভিন্ন গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে শুরু করেছিল সে। জাবের বলে, ‘প্রথমবার যখন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলাম, তখন আসলে অভিজ্ঞতা কম ছিল। তাই আমরা দশম হই।’ জাবের জানাল, এ বছর জাতীয় ফিজিক্স অলিম্পিয়াডে সে ১৭তম হয়েছে। আর আঞ্চলিক পর্ব পেরিয়ে জাতীয় গণিত উৎসবে অংশ নেওয়ার অপেক্ষায় আছে।

সামনে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা। পড়ালেখার চাপ তো আছেই। আপাতত প্রোগ্রামিং নিয়ে না ভাবলেও ভবিষ্যতে এই দক্ষতা কাজে লাগিয়ে বহুদূর যেতে চায় তিন তরুণ।

টুকরো ঘটনা
একজনের দল
রাজশাহী ইউনিভার্সিটি স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ফারহান আহমদ। তার বাবা শামীম আহমদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় বাবার হাতেই প্রোগ্রামিংয়ের হাতেখড়ি হয় ফারহানের। প্রথমে সি ভাষা শিখতে গিয়ে আগ্রহ হারালেও পরে আরডুইনোতে মজা পেয়ে যায় সে। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক-প্রথম আলো আন্তস্কুল ও কলেজ প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় ফারহানের দলের বাকি দুই সদস্য আসেনি। তাই সে একাই লড়েছে তিনজন হয়ে। একা তিনজনের কাজ...পারবে তো? প্রশ্ন শুনে সে বলে, ‘তিনজনের নাম দিতে হয় তাই দিয়েছি। ওরা আসবে না জানতাম। কোনো সমস্যা নেই। মূলত আমি একাই প্রোগ্রামিং সমস্যার সমাধান করে পুরস্কার নিয়ে যাব, এমন প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি।’ চূড়ান্ত ফলাফলে দেখা যায়, ফারহানের ‘দল’ ৩ ব্লু১ ব্রাউন স্কুল পর্যায়ে জিতে নিয়েছে তৃতীয় স্থান।
সিজিসি পাশের জন থেকে কোড কপি মারব!
প্রতিযোগিতা ঘুরে দেখছিলাম। দুই সদস্যের একটি দলের পাশ দিয়ে যাচ্ছি। মো. মোবাশ্বির চৌধুরী ও মো. মাঈনুল হাসান এসেছে কুমিল্লা সরকারি কলেজ থেকে। অপর সদস্য নাকি বান্দরবান ঘুরতে গেছে, তাই আসেনি। দলের নাম দেখে অবাক হলাম—সিজিসি পাশের জন থেকে কোড কপি মারবে। এ রকম নামও হয়! তাই বলে কোড কপি করবে? মোবাশ্বির চৌধুরীরা হি হি করে হেসে উত্তর দেয়, ‘পাশের জন আমার দলেরই সদস্য মাঈনুল হাসান। দুজন মিলেই তো কোড করব। দলের সবাই মিলে সমস্যা সমাধান করাই নিয়ম। এটা অন্যায় হবে কেন? লোকজনকে দ্বিধান্বিত করে দিতেই এমন নাম দিয়েছি।’ নাম এমন হলেও তারা কিন্তু অন্য দলের কোড কপি করেনি। চূড়ান্ত ফলাফলে দেখা গেল, দলটির অবস্থান পঞ্চম।