যেকোনোভাবে পড়াশোনায় যুক্ত থাকতে হবে

করোনাভাইরাসের কারণে এক অনির্ধারিত ছুটির কবলে পড়ে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাপঞ্জিই এলোমেলো হয়ে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিভাগে চূড়ান্ত পরীক্ষার ফল প্রকাশ আটকে আছে। অন্যদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যখন পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখনই এসেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা। সেশনজট বাড়ছে, পড়াশোনা নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

শুধু পড়ালেখা তো নয়, ক্যাম্পাসজীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অনেক শিক্ষার্থী এবং তাঁদের পরিবারের আয়রোজগারের বিষয়টিও। কেউ কেউ টিউশনি কিংবা খণ্ডকালীন বিভিন্ন কাজ করে আয় করতেন, পরিবারে সহায়তা করতেন। সেই পথ বন্ধ হয়ে গেছে। যাঁরা ভাড়া বাসায় (মূলত মেস) থাকতেন, তাঁরা অধিকাংশই নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে গেছেন, কিন্তু ভাড়া গুনতে হচ্ছে ঠিকই। সাম্প্রতিক সময়ে এত লম্বা বন্ধ আর হয়নি।

অন্যদিকে ঢাকার নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রামের ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি, সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটিসহ ৫৫টির বেশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশসহ আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় আগামী জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে পুরোদমে নতুন সেমিস্টারের অনলাইন ক্লাস নেওয়া শুরু করবে।

এদিকে বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যেমন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। তবে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘নানা সমস্যার কারণে’ আনুষ্ঠানিকভাবে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যায়নি। দীর্ঘ এই ছুটির কবলে পড়ে ঘরবন্দী শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা ও অনিশ্চয়তা বাড়ছে।

দেশের বেশ কয়েকজন শিক্ষাবিদ মনে করেন, ক্যাম্পাস বন্ধ থাকলেও শিক্ষার্থীদের নানা উপায়ে পড়ালেখায় সক্রিয় থাকা উচিত। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকেরাই বড় ভূমিকা পালন করতে পারেন। কেউ কেউ বলছেন, অনলাইনে ক্লাস শুরু করতে হবে। আবার কারও অভিমত, যেকোনো কারণেই হোক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যেহেতু অনলাইনে ক্লাস শুরু করা যাচ্ছে না, সে ক্ষেত্রে মোবাইল ফোনে বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে শিক্ষার্থীরাও পড়াশোনার প্রতি যতটা সম্ভব সক্রিয় থাকতে পারেন। সবচেয়ে বড় কথা, ‘যুদ্ধকালীন’ ক্ষতির বিষয়টি মাথায় রেখেই যতটা সম্ভব সক্রিয় থাকতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসির) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান অনলাইনে ক্লাস শুরুর ওপরই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে অনলাইন ক্লাসের বিকল্প নেই। এ জন্য শিক্ষকদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ ক্ষতির মুখে ফেলা যাবে না।’ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এখন অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছে। ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে অনলাইন ক্লাস নেওয়া সম্ভব।

এখন এমনিতেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিচ্ছিন্ন শিক্ষার্থীরা। এর সঙ্গে পড়াশোনা থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে শূন্যতার সৃষ্টি হবে। বিশেষ করে প্রান্তিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা বেশি সমস্যায় পড়বে। এমনটা মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের বিচ্ছিন্ন করে রাখা যাবে না।’

পড়াশোনায় যুক্ত থাকতে বিভিন্ন বিভাগের ফেসবুকভিত্তিক গ্রুপ কাজে লাগতে পারে। বাড়িতে সঙ্গে নেওয়া বইপুস্তক, নোটগুলো দিয়ে নিজের মতো করেও পড়ালেখা চালিয়ে নেওয়া যায়। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘ছাত্রছাত্রীদের উচিত নানাভাবে সক্রিয় থাকা। দূরে থেকেও স্পর্শ করা যায়, সেই সংস্কৃতি এখন আত্মস্থ করতে হবে।’

অনলাইনে ক্লাস নেওয়া যায় কি না, তা নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের প্রথম দিকেই আলোচনা করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন শিক্ষার্থীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনা করে ডিনস কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা হয়নি বলে জানালেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক মাহবুবা নাসরীন। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা থেকে ইন্টারনেটসহ আনুষঙ্গিক সুবিধা বাড়িয়ে কোনো ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে এখন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। এ ছাড়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের জন্য কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থাও করতে হবে।’

করোনা মহামারির এই দুঃসময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও পড়াশোনায় শিক্ষার্থীদের সক্রিয় রাখতে হবে বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদেরা। তাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যাতে পড়াশোনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়েন, সে জন্য বাস্তবভিত্তিক বিকল্প ব্যবস্থা হতে পারে ভালো সমাধান।