পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাস: শিক্ষার্থীদের ভাবনা

ক্যাম্পাসে শিগগিরই ফেরা হচ্ছে না শিক্ষার্থীদের। তাই বলে এত দীর্ঘ সময় পড়াশোনা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা ঠিক হবে না বলে মনে করেন শিক্ষাবিদেরা। সম্প্রতি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছবিটি তুলেছেন সাদ্দাম হোসেন
ক্যাম্পাসে শিগগিরই ফেরা হচ্ছে না শিক্ষার্থীদের। তাই বলে এত দীর্ঘ সময় পড়াশোনা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা ঠিক হবে না বলে মনে করেন শিক্ষাবিদেরা। সম্প্রতি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছবিটি তুলেছেন সাদ্দাম হোসেন

কাউকে পেছনে রেখে এগোনো ঠিক হবে না
এইচ এম ফজলে রাব্বী, তৃতীয় বর্ষ, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সার্বিক অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও উন্নত ইন্টারনেট ব্যবস্থা ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাস পরিচালনা বেশ অবাস্তব চিন্তা। বহু শিক্ষার্থী এখন এমন স্থানে আছেন, যেখানে ইন্টারনেট সংযোগ খুব দুর্বল। সবাই যদি একই রকম সুযোগ-সুবিধা না পায়, তাহলে ক্লাস চালিয়ে নেওয়া কি ঠিক হবে?

এমনিতেই আমরা একটা দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে আছি। এমন সময়ে কাউকে পেছনে রেখে বাকিরা তো সামনে এগোতে পারে না। দীর্ঘদিন একাডেমিক পড়ালেখা থেকে দূরে থাকলে আমরা একটা সংকটে পড়ব, সেটাও সত্যি। এ ক্ষেত্রে গ্রুপভিত্তিক ফেসবুক লাইভের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কেউ সময়মতো ক্লাসে উপস্থিত হতে না পারলেও পরে যেন দেখে নিতে পারে। তবে দিন শেষে সার্বিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অবশ্যই মানবিক হতে হবে।

ঘরের ভেতর নেটওয়ার্ক থাকে না
সাজ্জাদ হোসেন, দ্বিতীয় বর্ষ, সমুদ্রবিজ্ঞান, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আমাদের এক শিক্ষক নিজ উদ্যোগে জুম ব্যবহার করে ক্লাস নেওয়া শুরু করেছিলেন। আমাদের ক্লাসে ৬৪ জন শিক্ষার্থী। শুরুর কয়েকটা ক্লাসের পর বেশির ভাগই আর অংশগ্রহণ করতে পারেনি। আমি নিজেও ৪-৫টা ক্লাস করেছি। পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় যেখানে আমার বাড়ি, সেখানে ঘরের ভেতর নেটওয়ার্ক থাকে না। ক্লাসের ভিডিও বন্ধুরা গ্রুপে দিয়েছে, পরে সেখানে দেখেছি। তবে সত্যি বলতে আমাদের পড়ার বিষয়গুলো এমন, ভিডিও দেখেও খুব একটা বোঝা যায় না। গ্রুপওয়ার্ক দরকার হয়, অনেক কিছু বোঝার বিষয় থাকে। তবু আমরা শিক্ষককে বলেছি, তিনি যেন পিডিএফগুলো দিয়ে (আপলোড করে) রাখেন। বিশ্ববিদ্যালয় খুললে আমরা নিজেদের মতো করে পড়ে ঘাটতিটা পুষিয়ে নিতে চেষ্টা করব।

সময়টা কাজে লাগানো উচিত পরিকল্পনায়
আশরাফী নিতু, তৃতীয় বর্ষ, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পড়ালেখার চেয়েও অন্যান্য আরও বড় সংকট এখন শিক্ষার্থীদের ভাবাচ্ছে। টিউশনি করে যাদের আয় হতো, তারা বিপদে পড়েছে। অনেকের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি চাকরি হারিয়েছেন। পরিবার চলছে না, সেখানে পড়াশোনা চলবে কী করে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু যত বেশি শিক্ষার্থী আবেদন করেছে, সেই তুলনায় শিক্ষাবৃত্তির পরিমাণ খুবই কম। ক্লাস শুরু করার চেয়ে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোটাই এখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বড় কাজ।

তবে হ্যাঁ, এই সময়টাতে শিক্ষক ও প্রশাসনের মানুষজন বসে একটা পরিকল্পনা সাজিয়ে ফেলতে পারেন। ক্যাম্পাস খুললে কীভাবে পরীক্ষা হবে, কীভাবে ঘাটতিটা কাটানো যাবে, সব এখন থেকেই ভেবে রাখতে হবে। যেন বিশ্ববিদ্যালয় খুললেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায়। পরে আর মিটিং করে সময় নষ্ট করার মতো সময় থাকবে না।

সেশনজট নতুন কিছু নয়
নাফিস মাহমুদ, তৃতীয় বর্ষ, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকলেও উপস্থিতির বাধ্যবাধকতা কিংবা পরীক্ষার চাপ না থাকলে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে যেতে চায় না। অনেক বিভাগে শুরুর দিকে সেভাবে ক্লাসও হয় না। শেষের দিকে গিয়ে ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট, পরীক্ষা—সব চাপ একসঙ্গে পড়ে। এ ছাড়া সেশনজট আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়। অতএব পড়ালেখার ক্ষেত্রে বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের ওপর খুব একটা প্রভাব ফেলছে না। আমাদের অনেক শিক্ষক ক্লাসে খুব ভালো পড়ান, কিন্তু প্রযুক্তিগত দিক থেকে খুব একটা দক্ষ নন। তাই অনলাইনে ক্লাস না করিয়ে আমি মনে করি অন্য কিছু করা যেতে পারে। আমার এক বন্ধু যেমন আমাদের এক শিক্ষকের সঙ্গে একটা গবেষণার কাজ করছে। এমনিভাবে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রকল্প বা অ্যাসাইনমেন্টের কাজ দেওয়া যেতে পারে, যা ঘরে বসে করা সম্ভব।

সুস্থ থাকাটাই বড় কথা
উম্মে সাঈদা, চতুর্থ বর্ষ, খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলায় যেখানে আমার বাড়ি, সেখানে একটু ঝড় হলেই ২-৩ দিনের জন্য বিদ্যুৎ থাকে না। আমরা চার বোন। এখন সবার ক্লাস বন্ধ। বাবা সাব–রেজিস্ট্রার অফিসে দলিল লেখক হিসেবে কাজ করেন। এখন যদিও সীমিত পরিসরে অফিস-আদালত খুলে দেওয়া হয়েছে, বাবাও কিছুটা সময়ের জন্য কাজে যাচ্ছেন। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে আমরা যে খারাপ অবস্থায় পড়তে যাচ্ছি, সেটা বুঝতে পারি।

এত কিছুর মধ্যে সুস্থ থাকাটাই এখন বড়, পড়ালেখা নিয়ে ভাবছি না। তবে নিজের ব্যক্তিগত দক্ষতা উন্নয়নের চেষ্টা করছি। ইউনিসেফের ‘কমিউনিটি ইনফরমেশন হাব’ নামে একটি প্রকল্পে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছি। অনলাইনে কোর্সেরায় আমার বিষয়সংশ্লিষ্ট একটা কোর্স শুরু করেছি। এই কোর্সে যেহেতু নিজের সময়-সুযোগমতো একটু একটু করে পড়া যায়, তাই সমস্যা হচ্ছে না।

দক্ষতা উন্নয়নে জোর দেওয়া উচিত

জান্নাতুল ফেরদৌস, চতুর্থ বর্ষ, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এখনো অনলাইনে ক্লাসসংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে যত দূর শুনেছি, কয়েকজন শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীদের হাতে যদি প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি থাকে, সুলভ ইন্টারনেট প্যাকেজ থাকে, তাহলে ক্লাস নিতে তাঁদের আপত্তি নেই। তবে আমি মনে করি, এখন ছাত্রছাত্রীদের ব্যক্তিগত দক্ষতা উন্নয়নে জোর দেওয়া উচিত। একাডেমিক পড়ালেখার চেয়ে এর গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়। ‘জেন্ডার এডুকেশন’ পড়ার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি; মায়েরা-বোনেরা কীভাবে কাজ করে, বাড়িতে থেকে এসব দেখা-শেখার মাধ্যমে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনাটাও জরুরি। গল্প-উপন্যাস পড়া, ছবি আঁকা, নাচ, গানের মতো সৃজনশীল কাজের চর্চা করাও এগিয়ে রাখবে। বিশেষ করে যাঁরা বিসিএস বা অন্যান্য চাকরির পরীক্ষা দিতে চান, এখন প্রস্তুতি নেওয়ার একটা সুযোগ আছে।

গ্রন্থনা: মো. সাইফুল্লাহ