'অনলাইন ও মুখোমুখি শিক্ষার একটি মেলবন্ধন প্রয়োজন'

কিছু বিশ্ববিদ্যালয় কমপক্ষে ৭০ শতাংশ উপস্থিতি নিয়ে তাদের অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম কত দুর্দান্ত চলছে, সেটা জানাচ্ছে। কিন্তু অন্য দিক থেকে দেখলে এর অর্থ দাঁড়ায়, ৩০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী এই অনলাইন শিক্ষায় অংশ নিতে পারছেন না। এটা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। এই পরিস্থিতি আসলে অনলাইন শিক্ষার সমস্যাগুলো মূল্যায়ন এবং সমস্যাগুলোর সমাধান চিন্তা করার সুযোগ। এই পর্যবেক্ষণ সম্প্রতি ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের (আইইউবি) ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক মিলান প্যাগন দিয়েছেন। প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে কোভিড-১৯ মহামারিকালে এবং সামনের দিনগুলোতে উচ্চশিক্ষার পরিস্থিতি নিয়ে তিনি কথা বলছিলেন।

করোনাকালে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে আইইউবি কীভাবে অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছে জানতে চাওয়া হলে মিলান প্যাগন বলেন, ‘আইইউবিতে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমাদের বাস্তববাদী হওয়া দরকার। আমরা অন্য কাউকে অনুসরণ করতে চাইনি। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাম্প্রতিক মূল্যায়নের সঙ্গে আমি সম্পূর্ণরূপে একমত যে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ একটি পূর্ণাঙ্গ অনলাইন শিক্ষার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। সে কারণেই আমরা ধীরে ধীরে এটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এটি আমাদের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের বিষয়। এবং আমরা তাঁদের এমন পরিস্থিতিতে ফেলতে চাই না, যেখানে তাঁরা তাঁদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবে না।’

আইইউবির নতুন সেমিস্টার শুরু হবে ১ জুলাই থেকে। তাই বর্তমান সময়টায় শিক্ষার্থী এবং অনুষদ প্রত্যেকেই অনলাইন শিক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনলাইন শিক্ষা একটি নতুন ধারণা। আগে কেবল উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ই দূরে বসে অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার অনুমতি পেয়েছিল।’ অনলাইন শিক্ষার জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতির ব্যাপারে জোর দিতেই অধ্যাপক প্যাগন এ কথা বলেন।

উপাচার্য আরও বলেন, অনলাইন শিক্ষা নিয়ে বর্তমানে অতি আলোচনা চলছে। এবং অনেকেই বলছে এটিই শিক্ষার ভবিষ্যৎ। কিন্তু ভুললে চলবে না যে, এমন অনেক কিছু আছে, যা শুধু অনলাইনে বসে করা সম্ভব নয়। তিনি মনে করেন, শিক্ষার একটি মিশ্রিত মডেল প্রয়োজন, অর্থাৎ কিছু জিনিস অনলাইনে করা সম্ভব। আবার এমন অনেক পরিস্থিতি আছে, যেখানে মুখোমুখি বসে কাজ করার প্রয়োজন হয়।

উপাচার্য বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের তাঁদের ভবিষ্যৎ এবং কাজের জন্য প্রস্তুত করি। এমনকি নতুন পরিস্থিতিতেও বেশির ভাগ কাজ তাঁদের মুখোমুখি বসে করতে হবে। আমরা আশা করতে পারি না যে সব কাজ আমরা অনলাইনে বসেই করতে পারব। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকপ্রাপ্ত হয়ে শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবনের মুখোমুখি পরিস্থিতিতে কাজ করবেন। এখন আমরা যদি তাঁদের চার বছর ধরে শুধু অনলাইনেই পড়াশোনা করাই বা প্রস্তুত করি, তাহলে বাস্তব জীবনে মুখোমুখি পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে তাঁদের সমস্যায় পড়তে হবে।’

অনলাইন ক্লাসের জন্য আইইউবি প্রথম গুগল ক্লাসরুম প্ল্যাটফর্মটি নির্বাচন করে এবং অনুষদ ও শিক্ষার্থীদের জন্য বিশদভাবে প্রস্তুত করে। তারা এখন প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত হার্ডওয়্যার দিয়ে সব শ্রেণিকক্ষকে সাজানোর প্রক্রিয়াতে রয়েছে। উপাচার্য বলেন, ‘আমাদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, শিক্ষকেরা ক্যাম্পাসে এসে ক্লাসরুম থেকে ক্লাস নেবেন। আমরা পরীক্ষামূলকভাবে গুগল ক্লাসরুমের মাধ্যমে অনলাইনে ক্লাস চালাচ্ছি, যাতে করে অনুষদের সদস্যরা ও শিক্ষার্থীরা এই নতুন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে কাজ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেন এবং অভ্যস্ত হতে পারেন। এর মাধ্যমে আমরা অনলাইনে ক্লাস করার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পারব।’

উপাচার্য বুঝতে পারছেন যে এই ধরনের প্রচেষ্টায় সামগ্রিক সহযোগিতা প্রয়োজন। বাংলাদেশের প্রতিটি কোনায় শিক্ষা পৌঁছাতে হলে ইউজিসি, মন্ত্রণালয় এবং সরকারকে একযোগে কাজ করতে হবে। ঢাকার শিক্ষার্থীদের অনলাইনে ক্লাস করা খুব একটা কষ্টসাধ্য না হলেও বাংলাদেশের গ্রাম ও মফস্বলের শিক্ষার্থীদের জন্য এই সুবিধা পাওয়া দুর্লভ। কারণ, সেখানে বিদ্যুৎ নেই, মুঠোফোনে চার্জ থাকে না বা ইন্টারনেট সংযোগ দুর্বল, এ রকম অনেক সমস্যা আছে। এবং এই সমস্যাগুলো বিশ্ববিদ্যালয় নিজে সমাধান করতে পারে না। এটা হতে হবে একটি যৌথ প্রচেষ্টা।

মিলান প্যাগন বলেন, ‘আমাদের ছাত্রছাত্রীরাই আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ। প্রথমেই আমরা নিশ্চিত করতে চাই, আমাদের ছাত্ররা শিক্ষা গ্রহণে অংশ নিতে পারছেন এবং আর্থিক কারণে যেন বাদ না পড়ে যান। এখন আমাদের বড় উদ্বেগ হলো, আমাদের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করতে সক্ষম হবেন, তা নিশ্চিত করা। আমরা আমাদের পড়াশোনার গুণগত মানে কোনো ছাড় দিচ্ছি না। কিন্তু আমরা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রশাসনিক বাধাগুলো শিথিল করছি।’

প্রচলিত পরিস্থিতিতে অনলাইন শিক্ষার বিষয়ে পরামর্শ জানতে চাওয়া হলে অধ্যাপক প্যাগন বলেন, ‘আমাদের সচেতন হওয়ার একটা বিষয় হলো—বাংলাদেশে শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর সব কটি কিন্তু মানসম্পন্ন নয়। তাই সরকারের উচিত যেসব বিশ্ববিদ্যালয় মান বজায় রেখে কাজ করছে, তাদের অনুমতি দেওয়া।’

উপাচার্যের আরও একটি পরামর্শ হলো, ‘আমাদের মাধ্যমিক শিক্ষার মান উন্নত করা দরকার। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠান যেখানে ইংরেজিতে পড়ানো হয়, কিন্তু শিক্ষার্থীদের কোনো একটি অংশ যদি কথ্য ইংরেজি না বোঝেন, তাহলে এটি একটি গুরুতর সমস্যা। বাংলাদেশের মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে এখনো অনেক চেষ্টা করতে হবে। এবং না বুঝে শুধু মুখস্থ করে পাস করে ভালো গ্রেড অর্জনের পদ্ধতি থেকে দূরে সরে আসতে হবে। ইতিমধ্যে সরকার অনেক করেছে, অনেক উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু আরও অনেক প্রচেষ্টার এখনো দরকার আছে।’