জিপিএ ফাইভ পাওয়া ভালো, না পাওয়াও মন্দ নয়

এই মুহূর্তটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ! ছবি: আশরাফুল আলম
এই মুহূর্তটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ! ছবি: আশরাফুল আলম

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় ‘এখন’, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ তিনি, যিনি এই মুহূর্তে তোমার সামনে আছেন। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো, এই মুহূর্তে তুমি যা করছ

তোমরা যারা জিপিএ ফাইভ পেয়েছ, তাদের অভিনন্দন। এই মুহূর্তে তোমার সাফল্যটা তুমি উপভোগ করো। উদ্‌যাপন করো। আমাদের সময়ে লেভ তলস্তয়ের একটা গল্প পাঠ্য ছিল। থ্রি কোশ্চেনস। তিনটা প্রশ্ন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় কী? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ কে? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ কী? গল্পের শেষে আমরা উত্তর পাই—সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় ‘এখন’, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ তিনি, যিনি এই মুহূর্তে তোমার সামনে আছেন। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো, এই মুহূর্তে তুমি যা করছ। তোমরা যারা জিপিএ ফাইভ পেয়েছ, তারা এই মুহূর্তটাকে সুন্দরভাবে তোমার কাছের মানুষগুলোকে নিয়ে উপভোগ করো।

এখন তুমি এই লেখাটা পড়ছ। এটাই তোমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এই মুহূর্তটাই তোমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। আর আমি হলাম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। হা হা হা।

তাহলে কয়েকটা ভারী কথা বলে নিই। শুনতে ভালো লাগবে না। তোমরা যারা জিপিএ ফাইভ পেয়েছ, তাদের সবাই কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ে বা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাবে না। কারণ, হিসাব সহজ। অতগুলো আসন নেই। কিন্তু কোথাও না কোথাও তো তোমরা ভর্তি হবেই। যেখানেই পড়ো না কেন, সুন্দরভাবে লেখাপড়া করো। উচ্চমাধ্যমিকের ফলটা গুরুত্বপূর্ণ পরের ধাপে ভর্তি হওয়ার জন্য। কিন্তু জীবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলটাই কাজে লাগে, চাকরিবাকরি বা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে। আর ফলের ধারাবাহিকতা রক্ষা করাটাই এখন তোমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ।

আজকের যুগটা বিশেষজ্ঞদের যুগ, শুধু ডাক্তার হলে হয় না, চোখের বা হার্টের ডাক্তার হতে হয়। কাজেই খুব মন দিয়েই পড়াশোনা করতে হবে। ভালো ফলের একটা দাম রয়েই যায়। ভালো ফল করেছেন মাধ্যমিকে, উচ্চমাধ্যমিকে, এঁদের মধ্যে আছেন লেখক হ‌ুমায়ূন আহমেদ। তিনি বোর্ডের পরীক্ষায় মেধা তালিকায় স্থান দখল করেছিলেন। আরেকজনের কথা বলি। তাঁর নাম এম জাহিদ হাসান। তিনি আমেরিকার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে গবেষণা করতেন আইনস্টাইন, সেখানে আছেন, গবেষক ও শিক্ষক হিসেবে। তিনি ভাইল ফারমিয়ন কণা আবিষ্কার করেছেন, যা কি না বিজ্ঞানীরা ৮০ বছর ধরে খুঁজছেন। এই জাহিদ হাসান আমাদের ঢাকার ছেলে, ধানমন্ডি গভ. বয়েজ স্কুলের ছাত্র, এসএসসিতে বোর্ডে সেকেন্ড হয়েছিলেন, আর এইচএসসিতে হয়েছিলেন ফার্স্ট। কাজেই আমি বলব, ভালো রেজাল্ট করা ভালো।

আবার ভালো রেজাল্ট না করলেও ভালো। রবীন্দ্রনাথ একটার পর একটা স্কুলে গেছেন, টিকতে পারেননি, ব্যারিস্টারি পড়তে বিলাতে গেছেন, ব্যারিস্টার না হয়েই ফিরে এসেছেন। তাতে পৃথিবীর লাভই হয়েছে।

আইনস্টাইন কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন। বিল গেটস হার্ভার্ডের পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন, আর পড়া শেষ না করেই বেরিয়ে যান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়ে বহিষ্কৃত হন। ইতিহাসবিদেরা বলেন, তাতে ভালোই হয়েছে, দেশ একজন জাতীয় নেতা পেয়েছে, পরে যিনি একটা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কিন্তু স্ট্যান্ড করা ছাত্র ছিলেন। যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় রাজনীতির কারণে ক্লাস বা পরীক্ষায় নিয়মিত ছিলেন না। সাকিব আল হাসানের বাবা চাননি ছেলে ক্রিকেটার হোক, কিন্তু সাকিব আল হাসান বিশ্বের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার হয়েছেন।

আমাদের ক্লাসে রংপুর জিলা স্কুলে প্রায় ৮০ জন ছাত্র পড়ত। কেউ ফার্স্ট হতো, কেউ ৮০তম হতো। আজ ৩৫ বছর পরে দেখতে পাচ্ছি, সবাই ভালো করছে। যে ফার্স্ট হতো, সেই যে সবচেয়ে ভালো করেছে, তা নয়। আর বুয়েটে আমাদের ব্যাচে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে দেশে থেকে সবচেয়ে ভালো করছে যে ছেলেটি, সে পরীক্ষায় বেশ খারাপ করত। কাজেই জীবন সবার জন্য সোনার মেডেল রেখে দিয়েছে, আমাদের কাজ হলো জীবনটাকে সুন্দরভাবে যাপন করে যাওয়া। পৃথিবীসেরা প্রকৌশলী এফ আর খানের উক্তিটা বলি, ‘একজন প্রযুক্তিবিদের আপন প্রযুক্তিতে হারিয়ে যাওয়া উচিত নয়। তাকে অবশ্যই জীবনকে উপভোগ করতে পারতে হবে। আর জীবন হলো শিল্প, সংগীত, নাটক এবং সবচেয়ে বড় কথা জীবন হলো মানুষ।’ এফ আর খানের একটা ছবি দেখতে পাবে ইন্টারনেটে, তিনি বসে বসে হারমোনিয়াম বাজাচ্ছেন। তিনি একাত্তর সালে আমেরিকায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে সক্রিয় ছিলেন। বলতে চাইছি, সফল প্রকৌশলী হতে হলেও শিল্প, নাটক, সংগীত ও মানবপ্রেম ও দেশপ্রেম থাকতে হবে।

এ পি জে আবদুল কালামের গল্পটা আবার স্মরণ করো। তিনি হতে চেয়েছিলেন বিমান বাহিনীর পাইলট। দেরাদুনে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে অল্পের জন্য চান্স পেতে ব্যর্থ হলেন। নদীর ধারে বসে মুখ অন্ধকার করে ভাবছেন, এই জীবন রেখে আর কী লাভ! একজন সাধু তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে? এ পি জে আবদুল কালাম জানালেন তাঁর হতাশার কথা, সারা জীবনের স্বপ্ন ব্যর্থ হয়ে গেছে, তিনি বিমান বাহিনীতে চান্স পাননি। সাধু বললেন, ঈশ্বর তোমাকে হয়তো অন্য কোনো কিছু হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট করে রেখেছেন, তুমি তা-ই হওয়ার চেষ্টা করো। এ পি জে আবদুল কালাম খুব বড় বিজ্ঞানী আর ভারতের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন।

কাজেই আমার পরামর্শ হলো, রেজাল্ট ভালো হোক আর খারাপ হোক, প্রচুর বই পড়ো। বিল গেটস বলেছেন, ছোটবেলা থেকেই তাঁর প্রচুর স্বপ্ন ছিল, আর তা তিনি পেয়েছেন বই থেকে। বই মানে শুধু পাঠ্যবই নয়, বাইরের বই। সংগঠন করো, স্কাউট, বন্ধুসভা, সাংস্কৃতিক সংগঠন, বিজ্ঞান ক্লাব, অভিযাত্রী ক্লাব ইত্যাদি। গান শোনো, চলচ্চিত্র দেখো, চিত্রকলা উপভোগ করা শেখো, মাঠে যাও, খেলো, না হলে সাপোর্টার হয়ে চিত্কার করে গলা ভেঙে আসো। আমরা যে ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করে দল হেরে গেলে কান্নাকাটি করি, সেটাও আনন্দের, সেটাও শিক্ষার। তার মানে জীবনে প্রতিবার চ্যাম্পিয়ন হওয়া যাবে না, মাঝেমধ্যে হারতেও হবে। হারলে আকাশ ভেঙে পড়ে না মাথায়।

এই কান্নাকাটিটুকুন আছে বলেই জীবন এত সুন্দর। তোমরা যারা পরীক্ষায় ফেল করেছ, তাদের বাবা-মাকে বলি, আপনার সন্তানটি আজ থেকে ৩০ বছর পরে দেখবেন যে ছেলে-মেয়ে ভালো করেছে, তার চেয়ে কোনো অংশে খারাপ কিছু করবে না।

তোমাদের সবার সাফল্য কামনা করি।