আব্বু, আমি তো তোমার কলিগ হয়ে গেলাম!

বাবা মাইনুল হাসান চৌধুরীর সঙ্গে রাহী হাসান চৌধুরী
ছবি: সংগৃহীত

টগবগ টগবগ টগবগ টগবগ ঘোড়া ছুটিয়ে

ঝিলমিল ঝিলমিল ঝিলমিল ঝিলমিল নিশান উড়িয়ে

ছোট্ট রাহী যাচ্ছে—হাতে খোলা তলোয়ার

দৈত্য-দানব যত আছ সবাই হুঁশিয়ার!

অমল মুখোপাধ্যায়ের গানটিতে সানন্দে আমার নাম জুড়ে দিয়ে গাইতে গাইতে পায়ের ওপর বসিয়ে আমাকে ঘোড়া চড়াতেন বাবা। আমার বাবা—মাইনুল হাসান চৌধুরী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক।

ছোটবেলায় আমাদের বাসায় দুই ধরনের মানুষের আনাগোনা লেগেই থাকত। এক দলে ছিলেন শিল্প-সাহিত্য অঙ্গনের মানুষ, যাঁরা আমার বাবার বন্ধু বা বন্ধুপ্রতিম। আরেক দলে ছিলেন বাবার প্রাক্তন ছাত্ররা। এই দল ছিল বেশ ভারী, কারণ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের আগেও একাধিক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার কারণে আমার বাবার ছাত্রছাত্রীর কোনো অভাব ছিল না।

তো ছোটরা যা করে আরকি। বাসায় কেউ এলে বসার ঘরের আশপাশে কৌতূহল নিয়ে ঘোরাফেরা করা ছিল আমার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। বাবার ছাত্রদের কথাবার্তায় আমি বুঝতে পারতাম, তাঁরা আমার বাবার গুণমুগ্ধ ভক্ত। মনের অজান্তেই আমার ভেতর শিক্ষকতা পেশার প্রতি একটা সরল আকর্ষণ (কিংবা মোহ) তৈরি হয়েছিল। এটা অবশ্য আমি আরেকটু বড় হওয়ার পর বুঝেছি।

আমার বাবার ব্যক্তিত্বটা এমন যে এটা অনুকরণ করতে চাওয়াই হয়তো স্বাভাবিক। অসম্ভব বইপ্রেমী একজন মানুষ তিনি। প্রায়ই দুহাতভর্তি বই নিয়ে বাসায় ফেরেন, সেখানে তাঁর নিজের পাশাপাশি আমাদের জন্যও বই থাকে। ছোটবেলায় রুশ দেশের উপকথা থেকে গল্প পড়ে শোনাতেন আমাকে, দব্রিন্যা নিকিতিচ আর খুদে ইভান–এ বুঁদ হয়ে থাকতাম আমি। আমার বড় চাচার ক্যামেরায় তোলা বাবার ছোটবেলার একটা ছবিতে তাঁকে দেখা যায় গাছের ডালে বসে বইয়ে ডুব দিয়ে আছেন! তাঁর এই বইপ্রীতি তিনি বেশ সফলতার সঙ্গে আমার মধ্যে সংক্রমিত করেছেন।

সত্যি বলতে, আমি কখনো এভাবে ভাবিনি যে আমাকে শিক্ষকই হতে হবে। তবে এই পেশার প্রতি দুর্বলতা সব সময় অনুভব করেছি। আমি খুব সৌভাগ্যবান যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়াশোনার পর এই বিভাগেই শিক্ষকতার সুযোগ পেয়েছি। আমার যোগদানের দিন বাবাকে মজা করে বলেছিলাম, ‘আব্বু, আমি তো তোমার কলিগ হয়ে গেলাম!’ বাবার চোখে আমি এক অদ্ভুত মুগ্ধতা দেখেছিলাম সেদিন।

প্রায় প্রতিদিনই শহর থেকে একই সময়ে শিক্ষকদের বাসে বাবার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা–যাওয়া (ক্লাসের সময়ের ভিন্নতার কারণে কখনো কখনো ভিন্ন বাসে যেতে হয়)। করোনা মহামারি যখন শুরু হলো, বাবা তখন ইংরেজি বিভাগের সভাপতির দায়িত্বে। এমন বিপজ্জনক দিনগুলোতেও বাবাকে দেখেছি কাজের টানে প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে। এদিকে আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের করোনা পরীক্ষা ল্যাবে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগদান করায় আমাদের ল্যাব সদস্যদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলাদা গাড়ির ব্যবস্থা করা হলো। সেই থেকে এখন পর্যন্ত বাবার সঙ্গে যাওয়া-আসার সুযোগ তেমন হয় না।

তবে করোনাকালে লকডাউন আমাকে একটা বিরল সুযোগ করে দিয়েছে। আমি এখন বাবার ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারছি! বাবা যখন অনলাইনে ক্লাস নেন, আমি সুযোগ পেলেই পাশে বসে থাকি। আমরা সবাই এটা বুঝতে পারি যে একজন শিক্ষকের পক্ষে অনলাইন ক্লাসকে প্রাণবন্ত করে তোলা খুব কঠিন। কিন্তু আমি বিস্ময় নিয়ে দেখি, বাবা কী প্রবল উৎসাহে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান।

শুধু পড়ানো নয়, করোনার এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা যেন মনোবল হারিয়ে না ফেলে, সে ব্যাপারে তাঁকে খুব সচেতন ও সচেষ্ট থাকতে দেখি। মানুষকে খুব ভালোবাসেন। আমি সব সময় দেখে আসছি আত্মীয়, বন্ধু, ছাত্র বা যে–কারও বিপদে–আপদে আমার বাবাকে ঝাঁপিয়ে পড়তে। আমি প্রতিনিয়ত আমার বাবার কাছ থেকে শেখার চেষ্টা করি, তাঁর মতো হওয়ার চেষ্টা করি। আমি চাই এই মহামারি বিদায় নিক। আমি আমার বাবার সঙ্গে আবার একই বাসে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাব, একদম আগের মতো।

লেখক: প্রভাষক, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়