এমি অ্যাওয়ার্ড যখন বাংলাদেশের রুবাইয়াতের ঘরে
ক্যারেক্টার অ্যানিমেটর সফটওয়্যার বিভাগে এমি অ্যাওয়ার্ডজয়ী দলের একজন বাংলাদেশের রুবাইয়াত হাবীব। সুখবরটা তাঁরা ২০১৯ সালেই পেয়েছিলেন। সে বছর ৭১তম টেকনোলজি অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এমি অ্যাওয়ার্ডজয়ীদের তালিকায় ছিল রুবাইয়াতের দলের নাম। কথা ছিল ২০২০ সালে ধুমধাম করে অনুষ্ঠান হবে। কিন্তু করোনা তা হতে দেয়নি। অগত্যা অনলাইনেই হয়েছে পুরো আয়োজন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্নাতক শেষে কীভাবে রুবাইয়াত হাবীব অ্যানিমেশনের সঙ্গে যুক্ত হলেন? যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল থেকে জানিয়েছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জিনাত শারমিন।
অভিনন্দন। বাংলাদেশের আরেকজন স্বনামধন্য অ্যানিমেশনকর্মী ওয়াহিদ ইবনে রেজার ফেসবুক পোস্ট থেকে জানলাম, এমি অ্যাওয়ার্ড এখন আপনার বাসায়। কেমন লাগছে?
আমাদের দলের প্রত্যেক সদস্যের বাড়িতে পুরস্কারটা দুই সপ্তাহ থাকবে। তারপর চলে যাবে আমাদের অফিসে। আগে টিভির পর্দায় এমি অ্যাওয়ার্ড দেখেছি। এবার সামনাসামনি দেখে খুব ভালো লাগছে। পুরস্কারটি বেশ ভারী ও বড়। আত্মীয় ও বন্ধুদের সঙ্গে এমি জয়ের আনন্দটা ভাগাভাগি করে বেশি ভালো লেগেছে। আর এই সবকিছুর মধ্যে সবচেয়ে বড় পাওয়া হলো অ্যানিমেশন ও গ্রাফিকসের সবচেয়ে মেধাবী প্রকৌশলী ও গবেষকদের সঙ্গে একই দলে কাজ করতে পারা।
পুরস্কারটি সম্পর্কে একটু বিস্তারিত বলবেন?
টেকনোলজি অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এমি অ্যাওয়ার্ড সারা বিশ্বের যুগান্তকারী অবদানগুলোকে স্বীকৃতি দেয়। এবার পেল আমাদের ক্যারেক্টার অ্যানিমেটর সফটওয়্যার। এর জন্ম প্রায় ছয় বছর আগে, আমাদের অ্যাডোবি রিসার্চ গ্রুপ থেকে।
কীভাবে অ্যানিমেশনে আগ্রহী হলেন?
এ প্রশ্নের উত্তরে আমি একটু পেছনে ফিরে যেতে চাই। বুয়েটের দিনগুলোয় মেহেদী হক, জাহিদ হোসেন, জি এম তানিমদের সঙ্গে কমিকস, কার্টুন আঁকতাম। কল্পনায় দেখতাম, আমার আঁকা চরিত্রগুলো হাসছে, গল্প করছে, আবার গম্ভীর মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর ভাবতাম, কী করলে দর্শককে আমি মনখুলে দেখাতে পারব যে আমার চরিত্রগুলো সবাই ‘ফুল অব লাইফ’। কিন্তু আঁকা চরিত্রগুলোকে নড়াচড়া করানো খুবই সময়সাপেক্ষ, ক্লান্তিকর আর ধৈর্যের কাজ। গত এক দশকে কম্পিউটার গ্রাফিকস আর অ্যানিমেশন দারুণ উন্নতি করেছে। তবে সেগুলো কেবল দক্ষ পেশাদার ব্যক্তিদের জন্য। অ্যানিমেশন যোগাযোগের দারুণ একটা মাধ্যম। তবে অ্যানিমেশনকে শিল্পী, ডিজাইনার, প্রকৌশলী, শখের অ্যানিমেটর বা সাংবাদিক—সবার জন্য সহজে ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে আমাদের অন্যভাবে ভাবতে হবে। এটাই ছিল আমার পিএইচডির মূল অনুপ্রেরণা। আমি অ্যানিমেশনকে স্কেচিংয়ের মতো সহজ করতে চেয়েছি। আমার বিশ্বাস, নিকট ভবিষ্যতে অ্যানিমেটেড ড্রয়িং একটা সর্বজনীন মাধ্যম হয়ে যাবে। আমরা সবাই কমবেশি ভিজ্যুয়াল ডায়াগ্রাম বা ছবি দিয়ে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করি। অ্যানিমেশন সেই স্থিরচিত্রগুলোতেও নতুন মাত্রা নিয়ে আসবে।
এক অলস দুপুরে আমি আমার সুপারভাইজারকে এমনিই মজা করে বললাম, ‘আচ্ছা, পিএইচডি থিসিসটা কমিকস আকারে লিখলে কেমন হয়?’ আমার সুপারভাইজার শুনেই এককথায় রাজি। তারপর কাজ করে দেখলাম, কমিকস আর থিসিস দুই মেরুর ব্যাপার। এদিকে তত দিনে আমার সুপারভাইজারের মাথায় ব্যাপারটা ঢুকে গেছে। আমি নতুন উদ্যমে মহানন্দে, হাসতে হাসতে, নাচতে নাচতে, থিসিসের একটা অংশ কমিকস, স্কেচিং, নানা কিছু দিয়ে ভরে ফেললাম।
আপনাদের তৈরি সফটওয়্যার দিয়ে কার্টুনকে ক্যামেরার সামনে জীবন্ত করা যায়। সফটওয়্যারটা কীভাবে কাজ করে? ভবিষ্যতে এটা দিয়ে কী কী ধরনের কাজ করা সম্ভব?
মূল আইডিয়াটা হলো কীভাবে আমাদের হাতে আঁকা (ফটোশপ) কার্টুনে প্রাণ (অ্যানিমেট) আনা যায়। শুধু ক্যামেরার সামনে অভিনয় করে অ্যানিমেশন ফিল্ম বানানোর ধারণা ইন্ডাস্ট্রিতে অনেক পুরোনো। তবে সে জন্য বেশ কিছু বিশেষ সরঞ্জাম ও সফটওয়্যার দরকার। তবে শুধু ওয়েবক্যাম দিয়ে টুডি ছবিকে অ্যানিমেট করার অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। বিশেষ করে যখন সেটি বৃহত্তর দর্শকদের জন্য বানানো হয়। যেমন হাতে আঁকা চরিত্রটির হয়তো দুটির বদলে একটি চোখ থাকতে পারে। অথবা নাকটা চোখের ওপরে থাকতে পারে। এ কারণে ক্যামেরা ইনপুট থেকে সরাসরি অ্যানিমেট করা অনেকটা চ্যালেঞ্জিং। অ্যাডোবির আরও অসংখ্য জাদুকরি প্রযুক্তির মতো ক্যারেক্টার অ্যানিমেটরের পেছনেও রয়েছে অসম্ভব প্রতিভাবান ও মেধাবী গণিতবিদ, প্রকৌশলী ও গবেষক। এ দলের সঙ্গে আমি আমাদের অ্যাপের জন্য অ্যানিমেশনের ইফেক্ট নিয়ে কাজ করেছি।
আপনার শিক্ষাজীবনের দিকে একটু যাই। অ্যানিমেশনের প্রতি ভালোবাসা থেকেই কি কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশলে ভর্তি হয়েছিলেন? নাকি ভর্তি হওয়ার পর ভালোবাসা তৈরি হলো?
আমি ছবি আঁকতে ভালোবাসতাম। ২০০২ সালে সিএসইতে ভর্তি হয়ে দেখি, এর সঙ্গে ড্রয়িংয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। অগত্যা আমাদের বিভাগীয় প্রধান আবুল কাশেম স্যারের কাছে সিএসই থেকে স্থাপত্যে বিভাগ পরিবর্তনের কাগজপত্র নিয়ে গেলাম। তিনি আমাকে বিভাগ বদলাতে তো দিলেনই না, এক ধমক দিয়ে ফেরত পাঠালেন। আমি সিএসইতে থেকে গেলাম। আমি আজ সেই ধমকের জন্য খুবই কৃতজ্ঞ। আমি পেশাদার কার্টুনিস্ট হিসেবে ক্যারিয়ার করতে চেয়েছি। কিন্তু দেশে সেই সুযোগ কম থাকায় বাইরে চলে আসি। ভিন্ন রকম কিছু করার চেষ্টা করি। খুব অল্প সময়েই আমার ফিল্ডের সেরাদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। যখন পিএইচডি করতে জাপান গেলাম, তখনই আমি জাপান সায়েন্স অ্যান্ড টেক এজেন্সি, মাইক্রোসফট রিসার্চ ইউএস আর অটোডেস্ক রিসার্চ কানাডার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। সে সময় আমি প্রতিদিন ১২ থেকে ১৫ ঘণ্টা কাজ করতাম। আপাতদৃষ্টিতে কঠোর পরিশ্রমের সেই দিনগুলো আমার খুবই ভালো কাটত। কখনো মনেই হতো না যে আমি কাজ করছি। তবে এ ক্ষেত্রে পরিবারের পূর্ণ সমর্থন থাকাটা জরুরি। আমি ভাগ্যবান, আমার সেটা ছিল।
আমাদের দেশের অনেক শিক্ষার্থী প্যাশন আর ক্যারিয়ার—এই দুইয়ের ভেতর গুলিয়ে ফেলে। যে বিষয়ে প্যাশন, সেই বিষয়ে ক্যারিয়ার করার সাহস পায় না কিংবা কীভাবে এগোবে বোঝে না। আপনার যাত্রাটা কেমন ছিল?
এটা আসলে সহজ নয়। আমি যখন পিএইচডি করছিলাম, তখন প্রায়ই নিজেকে প্রশ্ন করতাম। খুব কম মানুষকে দেখেছি, যারা আমার পথে হেঁটেছে। তাই ক্যারিয়ার নিয়ে একটা অনিরাপত্তাবোধ সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়ে ছিল। তবে ভালোবেসে ঝুঁকিটা নিয়েছি, অনিশ্চয়তাকেই জড়িয়ে ধরেছি। কিন্তু সেই অনিশ্চয়তাবোধকে কখনো আমার কাজে বিরক্ত করতে দিইনি। মন দিয়ে নিজের কাজটা করে গেছি। অনিশ্চয়তার ঘরে অনিশ্চয়তা থেকেছে।
একটা উদাহরণ দিই। পিএইচডির থিসিস লেখা খুব সহজ কর্ম নয়। অনেকের কাছে খুবই বিরক্তিকর। এক অলস দুপুরে আমি আমার সুপারভাইজারকে এমনিই মজা করে বললাম, ‘আচ্ছা, পিএইচডি থিসিসটা কমিকস আকারে লিখলে কেমন হয়?’ আমার সুপারভাইজার শুনেই এককথায় রাজি। তারপর কাজ করে দেখলাম, কমিকস আর থিসিস দুই মেরুর ব্যাপার। এদিকে তত দিনে আমার সুপারভাইজারের মাথায় ব্যাপারটা ঢুকে গেছে। আমি নতুন উদ্যমে মহানন্দে, হাসতে হাসতে, নাচতে নাচতে, থিসিসের একটা অংশ কমিকস, স্কেচিং, নানা কিছু দিয়ে ভরে ফেললাম। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এ সুবাদে আমার পিএইচডি থিসিসে লিখেছি কম; এঁকেছি, গ্রাফিকস করেছি বেশি। এটার একটা সুবিধা হয়েছে। আমার কমিটি মেম্বাররা তেমন একটা সংশোধনী দিতে পারেনি। তবে থিসিস পেপারকে এভাবে উপস্থাপন করার অনেক বড় ঝুঁকি ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি সেটা গ্রহণ না-ও করতে পারত। তবে আমার ভাগ্য ভালো ছিল। আমার ‘উদ্ভাবিত রিসার্চ ফরম্যাট’ এ ফিল্ডের অনেককেই অনুপ্রাণিত করেছে। এমনকি যারা সিএসইর না, তারাও আমার থিসিস পড়েছে। এটা কম্পিউটারবিজ্ঞানের প্রথম রিসার্চ পেপার, যেটা এই ফরম্যাটে করা।
এখন কোথায়, কী নিয়ে কাজ করছেন? সামনে দিনগুলোয় এ অ্যানিমেটর সফটওয়্যার নিয়ে বা কাজের ক্ষেত্রে আপনার পরিকল্পনা কী?
গবেষক হিসেবে আমি এখন নতুন ধরনের উপস্থাপন ও গল্প বলার কৌশল নিয়ে গবেষণা করছি। যেমন রিয়েলিটিস্কেচ। এগুলো বড় বড় একাডেমিক জার্নালে ছাপা হয়। এগুলো ভবিষ্যতের পণ্যের রূপরেখা। একসময় এসব থেকে সফটওয়্যার, অ্যাপ, টুলস—নানা কিছু হবে। যেভাবে অ্যাডোবি ক্রিয়েটর অ্যানিমেটরটা হলো। অন্যদিকে, আমি অ্যানিমেশনের মাধ্যমে আন্তযোগাযোগ, ডিজিটাল ডিজাইনিং, পেইন্টিং টুলস নিয়ে কাজ করছি। আমার মনে হচ্ছে, এটা ভবিষ্যতে অনলাইন যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটা মাত্রা দেবে।
বাংলাদেশে যারা অ্যানিমেশন নিয়ে কাজ করতে চায় বা তরুণ অ্যানিমেটরদের উদেশে কী বলবেন?
আমি বলব কাজের ক্ষেত্রে নিজের ভালোবাসার জায়গাটা খুঁজে বের করতে। আর ভালোবেসে সে কাজ করে যেতে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, নিজের ভালোবাসার ক্ষেত্র নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আমি আমার সমস্ত সময়ের ২০ ভাগ বরাদ্দ রাখি নতুন নতুন রিসার্চ আর্টিকেল আর বই পড়ার জন্য। প্রত্যেকেই অনন্য। ভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করাটাও খুব কাজে দেয়। বড় বড় সমস্যা নিয়ে কাজ করা ভালো। তাতে নতুন চিন্তার দুয়ার খুলে যায়। আপনার ফিল্ডের সেরা সব মানুষের সঙ্গে কাজ করার চেষ্টা করুন।