ওদের পড়ালেখা আর আমাদের পড়ালেখা কেন আলাদা
বাংলাদেশের বহু শিক্ষার্থীই এখন ভিনদেশের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনপাঠন আর একাডেমিক সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের দেশের ক্যাম্পাসগুলোর পার্থক্য কোথায়, জানালেন তেমনই ছয় শিক্ষার্থী।
যুক্তরাষ্ট্রে পরীক্ষার হলে নজরদারি থাকে না
রাহুল সাহা, শিক্ষার্থী, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনার পরিধি অনেক বড়। শিক্ষার্থীরা তাঁদের পছন্দমতো নানা ধরনের কোর্স নেওয়ার সুযোগ পান। বাংলাদেশে এই সুযোগ কম। আমি যেমন মেজর করছি কম্পিউটার বিজ্ঞানে, আর গণিতে মাইনর। পাশাপাশি নানা ধরনের কোর্সও করছি। যেমন সাইবর্গ সাইকোলজি নামের দারুণ একটা কোর্স করেছি, যেখানে মানুষ ও যন্ত্রের মধ্যকার সম্পর্কসহ বিভিন্ন মানসিক বিষয়ে জানার সুযোগ ছিল। ‘কোভিডকালে মিডিয়া’ নামের একটা কোর্স করলাম। যেখানে সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম বিষয়ে শেখার সুযোগ হয়েছে। বাংলাদেশের স্কুল-কলেজের পরীক্ষার চিত্র এখানে দেখা যাবে না। পরীক্ষার সময় ক্লাসরুমে শিক্ষক থাকেন না। কোনো নজরদারি নেই। সময়ানুবর্তিতা এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেমিস্টার শুরুর আগেই শিক্ষার্থীদের পুরো সিলেবাস ও কী কী পড়ানো হবে, কী কী কাজ করতে হবে, তা বেশ গুরুত্ব দিয়ে জানানো হয়। শিক্ষার্থীরা আগে থেকেই জানে, তার কতটা পরিশ্রম করতে হবে, কীভাবে পড়তে হবে। আমাদের দেশে শিক্ষাজীবনে গবেষণার সুযোগ অনেক কম থাকে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরা নিজের আগ্রহে গবেষণায় যুক্ত হতে পারেন। পড়াশোনার পাশাপাশি ইন্টার্নশিপ, ব্যবহারিক ক্লাস, কর্মশালা ও সামাজিক বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণকে এখানে ইতিবাচক হিসেবে দেখা হয়।
যুক্তরাজ্যে ‘একাডেমিক রাইটিং’ খুব গুরুত্ব পায়
আনিকা শাহজাবিন, শিক্ষার্থী, ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার্স ইন গ্লোবাল মার্কেটস, লোকাল ক্রিয়েটিভস, ইউনিভার্সিটি অব গ্লাসগো
শিক্ষা ক্ষেত্রে ‘একাডেমিক রাইটিং’কে খুবই গুরুত্ব দেওয়া হয়। পরীক্ষা থেকে শুরু করে যেকোনো লেখা বা অ্যাসাইনমেন্ট করার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের একাডেমিক যে লেখার রীতি আছে, তা অনুসরণ করতে হয়। ধরাবাঁধা মুখস্থ লেখার সুযোগ নেই। বরং ভেবেচিন্তে লিখতে হয়। আমাদের দেশের ক্যাম্পাসেরও অনেক ইতিবাচক দিক আছে। আমি যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটে পড়ার সময় বিভিন্ন প্রতিযোগিতা ও সামাজিক কাজে অংশ নিয়ে যেসব দক্ষতা রপ্ত করেছি, যেমন নেতৃত্ব দেওয়া বা পাবলিক স্পিকিং; এখানে সেসব খুব কাজে এসেছে।
তা ছাড়া আমি মনে করি, বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা ছোটবেলা থেকে যেসব সামাজিক দক্ষতা অর্জন করে, যে একাডেমিক কাঠামোর মধ্যে বেড়ে ওঠে, তাতে নিজের সেরাটা দেওয়ার একটা চেষ্টা থাকে। সে জন্যই আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা একটু চেষ্টা করলেই এখানে ভালো রেজাল্ট করতে পারে। কারণ এখানে প্রতিযোগিতা কম। আমাদের দেশে দেখা যায় ক্লাসে যা পড়ানো হয়, তার মধ্য থেকেই পরীক্ষায় প্রশ্ন আসে। এখানে তেমনটা নেই। অনেক বই-লেকচার-জার্নাল পড়ার সুযোগ থাকে। শিক্ষার্থীকে যে ক্লাসে যা পড়ানো হবে, তা লিখলেই নম্বর পাবে, এমনটি হয় না। বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতা কতটা অর্জিত হচ্ছে, সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
কোরিয়ায় পড়ালেখা অনেক ব্যয়বহুল
সাহিদুল ইসলাম, শিক্ষার্থী, চুংনাম ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়, দক্ষিণ কোরিয়া
দুই দেশের জীবনযাত্রা দুরকম, তাই পড়াশোনাও ভিন্ন। দেশে কিছু পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন, নির্ধারিত কিছু বই আর নোট ছিল পড়ার সম্বল। ক্লাসে যা পড়ানো হতো, সেগুলোই পরীক্ষায় আসত। দক্ষিণ কোরিয়ায় ক্লাসরুমের পড়াশোনা সে তুলনায় ভিন্ন। শিক্ষার্থীদের একদিকে যেমন নৈতিকতার বিষয়গুলো শেখানো হয়, তেমনি ভবিষ্যতের পেশাজীবনকে গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষকেরা পড়ানোর চেষ্টা করেন। এখানে নির্দিষ্ট সিলেবাস মেনে পড়াশোনা বা পরীক্ষা হয় না। শিক্ষার্থীরা সৃজনশীলতা কাজে লাগানোর সুযোগ পাচ্ছে কি না বা সমস্যা সমাধানের কৌশলগুলো শিখছে কি না, পরীক্ষার মাধ্যমে তা নিশ্চিত করেন শিক্ষকেরা।
এখানে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বিকাশের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয় বেশি। স্বাভাবিক সময়ে সারা বছরই শিক্ষার্থীদের নিয়ে চলে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও মেধাভিত্তিক আয়োজন। তবে দক্ষিণ কোরিয়ায় পড়াশোনা অনেক ব্যয়বহুল। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পড়ালেখা করেন অনেক শিক্ষার্থী। আমাদের দেশে যে কম খরচে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি পাওয়া যায়, সেটা এখানে কল্পনাই করা যায় না। তা ছাড়া আমার মনে হয়, এখানকার তুলনায় আমাদের দেশের ক্যাম্পাস অনেক বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষ ইংরেজি কম জানে বলেই হয়তো সবার সঙ্গে মিথস্ক্রিয়াটা ঠিক হয়ে ওঠে না।
কানাডায় অর্থনৈতিক পার্থক্যটাই চোখে পড়ে বেশি
মীর রিফাত উস সালেহীন, শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা
কানাডা এবং বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার পার্থক্য খুঁজতে গেলে প্রথমেই যেটা চোখে পড়বে, তা হলো অর্থনৈতিক পার্থক্য। এখানে শিক্ষা খাতে বাজেট অনেক। বেসরকারিভাবেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনুদান পায়। ফলে গবেষণা খাত থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা আধুনিক ও উন্নত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারে। পাঠ্যক্রম যেন জ্ঞান উৎপাদনমুখী হয়, এ ব্যাপারে তারা খুব সতর্ক। স্নাতকপর্যায়ে তো বটেই, অন্যান্য কোর্সের পাঠ্যক্রমেও দেখা যায় এমন অ্যাসাইনমেন্ট প্রাধান্য পাচ্ছে, যেগুলো যুক্তি এবং গবেষণানির্ভর।
এতে প্রচুর লিখতে ও পড়তে হলেও মুখস্থ করতে হয় কম। তাই এখানের শিক্ষার্থীরা যখন স্নাতকপর্যায়ে ওঠে, তত দিনে গবেষণাকেন্দ্রিক লেখাপড়াতে অনেকটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। ক্লাস নেওয়ার পদ্ধতিও আমাকে একটু অবাক করেছিল। আমার নেওয়া কোনো কোর্সে শিক্ষকেরা এসে লেকচার দিতেন না, পরিবর্তে ‘সেমিনার’ হতো। প্রতি সপ্তাহে আগে থেকে দেওয়া বই এবং গবেষণাপত্র পড়ে তার ওপর নিজের একটা প্রতিক্রিয়াপত্র (রিঅ্যাকশন পেপার) লিখে জমা দিতে হতো এবং সেমিনার ক্লাসে আলোচনা করতে হতো। শিক্ষক সেখানে অনেকটা সঞ্চালকের ভূমিকায় থাকতেন। এসব ছাড়াও আমার মনে হয়েছে, বিভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতির উপস্থিতি এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরির প্রতি গুরুত্ব দেওয়াও এখানের লেখাপড়ার একটা বড় বৈশিষ্ট্য। ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ যুক্ত হয় বলে ক্লাসের আলোচনা এবং গ্রুপ ওয়ার্ক বৈচিত্র্যময় ও সমৃদ্ধ হয়।
ফিনল্যান্ডে সহযোগিতা ও সহমর্মিতা শিখছি
কুমকুম আক্তার, শিক্ষার্থী, জেএএমকে ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লায়েড সায়েন্স, ফিনল্যান্ড
করোনার কারণে এক বছর অনলাইনে লাইভ ক্লাস, প্রেজেন্টেশন, কর্মশালাসহ নানা কিছুতে ব্যস্ত ছিলাম আমরা। তখন একটা অদ্ভুত বিষয় লক্ষ করেছি—এখানে বাড়ির কাজ বা হোমওয়ার্ক অনেক কম থাকে। দলীয় বা গ্রুপ ওয়ার্কের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয় বেশি। দেশে আমাদের পড়াশোনা ছিল পুরোটাই বইপত্র আর নোটনির্ভর। পরীক্ষার জন্য বেছে বেছে পড়তাম। ফিনল্যান্ডে ক্লাসরুমের পড়াশোনার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মানবিক মূল্যবোধ বিকাশের দিকে জোর দেওয়া হয় বেশি।
একটা ক্লাসরুমে নানা দেশের শিক্ষার্থীরা থাকেন। ক্লাসরুমে কেউ রুশ, কেউ ভারতীয়, আবার কেউ ইউরোপের অন্য দেশ থেকে এসেছেন। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের কারণেই শিক্ষকদের বাড়তি খেয়াল রাখতে হয়। যেহেতু দলগত কাজে নম্বর থাকে, তাই শিক্ষার্থীদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার একটা চর্চা আছে।
চীনে পড়াশোনা ও সহশিক্ষা সমান গুরুত্বপূর্ণ
মঈন উদ্দিন হেলালী, শিক্ষার্থী, সাউথওয়েস্ট পেট্রোলিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়, চেংডু, সিচুয়ান, চীন
চীনে সব বিশ্ববিদ্যালয়ই অনেক জায়গাজুড়ে গড়া। একটা ক্যাম্পাসের মধ্যেই সব শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা থাকেন। চীনাদের সংস্কৃতির শিকড় অনেক গভীরে, বিদেশি শিক্ষার্থী হিসেবে তা জানার অনেক সুযোগ আছে। আরেকটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, এখানে গবেষণাকে খুব গুরুত্ব দেওয়া হয়। নানা সুযোগ সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সব সময়ই শিক্ষকেরা জানাতে থাকেন। স্নাতক শেষ করার আগেই বেশির ভাগ শিক্ষার্থীকে অন্তত একটি নিবন্ধ প্রকাশ করতে দেখা যায়। শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিশাল লাইব্রেরি ব্যবহারের সুযোগ পান। শুধু ক্লাসরুমের পড়াশোনা নয়, শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক শিক্ষার দিকে এখানে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। সহশিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও সামাজিক সম্পর্ক তৈরির সুযোগ করে দেওয়া হয়।