‘কৃত্রিম স্বপ্ন বিসিএস, মন কেড়েছে’
চট্টগ্রামের সিটি সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ৩৩ নম্বর কক্ষে সুনসান নীরবতা। রেজিস্ট্রেশন নম্বর অনুযায়ী আমরা নিজেদের আসনে ভাবগাম্ভীর্য বজায় রেখে বসে আছি। সবাই সবার অপরিচিত এবং সোসাইটি মেইনটেইন করতে গিয়ে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কেউ কারও সঙ্গে কথা বললাম না। প্রায় ১৫ মিনিট এভাবেই কেটে গেল।
সকাল ৯টা ৩০ মিনিট। ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে আমাদের কক্ষে প্রবেশ করলেন একজন ভদ্রলোক। হাতের কাগজপত্র টেবিলে রাখতে রাখতে তিনি বললেন, ‘যাঁদের রেজিস্ট্রেশন নম্বরের পাশে সবুজ কালিতে ১ লেখা, তাঁরা দাঁড়ান।’
ওমা! ভালো করে তাকিয়ে দেখি আমার রেজিস্ট্রেশন নম্বরের পাশে সবুজ কালিতে ১ লেখা। অথচ গত ১৫ মিনিটে একবারও খেয়াল করিনি! (কী গাধা আমি!) অবশ্য আগে থেকে না জানলে নতুনদের ক্ষেত্রে এমনই হওয়ার কথা।
যাই হোক, এবার ঘটনা একেবারে পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে। অর্থাৎ বিসিএস পরীক্ষায় একটি কোডে চারটি সেট হয়। যেমন ৪৩তম বিসিএস প্রিলিমিনারি টেস্টে নীলকণ্ঠ নামক কোডে ১, ২, ৩ ও ৪ নম্বর সেটের মধ্যে ১ নম্বর সেট আমার। যেহেতু আমার রেজিস্ট্রেশন নম্বরের পাশে সবুজ কালিতে ১ লেখা ছিল।
সকাল ৯টা ৫৫ মিনিটের মধ্যে পরীক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তরপত্র বিতরণ, উপস্থিতি স্বাক্ষর গ্রহণ, পর্যবেক্ষকের দুটি স্বাক্ষর এবং ওএমআর শিট পূরণের কাজ সম্পন্ন। এরপর সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত নিরিবিলি পরীক্ষা। অবশ্য এর মধ্যে ওএমআরের একটি অংশ কেটে নিয়েছেন পরীক্ষা পর্যবেক্ষক।
পুরোই যেন টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। ১২০ মিনিটে ২০০ নম্বরের টার্গেট। আমাদের টাইগাররা ১২০ বলে ২০০ রান তো দূরে থাকুক, ১৪০ রানের টার্গেটে স্কটল্যান্ডের সঙ্গে খেলতে নেমে যে আতঙ্কে ছিল, আমি কিন্তু ২০০ নম্বরের পরীক্ষায় বিন্দু পরিমাণও আতঙ্ক অনুভব করিনি।
একেবারে নির্ভারভাবে পরীক্ষা দিলাম। এই প্রথম কোনো পরীক্ষা দিতে আমার খুবই ভালো লেগেছে। তবে ফলাফল দিলেই বোঝা যাবে, আসলে পরীক্ষা কেমন হয়েছিল!
পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছিল। লক্ষ্মীপুর থেকে বাসে ভেসে ভেসে ফেনী এসে, আবার বাসে উড়াল দিলাম চট্টগ্রাম, এটা পরীক্ষার আগের রাতের কথা।
‘পরীক্ষার দিন ঘুম থেকে উঠতেই মনে হলো ১০টা বাজে! ইশ্! এখানেও দেরি হয়ে গেল! আফসোস হচ্ছিল!’ এ সময় মুঠোফোন হাতে নিয়ে দেখি আসলে ভোর পাঁচটা বাজে। হুঁশ ফিরে এলে বুঝতে পারলাম, ‘এতক্ষণ স্বপ্নে বিভোর ছিলাম।’
যাই হোক, বন্ধুর ঘড়ি হাতে দিলাম, ওর একটি ফাইলে অ্যাডমিট কার্ড নিলাম। এরপর ওর থেকে ৫০০ টাকা নিয়ে পরীক্ষার হলের দিকে রওনা দিলাম বাবু ভাইয়ের সঙ্গে।
কিন্তু আফসোস! পরীক্ষার হলে শখের মুঠোফোন এবং টাকার ব্যাগ তো দূরে থাক, আমার বন্ধুর সিকো ঘড়িটা নিয়েও আমাকে ঢুকতে দিলো না ওরা (পুলিশ)। রাগে-ক্ষোভে অনেক কিছু করা যেত, কিন্তু আমার তখন একটুও রাগ হয়নি।
কারণ, ৩৩ নম্বর কক্ষে প্রবেশ করে দেখি, ‘বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন’ লেখা একটি ঘড়ি দেয়ালে লাগানো আছে। পাশেই আছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ওয়াশরুম। তা ছাড়া যথাসময়ে ঘণ্টার শব্দ এবং পর্যবেক্ষকের অমায়িক আচরণে পূর্ণতা পেয়েছে ৪৩তম বিসিএস প্রিলিমিনারি টেস্ট আয়োজন।
প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স, মাস্টার্স এবং একাধিক চাকরির পরীক্ষায় এমন পূর্ণতা ও সুশৃঙ্খলতা দেখিনি। যে কারণে কোনো পরীক্ষা এভাবে উপভোগ করারও সুযোগ পাইনি।
আসল কথা হলো ‘বিসিএসের প্রেমে পড়েছি। দেখা যাক কী হয়...।’
আফসোস! আমরা ব্যাকবেঞ্চার, অমেধাবী ও গরিবের ছেলে ছিলাম বলে উচ্চবিদ্যালয় কিংবা কলেজের প্রিয় শিক্ষকদের কাছ থেকে বিসিএসের গল্প শুনতে পারিনি। যে কারণে এর আগে বিসিএস বুঝিনি, স্বপ্ন দেখারও কৌতূহল জাগেনি।
এখন বুঝেছি—
‘সময়ে সম্পূর্ণ করিলে সময়ের কাজ,
বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি এত কঠিন হতো না আজ।’
লেখক : রাকিব হোসেন আপ্র, শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়