জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা কি পারবে সব শিশুর শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে?

পাবলিক পরীক্ষা শিশুদের উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি করছে। ছবি: হাসান রাজা

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর ক্ষণে বাংলাদেশে বর্তমানে ১৬ থেকে ৬৪ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৮ শতাংশ। দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য আমরা এ জনমিতির সুফল পেতে চাই, কারণ, এরপর আমাদের বর্ষীয়ান নাগরিকদের সংখ্যা বেড়ে যাবে। এ ছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশের প্রতিবন্ধিতা রয়েছে। কাজেই বাংলাদেশের এ বিপুল জনগোষ্ঠী যাদের বিশেষ চাহিদা রয়েছে, তাদের শিক্ষায়, চাকরির ক্ষেত্রে ও সমাজে একীভূত করতে না পারলে জনমিতিক সুফল অর্জন সম্ভব নয়। আবার বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের প্রায় ২০ শতাংশ শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। নানা বৈষম্যের কারণে শিক্ষার বিভিন্ন স্তর থেকে ঝরে পড়ছে বিপুলসংখ্যক শিশু। এ ছাড়া সার্বিকভাবে উৎপাদনে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীর মাত্র ৩১ শতাংশ নারী। কাজেই বৈষম্যের শিকার জনগোষ্ঠীকে দক্ষ, উৎপাদনশীল ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন না করতে পারলে বাংলাদেশের উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে না। মানুষের মধ্যে বৈচিত্র্য, চাহিদা, সক্ষমতা, আর্থসামাজিক, ধর্মীয়, লিঙ্গগত, ভাষাগত, নৃতাত্ত্বিক পরিচিতির ভিত্তিতে নানাবিধ বৈষম্য বিদ্যমান। দেশের সব নাগরিককে সমঅধিকারের ভিত্তিতে শিক্ষা প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে উৎপাদনশীল করতে পারলেই পরিপূর্ণ জনমিতিক সুফল অর্জনের মাধ্যমে ২০৪১–এর উন্নত বিশ্বের লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ যেহেতু শিক্ষায় বড় সংস্কার আনার পরিকল্পনা করছে, তাই এখানে প্রত্যাশাও বেশি। এ জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা এসব বৈচিত্র্য বিবেচনা করে কী কী পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, তা উপলব্ধি করা জরুরি।

সব শিশুদের শিক্ষায় নিয়ে এলেই অন্তর্ভুক্তি (ইনক্লুশন) অর্জিত হয় না। তারা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারছে কি না, শিখন শেষে যোগ্যতা অর্জন করছে কি না, সব মানুষ তাদের ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করছে কি না—এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে পারলেই কেবল ইনক্লুশন অর্জন সম্ভব। অতীতেও দেখা গেছে সরকারের নানা উদ্যোগের মাধ্যমে শিক্ষার বাইরে থাকা শিক্ষার্থীদের নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে (উপবৃত্তি, সচেতনতা সৃষ্টি, অভিভাবকদের সহায়তা) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ফলে শিক্ষায় ভর্তির হার বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু শিখন শেখানো প্রক্রিয়া, মূল্যায়ন ও শিখন পরিবেশগুলো শিশুর সামর্থ্য, বৈচিত্র্য, প্রবণতা এবং চাহিদা অনুযায়ী না সাজানোর ফলে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রয়েই গেছে। ফলে সমাজের সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের (যেমন: প্রতিবন্ধী, কর্মজীবী শিশু) ভর্তির হারও একটা সময় পরে কমতে শুরু করেছে।

জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১–এর একটি শক্তিশালী দিক হলো সব শিশুকে এ শিক্ষাক্রম রূপরেখা ইনক্লুশনের লক্ষ্য দল হিসেবে বিবেচনা করে ধারণাগত দিক থেকে ইনক্লুশনের ব্যাপকতাকে সমর্থন দিয়েছে। সেই সঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে এ রূপরেখা শিশুর মধ্যে সমস্যা (যেমন: প্রতিবন্ধী, দারিদ্রপীড়িত, ভাষা ভিন্ন, লিখতে পারে না) খোঁজার বিতর্কিত সীমাবদ্ধতা মতবাদকে ছুড়ে ফেলে শিশুর বৈশিষ্ট্যকে তার বৈচিত্র্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। শিক্ষাক্রম রূপরেখা ইনক্লুশনের ন্যায্যতামূলক মতবাদকে সমর্থন করেছে, যেখানে শিক্ষার্থীর সমস্যার পরিবর্তে তাদের বৈচিত্র্য অনুযায়ী চাহিদা পূরণে শিক্ষাব্যবস্থা ও কাঠামোর সীমাবদ্ধতাকে দায়ী করা হয়। যেমন সব শিক্ষার্থীর সামর্থ্য বিবেচনা না করে শিখন যোগ্যতা নির্ধারণ করা, শিক্ষকের সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতা এবং সর্বোপরি শিখন শেখানো কৌশল, নমনীয় শিখন পরিবেশ, মূল্যায়ন কৌশল, শিখন উপকরণ না থাকা।

এবার আরেকটু গভীরে গিয়ে দেখা যাক শিক্ষাক্রম রূপরেখা ইনক্লুশনের ন্যায্যতার মতবাদকে কীভাবে বাস্তবায়ন নির্দেশনা দিয়েছে। প্রথমেই দেখা যাক যোগ্যতা নির্ধারণের বিষয়টি। যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমে যোগ্যতা নির্ধারণের সময় যদি শিক্ষার্থীর সামর্থ্য, বৈচিত্র্য, প্রবণতা এবং চাহিদা বিবেচনার সুযোগ না থাকে, তবে যোগ্যতার ধরনই বৈষম্য তৈরি করতে যথেষ্ট। উদাহরণস্বরূপ, বাংলার একটি যোগ্যতা যদি হয়, ‘নির্দেশনা শুনে সহজ শব্দ ও বাক্য লিখতে পারা, তবে একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে কোনো শিক্ষার্থীর যদি শ্রবণ প্রতিবন্ধিতা থাকে বা শারীরিক প্রতিবন্ধিতার কারণে সে লিখতে না পারে, বা যদি শিক্ষার্থী লিখে প্রকাশ করতে পারদর্শী না হয় তাহলে তার পক্ষে এ যোগ্যতা অর্জন কোনো দিনও সম্ভব হবে না। এ যোগ্যতাটিকেই যদি এভাবে বলা হয়, নির্দেশনাকে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে অনুভব ও উপলব্ধি করে একাধিক সহজ বাক্যে ভাব প্রকাশ (লেখা, আঁকা, ব্রেইল...) করতে পারা। এর ফলে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে উপলব্ধি করার বিষয়টি উল্লেখ থাকায় কোনো শিক্ষার্থীর শ্রবণ প্রতিবন্ধিতা থাকলেও অন্য ইন্দ্রিয় (যেমন: দৃষ্টি বা স্পর্শ) ব্যবহার করে সে নির্দেশনাটি বুঝতে পারবে। একইভাবে বাক্য লিখে প্রকাশের পাশাপাশি আঁকা, ব্রেইল প্রভৃতি উপায়ে প্রকাশের সুযোগ রাখার ফলে শিক্ষার্থীর লিখতে চ্যালেঞ্জ থাকলেও যোগ্যতা প্রকাশের বিকল্প উপায় থাকবে। আবার বহুমুখী বুদ্ধিমত্তার ধারণা অনুযায়ী কোনো শিক্ষার্থী লিখে যোগ্যতা প্রকাশ করার জন্য আগ্রহী না হলে তার সব দিক চর্চার মাধ্যমে লেখার বিকল্প উপায়ে ভাব প্রকাশের সুযোগ পাবে। শিক্ষাক্রম রূপরেখায় এভাবেই অনুভব ও উপলব্ধি করা এবং তা বহুমুখী উপায়ে প্রকাশের বিষয়টিকে বিভিন্ন শিক্ষাক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট যোগ্যতা নির্ধারণে অনুসৃত হওয়ায় শিক্ষার্থীর সামর্থ্য, বৈচিত্র্য, প্রবণতা এবং চাহিদার বিষয়গুলো সঠিক উপায়ে পূরণের পথ তৈরি হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে যেসব দেশে শিক্ষাক্রম পরিমার্জন হয়েছে (যেমন: ফিলিপাইন, নিউজিল্যান্ড) সেসব দেশেও যোগ্যতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর বহুমুখী গ্রহণ, অনুভব ও বহুমুখী প্রকাশকে বিবেচনা করা হয়েছে।

শিক্ষাক্রম রূপরেখা–২০২১ অনুযায়ী শিখন-শেখানো আর শিক্ষককেন্দ্রিক ও মুখস্থনির্ভর হচ্ছে না। যার ফলে পড়ালেখা আর শুধু শ্রেণিকক্ষের মধ্যে আবদ্ধ থাকছে না, পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে ঘটবে। প্রয়োজন অনুযায়ী একক, জোড়ায় বা দলে বিভক্ত করে হাতে কলমে শিখন, প্রকল্পভিত্তিক, সহযোগিতামূলক, স্বপ্রণোদিত শিখনের সংমিশ্রণ করা হবে। যেখানে বিভিন্ন মানুষের সংশ্লিষ্টতা থাকবে, ফলে একজন পিছিয়ে পরা শিক্ষার্থী শিখন প্রক্রিয়ায় শিক্ষকের পাশাপাশি সতীর্থ, অভিভাবক ও পরিবারের সহযোগিতা পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। তা ছাড়া এ শিখন প্রক্রিয়ায় বহু ইন্দ্রিয় ব্যবহার হবে এবং উপকরণগুলোও অনুভবযোগ্য হবে, ফলে তাদের বিশেষ শিখন-চাহিদা পূরণের সুযোগ সৃষ্টি হবে। রূপরেখায় অতি মেধাবী শিশুদের শিখন-চাহিদা, সক্ষমতা ও বৈশিষ্ট্যকে বিবেচনায় নিয়ে তাদের বয়সের সীমায় আটকে না রেখে অগ্রগামী-শিখনের বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে (যেমন: গণিত, বিজ্ঞান বা সাহিত্য অলিম্পিয়াড) নির্দিষ্ট বিষয়ে দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার উপায় রাখা হয়েছে। শিক্ষাক্রম রূপরেখা অনুযায়ী শিখনকালে মূল্যায়নের ওপর গুরুত্ব দিয়ে লিখিত পরীক্ষাভিত্তিক মূল্যায়নের পরিবর্তে আরও বৃহৎ পরিসরে মূল্যায়নকে ভাবা হয়েছে, যেখানে শিক্ষককেন্দ্রিকতার বদলে শিক্ষার্থী নিজে, শিক্ষক, অভিভাবক, পরিবার ও এলাকার লোকজনকেও সম্পৃক্ত করার কথা বলা হয়েছে। মূল্যায়নেও লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা ছাড়াও প্রকাশের নানা মাধ্যমকে (আঁকা, ইশারা-ভাষা, ছবি, সংগীত, স্পর্শ-ভাষা, কাজের ফলে পরিবেশে পরিবর্তন) গুরুত্ব দেওয়ায় প্রতিবন্ধী ও অতি মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী মূল্যায়নের সুযোগ থাকবে।

নতুন শিক্ষাক্রম রূপরেখা অনুযায়ী ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষাভিত্তিক শিখনের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ, দুর্যোগের সময় শিক্ষার ধারাবাহিকতাসহ বিভিন্ন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষায় অংশগ্রহণের বিকল্প নমনীয় উপায় নির্ধারণ সম্পর্কে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একইভাবে শিশু যাতে নিজের জেন্ডার পরিচিতি (ছেলে, মেয়ে, তৃতীয়/রূপান্তরিত লিঙ্গ) নিয়ে গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে শিক্ষাব্যবস্থায় প্রবেশ ও সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিখন অর্জন করতে পারে, সেই বিষয়েও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

কাজেই বিশ্ব সাদাছড়ি নিরাপত্তা দিবসে এটা আশা করা যেতেই পারে জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ, সহমর্মিতা, সম্প্রীতি, বৈচিত্র্যকে সম্মান প্রভৃতি গুণাবলিসম্পন্ন অভিযোজনে সক্ষম, সুখী এবং বিশ্ব নাগরিক তৈরি হবে যারা সাম্য, ন্যায্যতা, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করবে।

  • লেখক: এম তারিক আহসান, অধ্যাপক, আইইআর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সদস্য, জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটি