‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ নিয়ে কিছু কথা

ফাইল ছবি

৫ অক্টোবর ইউনেসকো কর্তৃক স্বীকৃত ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’। নিঃসন্দেহে শিক্ষকদের জন্য দিনটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, শিক্ষকদের সম্মানার্থে পৃথিবীর বহু দেশে দিনটি উদ্‌যাপিত হয়। বিভিন্ন দেশে শিক্ষকদের তাঁদের নিজস্ব কর্মক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য সম্মাননা দেওয়া হয়। আমি এ শিক্ষক দিবস উপলক্ষে পৃথিবীর সব স্তরের সম্মানিত শিক্ষককে জানাচ্ছি আন্তরিক শ্রদ্ধা ও প্রাণঢালা অভিনন্দন।
১৯৯৫ সাল থেকে প্রতিবছর ৫ অক্টোবর তারিখ বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে থাকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস। দিবসটি পালনে এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল (Education International-EI) ও তার সহযোগী ৪০১টি সদস্য সংগঠন মূল ভূমিকা রাখে। দিবসটি উপলক্ষে ইআই প্রতিবছর একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করে থাকে, যা জনসচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকতা পেশার অবদানকেও স্মরণ করিয়ে দেয়। এ বছরের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘ভবিষ্যতের সংকট মোকাবিলায় শিক্ষকসমাজ।’

এ বৎসরের প্রতিপাদ্যটি খুব সুন্দর। আসলেই শিক্ষকদের কাজই হচ্ছে ভবিষ্যতের বিনির্মাণের জন্য কর্মী তৈরি করা। এটি কোনো সাধারণ কাজ নয়। এটি নিঃসন্দেহে একটা সৃজনশীল কাজ। কারণ, শিক্ষক ইট–পাথরের মতো কোনো জিনিস নিয়ে কাজ করেন না। তিনি কাজ করেন রক্ত–মাংস দিয়ে গড়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে, যাদের মধ্যে আছে অসাধারণ একটা মন। আর এই মনের ওপর ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করেই শিক্ষার্থীকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করতে হয়। ভবিষ্যৎ মানেই স্বপ্নের হাতছানি। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের কাছে তো বটেই। আর এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন মানেই তো হাজারো সংকটের মুখোমুখি দাঁড়ানো। শুধু দাঁড়ালেই তো চলবে না। সংকটকে মোকাবিলা করে স্বপ্নময় সোনালি দুয়ার খুলতে হবে। আর এই কাজের উপযোগী করে গড়ে তোলার মতো চ্যালেঞ্জিং কাজটাই করে থাকেন শিক্ষক। এখানেই অন্যসব পেশার সঙ্গে শিক্ষকতার পার্থক্য।

এমনিতেই শিক্ষকতা একটা চ্যালেঞ্জিং পেশা। তার ওপর তাঁদের কাজ করতে হয় অনেক সমস্যার মধ্য দিয়ে। যেমন, আমার স্কুলের কথাই বলি। আমাদের স্কুলটা ডাবল শিফটের একটা সরকারি মাধ্যমিক স্কুল। এর সৃষ্ট পদ ৫৩টি। আমি এই স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক। কিন্তু ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করি। আর একজন সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদ খালি। ৫৩ জন শিক্ষকের জায়গায় আমরা আছি ২৭ জন শিক্ষক। এত বড় একটা স্কুলে একজন মাত্র সরকারি অফিস সহায়ক আছেন।

নৈশপ্রহরী, সুইপার, দারোয়ান ইত্যাদি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো খালি পড়ে আছে। কিন্তু স্কুল তো চালাতে হয়। তাই বেসরকারিভাবে এ স্কুলে বেশ কয়েকজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ করা হয়েছে, যাঁদের বেতন দিতে হয় অত্যাবশ্যকীয় কর্মচারী তহবিল থেকে। সরকারি পরিপত্র অনুযায়ী, প্রতি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে এ তহবিলের জন্য মাসে ২০ টাকা করে আদায় করা যায়। এ তহবিলের টাকা থেকে বিভিন্ন কর্মচারীকে ৪৫০০ টাকা থেকে ৬০০০ টাকা বেতন দিই। হিসাব করলে দেখা যায়, তাঁরা দৈনিক ১৫০টাকা থেকে ২০০ টাকা হারে বেতন পান। এই টাকায় তাঁরা কীভাবে সংসার চালান আর কতটুকু মনের আনন্দে বিদ্যালয়ের কাজ করেন আমি বুঝি না। তাঁদের হাতে বেতনটা তুলে দেওয়ার সময় আমি খুবই সংকোচ বোধ করি। শুধু যে আমাদের স্কুলের এ অবস্থা তাই নয়, বরং সারা বাংলাদেশের প্রতিটা সরকারি মাধ্যমিক স্কুলের একই অবস্থা।

ফাইল ছবি

এমনিতেই শিক্ষকসংকট। এ ছাড়া শুধু শিক্ষক হলেই তো স্কুল চলবে না। স্কুলের কার্যক্রম সুন্দরভাবে চালাতে হলে সহায়ক স্টাফ জরুরি। স্কুলের শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ তখনই নিশ্চিত হবে, যখন স্কুলসংশ্লিষ্ট সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকবে। তবে নতুন শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টিও প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। আমাদের শূন্যপদগুলো পূরণ হয়ে গেলে স্কুলের শিক্ষার্থীদের সুবিধা যে বেড়ে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এ ছাড়া সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রমোশন যেন সোনার হরিণ। শত শত প্রধান শিক্ষকের পদ খালি পড়ে আছে। কিন্তু প্রমোশন নেই। সহকারী প্রধান শিক্ষকদের প্রধান শিক্ষক হিসেবে প্রমোশন হলে সিনিয়র শিক্ষকদের সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদে প্রমোশন পাওয়ার সুযোগ হবে। প্রমোশন হলে কাজে গতি বাড়বে। যা–ই হোক সম্প্রতি সহকারী শিক্ষকেরা সিনিয়র শিক্ষক পদে প্রমোশন হওয়ায় প্রমোশনের ক্ষেত্রে বন্ধ্যত্ব কিছুটা হলেও কেটেছে। কিন্তু সিলেকশন গ্রেড, টাইম স্কেল ইত্যাদির জটিলতা রয়েই গেছে। এ ছাড়া যাঁদের চাকরিতে সাত বছর পূর্ণ হয়েছে, তাঁদের পদন্নোতিরও ব্যবসথা করা দরকার। এসব সমস্যার দ্রুত সমাধান জরুরি। আর তা করতে হবে শিক্ষার্থীদের স্বার্থে, শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির স্বার্থে। আর তখন শিক্ষকও অনুকূল পরিবেশে সুন্দরভাবে পাঠদান করতে পারবেন।

শিক্ষার্থীদের অধিকার ক্ষুণ্ন না হয় লক্ষ্য সেদিকে

এ তো গেল সমস্যার কথা। সমস্যা সব দেশেই কমবেশি আছে। আমাদের সমস্যা হয়তো কিছু বেশি। তবে এর মধ্যেও আমাদের শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে হবে। আমাদের অধিকারের কথা যেমন ভাবতে হবে, তেমনি শিক্ষার্থীদের অধিকার যাতে কোনোভাবেই ক্ষুণ্ন না হয়, সেদিকটার প্রতিও লক্ষ্য রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, শিক্ষার্থীরা আমাদের সন্তানের মতো। শত প্রতিকূলতা, সংকট, আর বাধাবিপত্তির মধ্যেও তাদেরকে এগিয়ে নিতে হবে। তাদের পাশে থেকে স্বপ্নের ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণের উদ্দেশ্যে তাদের স্বপ্নবাজ করে গড়ে তুলতে হবে। আমাদের বঞ্চনার প্রভাব তাদের ওপর কোনোভাবেই যাতে না পড়ে, তা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ রাখতে হবে। একজন সত্যিকারের শিক্ষকের বাধাবিপত্তিকে অতিক্রম করার লড়াকু মানসিকতা থাকতে হবে। আর এই মানসিকতাটা শিক্ষার্থীদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে হবে। তবেই তারা জীবনসংগ্রামে জয়ী হওয়ার জন্য লড়াই করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে।

ফাইল ছবি

বিশ্বে যেসব শিক্ষক স্মরণীয়-বরণীয় হয়েছেন, তাঁরা লড়াই যেমন করেছেন, তেমনি ধৈর্য আর ত্যাগের অসাধারণ দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কথাই বলি। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক হতে গিয়ে উনি কত যে লাঞ্ছনা আর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তা তো সবার জানা। কিন্তু পবিত্র কোরআনের মাধ্যমে মহান আল্লাহ তাআলা প্রেরিত হুকুম–আহকামগুলো মানুষকে শিক্ষা দিতে কখনো পিছপা হননি। জাগতিক কোনো কিছুর জন্য নয়, বরং মহান আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তিনি আজীবন শিক্ষাদানের কাজটি করে গেছেন। যার ফলে বিশ্ব আজ পেয়েছে শান্তির এক পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান ইসলাম, যা ইহকাল আর পরকালের শান্তি ও কামিয়াবি লাভের উপায়।

বিশ্ব বিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিস মূলত ছিলেন একজন শিক্ষক। আর তার এই শিক্ষাদানের পিছনে জাগতিক কোনো চাওয়া–পাওয়ার বিষয় না থাকা সত্ত্বেও তাঁকে এথেন্সের তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। তাতে সক্রেটিসের অবশ্য কোনো ক্ষতি হয়নি, বরং সারা বিশ্বে আজ তিনি স্মরণীয়-বরণীয় এক দার্শনিক ও শিক্ষকের প্রতীক হয়ে বেঁচে আছেন কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ের মনিকোঠায়।

আমাদের বঙ্গবন্ধুর কথাই বলি। তাঁর কর্ম, আদর্শ আর ত্যাগের মাধ্যমেই তিনি আজ এ দেশের লক্ষ-কোটি মানুষের কাছে একজন বড় মাপের রাজনৈতিক শিক্ষাগুরু। ঘাতকেরা তাঁকে হত্যা করে তাঁর নাম-নিশানা পর্যন্ত এদেশের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু হয়েছে উল্টোটা। বঙ্গবন্ধু আজ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে স্বীকৃত। যত দিন দেশ থাকবে, যত দিন ইতিহাস থাকবে, তত দিন তিনিও বেঁচে থাকবেন মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থলে ভালোবাসার লাল গোলাপ আর রাজনৈতিক শিক্ষাগুরুর প্রতীক হয়ে।

শিক্ষক
প্রতীকী ছবি

এমন আরও অনেক উদাহরণ দিয়ে লেখাটা বড় করা যাবে। আর সেদিকে যেতেও চাই না। তবে এটাও ঠিক সবাই হজরত মুহাম্মদ (সা.), সক্রেটিস বা বঙ্গবন্ধু হতে পারবেন এমনটা আশা করার কোনো কারণ নেই। এরপরও আমাদের সমাজেও যেসব সম্মানিত শিক্ষক নিঃস্বার্থভাবে একটু গতানুগতিকতার ঊর্ধ্বে ওঠে শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করতে পারেন, তাঁরা নিঃসন্দেহেই স্মরণীয় ও বরণীয় হন। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অসাধারণ সম্মান পান। শুধু যে শিক্ষার্থীরা তাঁদের সম্মান করে এমন নয়, বরং সমাজেও তাঁরা বরণীয় হয়ে থাকেন। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে অন্যান্য বিভাগের ক্যাডাররা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা সমাজে খুব সম্মান পান। কিন্তু আমার কাছে বিষয়টি অন্য রকম মনে হয়। তাঁরা সম্মান পান ঠিকই। তবে ব্যক্তি হিসেবে নন, মানুষ সম্মান করেন তাঁদের পদকে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া পদ চলে যাওয়ার পর তাঁদের সম্মানও চলে যায়। কিন্তু একজন আদর্শ শিক্ষকের সম্মান কিন্তু কোনো দিনই কমে না। এমনকি মৃত্যুর পরও না। তবে এমন আদর্শ মানে পৌঁছাতে হলে অবশ্যই পরিশ্রম যেমন দরকার, তেমনই ত্যাগ স্বীকারও অপরিহার্য।

দিবসটা সরকারিভাবে পালন করা

একটা কথা না বললেই নয়। আমাদের দেশে সরকারিভাবে অনেক দিবসই পালন করা হয়। এসব দিবস পালনের অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদেরসহ শিক্ষকদের উপস্থিত থাকতে হয়। কিন্তু শিক্ষকদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই দিবসটি সরকারিভাবে পালন করা হয় না। এই দিবসটি সরকারিভাবে পালন করলে শিক্ষকেরা অবশ্যই নিজেদেরকে সম্মানিত বোধ করতেন, যা তাঁদের জন্য বড় ধরনের একটা প্রণোদনা হিসেবে কাজ করত। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখবে বলে আশা করি।

আমরা সবাই জানি শিক্ষকদের অনেক বঞ্চনা আছে, আছে পাওয়া না পাওয়ার পুঞ্জীভূত বেদনা। তবুও একজন শিক্ষক হিসেবে আমার মূল্যায়ন হলো শিক্ষকেরা যা পান, অন্য কোনো পেশার কেউ তা পান না। একজন শিক্ষক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া) কাছ থেকে যে আন্তরিক ও অকৃত্রিম সম্মান ও ভালোবাসা পান, তার সঙ্গে পৃথিবীর অন্য কিছুর তুলনা হতে পারে, এমনটা অন্তত আমি কোনোমতেই বিশ্বাস করি না। আর তাই আমার এই পেশাটাকে অন্য কোনো পেশার চেয়ে কোনোমতেই ছোট মনে করি না। তবে একটা কথা বলে রাখতে চাই, এ সম্মান ও ভালোবাসা পেতে হলে আগে তাঁদের অন্তরে স্থান করে নিতে হবে।

লেখক

শিক্ষা যদি জাতির মেরুদণ্ড হয়ে থাকে, তবে শিক্ষকেরা হলেন শিক্ষার মেরুদণ্ড। শিক্ষকেরা সমস্যায় থাকলে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা কঠিন হবে। তাই শুধু শিক্ষকগণের নয়, শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষা ক্ষেত্রের সব ধরনের সমস্যা ও অসামঞ্জস্যতা দূর করে একটা পরিকল্পিত শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। তা না হলে আমাদের এসডিজি অর্জনও বাধাগ্রস্ত হবে। আর তাই শিক্ষকদেরকেও এই শিক্ষা–সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখতে হবে। শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিতের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মানসে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রত্যাশা করতেই পারি। মহান আল্লাহ তাআলা আমাদের সহায় হোন। আমিন।

*লেখক: মো. মোতাহার হোসেন, প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত), মোহনগঞ্জ পাইলট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়, মোহনগঞ্জ, নেত্রকোনা।