বাংলাদেশে প্রকৃত ভাষা গবেষক বড় একটা দেখা যায় না। একাধিক কারণে বিষয়টি খুবই অস্বাভাবিক। প্রথমত, আমাদের দেশটাই ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের আদর্শে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বের একমাত্র দেশ। ভাষা বা মাতৃভাষা আমাদের জাতীয় চেতনার এবং জায়মান ‘জাতীয় আখ্যান’-এর এক প্রধান অনুষঙ্গ। দ্বিতীয়ত, মাতৃভাষার অধিকার অর্জনের জন্য ভিন্ন সংস্কৃতির পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসকদের সঙ্গে জীবন-মরণ লড়াই করে একটা গৌরবময় সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার অর্জন করেছি; প্রতিষ্ঠিত করেছি আমাদের মাতৃভাষার মহান মর্যাদা। তৃতীয়ত, মাতৃভাষার গুরুত্বের ধারণাটি বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত করার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নিয়ে তা সাফল্যের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করার গৌরবও আমাদের; একুশে ফেব্রুয়ারি এখন জাতিসংঘঘোষিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সারা বিশ্বে উদ্যাপিত হয়।
চতুর্থত, শুধু মাতৃভাষা নয়, সেই সঙ্গে পৃথিবীব্যাপী শতসহস্র ক্ষুদ্র ভাষার ক্রমবিলুপ্তি রোধ করে সেগুলো যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার গুরুদায়িত্ব বহনেও আমরা এখন বিশ্বের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ইউনেসকোর সহায়তায় দেশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা সে লক্ষ্যেই। অথচ উদ্বেগের বিষয় হলো ভাষা-সম্পর্কিত এত মহৎ গুরুদায়িত্ব যথাযথ অনুধাবন করে সঠিক উদ্যোগ নিয়ে ভাষা গবেষণার সমন্বিত ও সুশৃঙ্খল উদ্যোগ কোনো মহল থেকেই নেওয়া হচ্ছে না। আমাদের জাতীয় চৈতন্যেই বিষয়টির কোনো উপস্থিতি এখন পর্যন্ত উপলব্ধ নয়, যা একধরনের জাতীয় ব্যর্থতার মতো বিষয় বটে।
এ ব্যর্থতা আমাদের জন্য অনেকটা কৃত্রিম এবং সর্বার্থে বেমানান। কারণ, ভাষাচর্চা ও ভাষা অধ্যয়নের এক সুদীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে আমাদের। ইতিহাস বলে, উপমহাদেশে বহিরাগত শাসকদের আগমনের আগে গুরুগৃহে টোলভিত্তিক এক সুশৃঙ্খল স্থানীয় শিক্ষাপদ্ধতি চালু ছিল, যেখানে বিশেষভাবে সংস্কৃত ব্যাকরণ ও ভাষা এক প্রধান অংশজুড়ে থাকত। এটি উপমহাদেশের হাজার বছরের ঐতিহ্য। মোগল আমলে সেগুলো কতক অংশ পাঠশালায় রূপ নেয় এবং বাকি অংশ টোল হিসেবেই চলতে থাকে। পাশাপাশি মক্তব ও মাদ্রাসায় আরবি-ফারসিও সমান্তরাল ধারায় চালু থাকে। এখানের কিছু তথ্য আমি নিয়েছি মোহাম্মদ হান্নান ‘বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস’ বইয়ে সুখময় সেনগুপ্তের ‘বঙ্গদেশে ইংরেজি শিক্ষা: বাঙ্গালীর শিক্ষাচিন্তা’ গ্রন্থের উদ্ধৃতির বরাতে যে বিবরণ দিয়েছেন, সেখান থেকে। এরপর উনিশ শতকে নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড, চার্লস উইলকিনস, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, পঞ্চানন কর্মকাররা ভাষা, বর্ণমালা এবং সার্বিকভাবে শিক্ষা নিয়ে ব্যাপক কাজ করেছেন।
প্রসঙ্গত, একটা বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে এখানে। ইউরোপে ভাষাচর্চার ইতিহাসে দেখা যায়, ষোড়শ শতাব্দীতে Ascham এবং সপ্তদশ শতাব্দীতে Montaigne Ges সপ্তদশ শতাব্দীতে Lock এবং Comenius ল্যাটিন কারিকুলাম সংস্কারের প্রস্তাব করেছেন (Richards and Rodgers.2002. Pp-4)। সুতরাং ল্যাটিন শিক্ষার ইতিহাস যে ষোড়শ শতকের আগে থেকে, তা সন্দেহাতীত। কিন্তু আমাদের উপমহাদেশে ভাষা শিক্ষা? নিঃসন্দেহে আরও আগে থেকে। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে আধুনিক ভাষাতত্ত্বের জনক বলে স্বীকৃত পাণিনির চার হাজার সূত্রসংবলিত ‘অষ্টাধ্যায়ী’ ব্যাকরণ বিশ্বের প্রথম ব্যাকরণ বলে গৃহীত এবং ভাষা গবেষকদের এক বিপুল বিস্ময়ের বিষয়, যদিও আমরা তথাকথিত শিক্ষিত অনেকেই তাঁর খোঁজ রাখি না। সবচেয়ে আশ্চর্য যে এই যুগেও কোনো ব্যাকরণবিদের পক্ষে পাণিনির সূত্রের বাইরে গিয়ে কাজ করা সম্ভব হয়নি। সোস্যুর থেকে চমস্কি পর্যন্ত বিখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিকেরা পাণিনি দ্বারা প্রভাবিত। আর আধুনিক কালে এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা স্যার উইলিয়াম জোন্স উপমহাদেশে এক যুগান্তকারী অনুসন্ধানের মাধ্যমে ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণার এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন, যার ধারাবাহিকতা এ অঞ্চলের মানুষ ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। জোন্স ব্রিটিশ-ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে নিয়োজিত কর্মকর্তা ছিলেন। সরকারি কাজের সূত্রে সংস্কৃত ভাষা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এর সার্বিক উৎকর্ষ এবং ল্যাটিন ভাষার সঙ্গে এর শব্দ ও ব্যাকরণের আশ্চর্য রকম মিল লক্ষ করে তিনি বিস্মিত হন। পরে ইউরোপের আরও অনেক ভাষাকে একইভাবে তুলনা করে তিনি এ সিদ্ধান্তে আসেন, তাঁর পরীক্ষিত ভাষাগুলোর সৃষ্টি একই উৎস থেকে। এ সম্পর্কে জোন্সের বহুল ব্যবহৃত উদ্ধৃতিটি এখানে দেওয়া হলো, ‘The Sanskrit language, whatever be its antiquity, is of a wonderful structure; more perfect than the Greek, more copious than the Latin, and more exquisitely refined than either, yet bearing to both of them a stronger affinity, both in the roots of verbs and in the forms of grammar, than could possibly have been produced by accident.’ (The Study of Language. George Yule.2017. Cambridge University Press. P-252.) |
বলা বাহুল্য, এগুলোর মধ্যে সংস্কৃত ভাষাটিই সর্বাপেক্ষা প্রাচীন। এখন এটি সর্বজনস্বীকৃত যে পাণিনির সংস্কারের আগের সংস্কৃত ভাষাই পৃথিবীর অধিকাংশ ভাষার আদি রূপ, যাকে ভাষাবিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ইন্দো-ইউরোপিয়ান। সুতরাং ভাষার আদি উৎস এবং ভাষাতত্ত্বের প্রধান ধারাটির সূত্রপাত আমাদের এ মাটিতেই, যদিও আমরা তা ভুলতে বসেছি।
পূর্ব বাংলার, এমনকি উপমহাদেশের একজন প্রধান ভাষাতাত্ত্বিক হলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত ভাষা অধ্যয়ন করতে গিয়ে হিন্দুদের হাতে অন্যায়ভাবে অপদস্থ¯হন। তবু হাল ছেড়ে না দিয়ে তিনি ভাষাতত্ত্বের গবেষণায় খ্যাতি অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবেও শিক্ষকতা করেন। ভাষাতত্ত্বের গবেষণায় তিনি অন্যতম প্রধান পথিকৃৎ। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উল্লেখযোগ্য কাউকে দেখা যায়নি। আশির দশকে একমাত্র অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ ভাষাতত্ত্বের ওপর কিছু কাজ করেছেন বলে জানা যায়। এই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ভাষাতত্ত্ব’ নামে একটা ‘অর্ধবিভাগ’ চালু করা হয়।
‘অর্ধবিভাগ’ বলছি এই কারণে যে এখানে স্নাতক সম্মান পর্যায়ে কোনো ছাত্র অধ্যয়ন করতেন না। শুধু এমএ প্রিলিমিনারি শ্রেণিতেই ভর্তি করা হতো। এখান থেকেও গত চার দশকে নজরকাড়া কাজ নিয়ে কোনো ভাষাতাত্ত্বিক বের হয়েছেন, তা দেখা যায় না। দৈবাৎ কোনো অধ্যাপকের দু-একটা লেখা কোনো কোনো জার্নাল বা সাময়িকীতে চোখে পড়ে মাত্র।
ভাষাতত্ত্বের গবেষণায় সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকায় থাকা উচিত ছিল যে সংস্কৃত বিভাগের, দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে শূন্যের কোঠারও অনেক নিচে। এর কারণ নিয়ে আলাদাভাবে গবেষণা করা যেতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সংস্কৃত বিভাগগুলোর এ অমার্জনীয় ব্যর্থতা নিয়ে গভীর অনুসন্ধান হওয়া দরকার।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা নিয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ করে—এমন দুটি বিভাগ হলো ইংরেজি ও বাংলা। বাংলা বিভাগে আলাদাভাবে ভাষাতত্ত্বের অধ্যয়ন হয় না বলেই জানি। ইংরেজি বিভাগে দীর্ঘকাল ধরে ‘ফিলোলজি’ নামে একটা স্নাতকোত্তর শ্রেণির অধ্যয়ন চালু ছিল। আশির দশকে দেখেছি এর নাম হয়েছে ‘ল্যাঙ্গুয়েজ’। এখানে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি শেখানোর সঙ্গে সম্পর্কিত প্রায়োগিক ভাষাতত্ত্বের কিছু জিনিস পড়ানো হতো বটে, তবে মূল ভাষাতত্ত্বের কোনো অধ্যয়ন বা গবেষণার কোনো নজির চোখে পড়ে না। দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ও বাংলা বিভাগগুলো সামষ্টিকভাবে ভাষাতত্ত্বের অধ্যয়ন-গবেষণার ক্ষেত্রে প্রবলভাবে ব্যর্থ—এ কথা জোরের সঙ্গেই বলা যায়।
ভাষা গবেষণা ও ভাষাতত্ত্বের গবেষণার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা বাংলা একাডেমির। একাডেমির এ বিষয়ে যে আদৌ কোনো চিন্তা কাজ করে না, তার বড় প্রমাণ হলো ভাষাভিত্তিক গবেষণা নিয়ে এখানে কোনো জার্নাল প্রকাশিত হয় না। বাংলা একাডেমিই যদি না করে, তবে অন্যের দোষ দিয়ে আর লাভ কী?
দেশে ভাষাতত্ত্বের ওপর ছিটেফোঁটা কোনো চর্চা যদি হয়ে থাকে, তাহলে তা হয়েছে এক অপ্রত্যাশিত এলাকায়। অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট’-এর এখানে কিছু হিস্যা অস্বীকার করা যাবে না। কারণ, ওই প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন অধ্যাপকও এর সঙ্গে জড়িত। ড. জাহাঙ্গীর তারেক ও ড. শিশির ভট্টাচার্য এমন দুটি নাম। মোটামুটি নব্বই দশকের শুরু থেকে শিক্ষিত তরুণদের একটা অংশ উত্তরাধুনিক তত্ত্বের প্রতি আগ্রহী হতে থাকে। বলা বাহুল্য, উত্তরাধুনিক তাত্ত্বিকদের অনেকেই কাজ করেছেন ভাষার দর্শনের ওপর। নিৎসে, ভিটগেনস্টাইন, সোস্যুর, অডার্নো, ভাবা, বেকেট, আলথুসার, হাইডেগার, বার্থ, ফুকো, গায়ত্রী, দেরিদা, সাইদ—এমন অনেকেই ভাষার দর্শনের ওপর তাঁদের তত্ত্বগুলোর পরীক্ষ-নিরীক্ষা করেছেন। ঠিক একই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম ফিল এবং ইংরেজি এমএ ক্লাসে দেশে প্রথমবারের মতো উত্তরাধুনিক সাহিত্যতত্ত্ব পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সোভিয়েতের পতনের পর মার্ক্সীয় তত্ত্বের জায়গাটিতে খানিকটা শূন্যতা তৈরি হলে উত্তরাধুনিক তত্ত্ব সে জায়গা দ্রুত দখলে নিতে থাকে। মূলত, শাহবাগ, আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ, গ্যেটে ইনস্টিটিউট এ প্রজন্মের আখড়া হয়ে ওঠে। এদের কোনো নিয়মিত মুখপত্রের সন্ধান পাওয়া না গেলেও দৈবাৎ কোনো সাময়িকীতে এক-আধটা লেখা দেখা গেছে। সৈয়দ মনজুরুল ইসলামদের মতো গুণী অধ্যাপকেরা এ প্রজন্মকে তাঁদের লেখার মাধ্যমে প্রভাবিত করতে থাকেন। আজফার হোসেনদের মতো এই তরুণদের একটা অংশ সাহিত্য সমালোচনার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখালেও ভাষাতত্ত্বের ক্ষেত্রে এই প্রজন্মের উল্লেখ করার মতো কোনো কাজ নেই। তবু টেক্সট, ডিসকোর্স, ডিকনস্ট্রাকশন, সিগনিফায়ার-সিগনিফায়েডের মতো ভাষার দর্শনের আলোচনায় তাঁদের স্বতঃস্ফূর্ততা আমাদের ভাষাতত্ত্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশান্বিত হতে আগ্রহী করে তোলে। এখন দরকার প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘একুশে চেয়ার’ প্রতিষ্ঠা করে গুণী ভাষাতাত্ত্বিকদের সেখানে নিয়োগ দিয়ে ভাষাতত্ত্ব অধ্যয়ন ও গবেষণায় নতুন গতি সৃষ্টি করা।
*লেখক: অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক, সমালোচক ও অনুবাদক। কানাডাপ্রবাসী।