স্বাভাবিক শিক্ষায় ফিরতে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যালেঞ্জ কি কি

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ভর্তি পরীক্ষা শুরুর আগে পড়াশোনা করছেন পরীক্ষার্থীরা
প্রথম আলো ফাইল ছবি

মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শঙ্কায় ঠিক দেড় বছর আগে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল বাংলাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এরপর ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষার মধ্যেই সীমিত ছিল শিক্ষা কার্যক্রম। এই সময়ের মধ্যে নিজের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের প্রাঙ্গণে মাটির ঘ্রাণ পায়নি কোনো শিক্ষার্থী। দিনের পর দিন গৃহবন্দী থেকে তাদের পার করতে হয়েছে অনেকটা একঘেয়েমি জীবন। ফলে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে অনেক শিক্ষার্থী। ঘরবন্দী জীবনে যখন নাভিশ্বাস তাদের, তখনই ঘোষণা এল খোলা হচ্ছে প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আবারও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে জাগল নিজের ক্যাম্পাসে পদচারণের উচ্ছ্বাস। তারা আশায় বুক বেঁধেছে, দ্রুত ঘোষণা হবে প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয় খোলার।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার এমন সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সরকার সত্যিই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। কারণ, কিছুদিন পরপরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার জন্য নানামুখী চাপ ছিল সরকারের ওপর। সেই সময়ে বেশ ফলাও করে বলা হতো, সবকিছু খুললে, শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে বাধা কোথায়? সরকার দৃঢ়তার সঙ্গে সব সমালোচনায়ও চুপ থেকেছে, ধৈর্য ধরে কারও সমালোচনায় কান দেয়নি। কারণ, মহামারির ভয়ংকর থাবায় অল্প একটু ভুলের জন্য বেশ অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারত। এমনিতেই বাংলাদেশ অনেক ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশ। তার ওপর রয়েছে জনসচেতনতার বেশ অভাব। অন্যদিকে বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারণক্ষমতার চেয়ে শিক্ষার্থী বেশি। সেখানে পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মানা অনেকটা অসম্ভবই বলা চলে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় চাইলে এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই খুলতে পারবে। তবে সিদ্ধান্তের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের ওপর। আশা করা যাচ্ছে, দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ও খুলে দেওয়া হবে।

এবার আসা যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের টিকা প্রসঙ্গে। আগস্ট মাসের শুরুতে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ লাখ ৭৯ হাজার ২৬১ শিক্ষার্থী টিকার জন্য নিবন্ধন করেছেন। এর মধ্যে প্রথম ডোজ টিকা পেয়েছেন ৭৯ হাজার ৯১৪ জন। দুই ডোজ পেয়েছেন ৬ হাজার ৭২ জন। পাশাপাশি সরকারি পর্যায়ের প্রায় সব শিক্ষকই টিকা নিয়েছেন। অন্যদিকে এই মাসের শুরুতে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৩ লাখ ৬৩ হাজার ২২২ শিক্ষক-কর্মচারীর মধ্যে টিকা নিয়েছেন ২ লাখ ৭৮ হাজার ৪২৬ জন। বাকি আছেন প্রায় ৮৪ হাজার শিক্ষক। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৪ হাজারের বেশি শিক্ষক টিকার জন্য নিবন্ধন করেছেন, তাঁদের মধ্যে টিকা নিয়েছেন ৩০ হাজারের বেশি। বাকি শিক্ষকেরাও এই মাসের মধ্যেই টিকা নিয়ে নেবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই ভ্যাকসিনের আওতায় ইতিমধ্যেই চলে এসেছে।

প্রথম আলো ফাইল ছবি

বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি সচেতন। আবার একইভাবে তারাই সবচেয়ে বেশি সংবেদনশীল ও আবেগপ্রবণ। তাই এমন মহামারি পরিস্থিতির মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং কিছু ব্যাপার রয়েছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা খাতে শিক্ষার্থীদের যে ক্ষতি হয়েছে, সেটি পুষিয়ে নিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বেশ গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণসহ জরুরি কিছু করণীয় আছে।

বাংলাদেশের প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব চিকিৎসাকেন্দ্রগুলো অনেকাংশেই পরিপূর্ণ চিকিৎসাব্যবস্থা প্রদানের জন্য পূর্ণাঙ্গ নয়। ফলে যেকোনো পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঠানো হয়। অর্থাৎ এককথায় বলতে গেলে পূর্ণাঙ্গ কোনো চিকিৎসাব্যবস্থা এগুলোতে নেই, যার ফলে প্রায়ই বড় ধরনের বিপদে পড়তে হয় অসুস্থ শিক্ষার্থীদের। পাশাপাশি মহামারি পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল খোলা রেখে এমন সব চিকিৎসাকেন্দ্র অনেকাংশেই কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে না। তাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিজ উদ্যোগে সরকারি সহযোগিতায় এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব চিকিৎসাকেন্দ্রকে যত দূর সম্ভব করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সুস্থতার জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসামগ্রীসহ পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাব্যবস্থার জন্য দরকারি সবকিছু সংযোজন করে সংস্কার করা প্রয়োজন। কারণ, মহামারি কখন শেষ হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সার্বিক চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতকরণে প্রশাসনের এমন উদ্যোগ বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোই হবে খোলার পর সবচেয়ে সংবেদনশীল অংশ। সেখানে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার কাজটি সহজ হবে না; কিংবা সংক্রমিত হলে আইসোলেশনের কাজটিও হবে কঠিন। তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অতিরিক্ত সময় ব্যয় করতে হবে নজরদারি ও মোটিভেশনে। ক্যাম্পাসের একাডেমিক ভবন ও হলগুলোতে পর্যাপ্ত স্যানিটাইজেশনের ব্যবস্থা রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সঙ্গে শিক্ষকদের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। পাশাপাশি শিক্ষকদের সার্বিক দিকনির্দেশনায় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের সার্বক্ষণিক মাস্ক ব্যবহারসহ স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে হবে।

পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও শিক্ষকদের মহামারি পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম সফলভাবে চালিয়ে নিতে আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ দ্রুত নিতে হবে। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে নিয়মিত তাপমাত্রা মাপা ও তা পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের একটি কক্ষ প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থাসহ আইসোলেশন কক্ষ হিসেবে প্রস্তুত রাখতে হবে। ক্যাম্পাসের সব কক্ষ, সিঁড়ি, আঙিনা ও ওয়াশরুম নিয়মিত পরিষ্কার রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যদিকে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের বসার ক্ষেত্রে যত দূর সম্ভব শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে বসার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। সর্বোপরি মহামারি পরিস্থিতিতে সরকারপ্রদত্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে আনন্দঘন শিখন কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিত করা বেশ জরুরি।

দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর মহামারি পরিস্থিতির মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সরাসরি শিক্ষা কার্যক্রম সফলভাবে চালু রাখতে এবং গত প্রায় ১৮ মাসের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষার্থীদের বেশ কিছু করণীয় রয়েছে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম নিয়মিত ও সফলভাবে চালু রাখতে শিক্ষার্থীদের ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, রাজনৈতিক গ্রুপিং, প্রভাব বিস্তার, পদপদবিসহ নানা কারণে মহামারি–পূর্ববর্তী সময়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে মাঝেমধ্যেই শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার ঘটনা প্রায় সবারই জানা। তাই দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় খুলছে, সেখানে শিক্ষার্থীদের এসব কার্যক্রম থেকে সরে এসে ক্যাম্পাসে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রেখে শিক্ষা কার্যক্রম সফলভাবে পরিচালনায় প্রশাসনকে সহায়তা করা বেশ জরুরি।

পাশাপাশি যেসব শিক্ষার্থী এখনো কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন নিতে পারেননি, তাঁদের দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে ভ্যাকসিন নিতে হবে। অন্যদিকে মহামারি পরিস্থিতিতে বিশেষ জরুরি প্রয়োজন ছাড়া আবাসিক হল থেকে ক্যাম্পাসের বাইরে গিয়ে অহেতুক ঘোরাঘুরি না করতে শিক্ষার্থীদের নিজেদের সচেতন হতে হবে এবং বাইরে গেলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাফেরা করায় গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে যেহেতু শিক্ষার্থীদের সংখ্যা অনেক বেশি, তাই এ ক্ষেত্রে করোনার সংক্রমণ ও অন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার বেশ আশঙ্কা থাকবে।

মোদ্দাকথা হলো বিশ্ববিদ্যালয় খোলার ক্ষেত্রে সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে এই চ্যালেঞ্জে অবশ্যই আমাদের জিততে হবে এবং দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় খুলে শিক্ষা কার্যক্রম নিয়মিত রাখতে হবে। কারণ, এই চ্যালেঞ্জের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালি জাতির ভবিষ্যৎ কান্ডারি স্নেহের শিক্ষার্থীরা। যাদের মেধা, মনন ও উন্নত চিন্তাভাবনায় সফলভাবে এগিয়ে যাবে দেশ। মহামারি পরিস্থিতিতে শিক্ষা খাতের ক্ষতি পুষিয়ে ঘুরে দাঁড়াবে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ।

লেখক: মো. শাহ জালাল মিশুক, সহকারী অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়