নতুন ধরনের শিক্ষায় উপযুক্ত শিক্ষকই বড় চ্যালেঞ্জ

নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী যষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন একজন শিক্ষক। রাজধানীর গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলে
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

শিক্ষাব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন এনেছে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার। করোনা–পরবর্তী সময়ে অনলাইন ও সশরীর ক্লাস করার ব্যবস্থা এতে ভিন্নমাত্রা যুক্ত করেছে। সেই সঙ্গে নতুন শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে পড়াশোনার ধরনও বদলে ফেলা হচ্ছে। প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিদ্যমান পরীক্ষাব্যবস্থার চেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিকভাবে শিক্ষার্থীদের বেশি মূল্যায়ন করা হবে।

কিন্তু এসব পরিবর্তনের সঙ্গে শিক্ষকেরা কতটা খাপ খাওয়াতে পারছেন বা পারবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ, বর্তমানে বিপুলসংখ্যক শিক্ষকের দক্ষতা নিয়ে যেমন প্রশ্ন আছে, আবার অনেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে নানা কৌশলে শিক্ষার্থীদের কোচিং-প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করার অভিযোগ আছে। অথচ শিক্ষার এই পরিবর্তনের মূল চালিকা শক্তি শিক্ষকেরাই। তাই শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিরা বলছেন, শিক্ষকদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে তাঁদের আর্থিক সুবিধা ও মর্যাদা বাড়ানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে শিক্ষায় যে রূপান্তর বা পরিবর্তন আসছে, তা বুমেরাং হতে পারে।

এমন পরিস্থিতি নিয়ে সারা বিশ্বের মতো ৫ অক্টোবর বাংলাদেশেও নানা কর্মসূচিতে পালিত হচ্ছে বিশ্ব শিক্ষক দিবস। এবারের মূল প্রতিপাদ্য—শিক্ষকদের দিয়েই শিক্ষার রূপান্তর শুরু।

শিক্ষক দিবসের প্রাক্কালে পরিবর্তিত শিক্ষার বিষয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখার পরিচালক অধ্যাপক এ কিউ এম শফিউল আজম প্রথম আলোকে বলেন, রূপান্তরিত শিক্ষার জন্য সব শিক্ষককে উপযুক্ত করে গড়ে তোলা বড় চ্যালেঞ্জ। তবে এ জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে।

করোনার কারণে প্রায় দুই বছর ধরে অনলাইন এবং সশরীরের মতো মিশ্র ব্যবস্থায় ক্লাস হয়েছে বা হচ্ছে। ভবিষ্যতেও যাতে এই মিশ্র ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়, সে সিদ্ধান্তও হয়েছে। ইতিমধ্যে মিশ্র শিখনব্যবস্থা নিয়ে কিছু নীতিমালা হয়েছে এবং হচ্ছে। এ ছাড়া আগামী জানুয়ারি থেকে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়িত হবে। পর্যায়ক্রমে আগামী ২০২৭ সালে গিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত নতুন শিক্ষাক্রম পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হবে। নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন ব্যবস্থায় বড় রকমের পরিবর্তন হবে। এর মধ্যে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা হবে না, পুরোটাই মূল্যায়ন করা হবে সারা বছর ধরে চলা বিভিন্ন রকমের শিখন কার্যক্রমের ভিত্তিতে। পরবর্তী শ্রেণিগুলোর মূল্যায়নের পদ্ধতি হিসেবে পরীক্ষা ও ধারাবাহিক শিখন কার্যক্রম—দুটোই থাকছে। এ ছাড়া এখনকার মতো এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষাও হবে না। শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে হবে এসএসসি পরীক্ষা। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দুটি পাবলিক পরীক্ষা হবে। এই দুই পরীক্ষার ফলের সমন্বয়ে হবে এইচএসসির চূড়ান্ত ফল। নতুন শিক্ষাক্রমে শেখানোর ধরনও বদলে যাচ্ছে। শ্রেণিকক্ষের পাশাপাশি আশপাশের পরিবেশ থেকেও হাতে-কলমে শেখানো হবে। আর এসব বাস্তবায়নের মূলে থাকবেন শিক্ষকেরা।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সর্বশেষ শুমারি (২০২১) অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে প্রাথমিক স্তরে প্রায় ১ লাখ ১৯ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মোট শিক্ষক আছেন সাড়ে ৬ লাখের বেশি। যার মধ্যে সরকারি শিক্ষক ৩ লাখ ৫৯ হাজার জন। আর বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, মাধ্যমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত মোট শিক্ষক আছেন প্রায় ছয় লাখ।

মাউশির প্রশিক্ষণ শাখার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সারা দেশের শিক্ষকদের নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে ধারাবাহিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। আপাতত অনলাইনে প্রশিক্ষণ চলছে। ৩১ অক্টোবরের মধ্যে সব শিক্ষককে ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১ অনলাইন প্রশিক্ষণ’ বিষয়ে একটি কোর্স সম্পন্ন করতে হবে। এ কোর্স ছাড়া কোনো শিক্ষক সরাসরি প্রশিক্ষণে অংশ নিতে পারবেন না। এরপর পর্যায়ক্রমে বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।

কিন্তু অতীতে শিক্ষকদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতা খুব একটি সুখকর নয়। পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও তদারকি না থাকায় ২০০৮ সালে চালু হওয়া সৃজনশীল পদ্ধতি এখন পর্যন্ত সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যায়নি। মাউশির গত মাসের এক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ৬২ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সরাসরি সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করতে সক্ষম। কিন্তু এখনো অন্য বিদ্যালয়ের সহায়তায় সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করেন ২৩ দশমিক ৩০ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। আর প্রায় ১৫ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বাইরে থেকে সৃজনশীল প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করেন। অর্থাৎ প্রায় ৩৮ শতাংশের মতো শিক্ষক এখনো পুরোপুরিভাবে সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারেন না।

জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটির সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক এম তারিক আহসান প্রথম আলোকে বলেন, পরিবর্তিত শিক্ষাক্রমের রূপরেখা অনুযায়ী শিখনপ্রক্রিয়ায় বিভিন্ন অংশীজনকে যুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষকেরা থাকবেন নেতৃত্বের ভূমিকায়। এ জন্য স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি কিছু পরিকল্পনার সুপারিশ করা হয়েছে, যাতে ধাপে ধাপে বিপুলসংখ্যক শিক্ষককে প্রস্তুত করা যায়। তবে এসব সুপারিশ ভালোভাবে বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।

শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে এম তারিক আহসান বলেন, এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের জন্য বিশেষ কিছু ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যেমন, স্বাস্থ্যকার্ড দেওয়া যেতে পারে, যার ভিত্তিতে তিনি সহজে চিকিৎসাসেবা পেতেন। আবার সরকারি বিভিন্ন সেবাপ্রাপ্তিতে শিক্ষকদের অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে। এসব করলে শিক্ষকেরা উদ্বুদ্ধ হবেন।