এইচএসসি পরীক্ষা–২০২৫: বাংলা দ্বিতীয় পত্রের প্রবন্ধ—বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন
এইচএসসি পরীক্ষায় বাংলা দ্বিতীয় পত্রের একটি দরকারি বিষয় হলো, প্রবন্ধ রচনা লেখা। নম্বর থাকে ২০। বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে নিচের প্রবন্ধ রচনাটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৫ সালের এইচএসসি পরীক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা ও সমসাময়িক বিষয় হিসেবেও এটি অনেক দরকারি।
প্রবন্ধ: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন
ভূমিকা: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সাধারণ শিক্ষার্থীদের একটি আন্দোলন। কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আন্দোলনটিই পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন হিসেবে রূপ লাভ করে। নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে ৫ আগস্ট ২০২৪ সালে তখনকার সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে ছাত্র আন্দোলনটি চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। বাংলাদেশে ২০২৪ সাল পর্যন্ত মোট তিনবার কোটা সংস্কারের জন্য বড় ধরনের আন্দোলন সংঘটিত হয়।
আন্দোলনের পেছনের কারণ: বাংলাদেশে কোটাব্যবস্থা চালু হয় ১৯৭২ সালে। তখন সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা, ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ জেলা, ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও ১ শতাংশ ছিল প্রতিবন্ধী কোটা আর সব মিলিয়ে কোটা ছিল ৫৬ শতাংশ, যা মেধাবীদের সঙ্গে একধরনের বৈষম্যের শামিল। তাই এ ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে চাকরিপ্রত্যাশী ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু করে। (তথ্যসূত্র: প্রথম আলো: ৪ মার্চ ২০১৮)
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পটভূমি: ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সাধারণ শিক্ষার্থীদের লাগাতার আন্দোলনের ফলে সরকার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিল ঘোষণায় পরিপত্র জারি করে। তখন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতৃত্বে শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন করেছিলেন, সরকার সেই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়। কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ জুন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবরের কোটা বাতিল–সংক্রান্ত পরিপত্রটি অবৈধ ঘোষণা করেন। হাইকোর্টের এ ঘোষণার ফলে নতুনভাবে আবার এই আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনকারীদের মূল দাবি ছিল, কোটার যৌক্তিক সংস্কার।
শিক্ষার্থীদের ভূমিকা: সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অনেক অবদান ছিল। এ আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই। আন্দোলনকারী কয়েকজন মুখ্য সমন্বয়কও ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মূল প্রাণকেন্দ্র ছিল রাজু ভাস্কর্য, অপরাজেয় বাংলা, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, শাহবাগ চত্বরসহ গোটা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। এ আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে একাধিক সমন্বয়ককে এর নেতৃত্বে দেখা গেছে। আন্দোলন দমনের নামে সরকার বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। তারা ভেবেছিল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করলেই আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যাবে। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ আন্দোলনে যোগ দিয়ে সংহতি প্রকাশ করেন, তাতে পুরো আন্দোলনের ঘটনা বেগবান হয়ে ওঠে।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের নির্যাতন: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আরও বেগবান হয় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের তখনকার প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ কথাটি প্রত্যাহারের দাবির মধ্য দিয়ে। এ লক্ষ্যে সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। কিন্তু তাঁদের সে আন্দোলনে ইতিবাচক সাড়া না দিয়ে পুলিশ বাহিনী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। সারা দেশে অসংখ্য শিক্ষার্থী আহত হন এবং প্রাণ দেন।
শিক্ষার্থীদের ৯ দফা: আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ৬ জুলাই সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে পরীক্ষা বর্জন, ছাত্র ধর্মঘট ও সড়ক–মহাসড়ক অবরোধের ডাক দেন। এর নাম ছিল ‘বাংলা ব্লকেড’। ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরস্ত্র শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে পুলিশ গুলিতে হত্যা করে। ১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি পক্ষ ৯ দফা দাবি জানিয়ে ‘শাটডাউন’ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। এর পাশাপাশি ২২ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম চার দফা দাবি জানিয়ে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি স্থগিত করে চার দফা দাবি জানায়—৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ইন্টারনেট চালু, ক্যাম্পাসগুলো থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রত্যাহার করে ক্যাম্পাস চালু, সমন্বয়ক ও আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তা প্রদান এবং কারফিউ প্রত্যাহার। ৩০ জুলাই ছাত্র ও নাগরিকদের হত্যার প্রতিবাদে সারা দেশের শিক্ষার্থীরা ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ নামে প্রতিবাদ করেন।
ছাত্র আন্দোলন থেকে গণ–আন্দোলন: কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে গড়ে ওঠা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শেষ পর্যন্ত শুধু শিক্ষার্থীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। সারা দেশের অসংখ্য তরুণ, যুবক, নারী–পুরুষ, বৃদ্ধসহ নানা বয়স ও শ্রেণি–পেশার মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন।
এক দফার অসহযোগ আন্দোলন: বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। শিক্ষার্থীরা সরকার পতনের এক দফা দাবিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন।
ফ্যাসিবাদের পতন: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক দফার দাবিতে বাংলাদেশে দীর্ঘদিনের ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা প্রথমে ৬ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কিন্তু ৪ আগস্ট সারা দেশে ছাত্র–জনতাকে নির্বিচার হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনায় ৬ আগস্টের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি এক দিন এগিয়ে ৫ আগস্ট করা হয়। এদিন সারা দেশের ছাত্র–জনতাকে ঢাকা অভিমুখে আসার আহ্বান জানানো হয়। সকাল থেকে সারা দেশের মানুষের মধ্যে ছিল উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা। এরই মধ্যে ছাত্র–জনতার ঢাকামুখী প্রবেশের ঢল সরকারের পতন ত্বরান্বিত করে। ৫ আগস্ট দুপুরে গণ–অভ্যুত্থানের মুখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে দেশ ত্যাগ করেন।
উপসংহার: আজ বাংলাদেশের ইতিহাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সবচেয়ে আলোচিত এক অধ্যায়। দীর্ঘ ফ্যাসিবাদের কবলে পড়ে দেশের মানুষ যখন হতাশ ও দিশাহারা, ঠিক সেই সময় ছাত্র–জনতার আন্দোলনে ফ্যাসিবাদ সরকারের পতন চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ গড়ার সুযোগ।
*লেখক: মোস্তাফিজুর রহমান, সিনিয়র শিক্ষক, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজ, ঢাকা